Advertisement
০৪ জুন ২০২৪
Crime

‘যারা আমার এই অবস্থা করেছে, ছাড়বেন না’

প্রথম সন্তান জন্মের পরেই মারা যাওয়ার পরে দ্বিতীয় সন্তান মেয়ে হলেও বদ্রীনাথ ও আশা সিংহ দুঃখ পাননি।

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

প্রেমাংশু চৌধুরী
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০২০ ০৬:২৯
Share: Save:

পাখি পুষতে খুব ভালবাসত মেয়েটি। খাঁচায় পোরা ছোট ছোট নানা রঙের পাখি। কিন্তু নিজের জীবনটা খাঁচায় পোরা ছিল না।

দক্ষিণ দিল্লির মহাবীর কলোনির দু’কামরার নিচু ছাদের ঘরে পাখি পোষার জায়গা কোথায়! তা-ও বাড়ির বড় মেয়ের জন্য আলাদা ঘর বরাদ্দ হয়েছিল। একটি ঘরে ঠাসাঠাসি করে বাবা-মা, দুই ভাই। অন্য ঘরে দেওয়ালে অঙ্ক-ফিজিক্স-কেমিস্ট্রির নানা ফর্মুলা।

প্রথম সন্তান জন্মের পরেই মারা যাওয়ার পরে দ্বিতীয় সন্তান মেয়ে হলেও বদ্রীনাথ ও আশা সিংহ দুঃখ পাননি। মেয়ে পড়াশোনা করে বড় হবে ভেবে বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। মেয়েটির ইচ্ছে ছিল, বড় হয়ে ডাক্তার হবে। স্মরণশক্তি এতটাই ভাল ছিল যে সকলের মোবাইলের নম্বর মুখস্ত থাকত। এমনকি কারও দু’টো মোবাইল থাকলে দ্বিতীয় মোবাইলের নম্বরও মুখস্ত থাকত।

লম্বা চুল খুলে রাখতে ভালবাসত। স্কুলের বান্ধবীরা বাড়ি এলে শুয়ে শুয়ে গল্প করত, চুলগুলো বিউটি পার্লারে গিয়ে ‘স্ট্রেট’ করাতে হবে। মাঝে মাঝে দু’এক গাছি চুলে রং করা থাকবে। রান্নাঘর থেকে মা জিজ্ঞাসা করতেন, তুই টাকা কোথায় পাবি রে? মেয়েটার উত্তর ছিল, স্নায়ুরোগের ডাক্তার হলে অনেক নাম-ডাক-রোজগার হবে। সেই টাকায় সাজগোজ করব আর নানা রকম চটি কিনব। আর গাড়ি কিনব।

সব স্বপ্ন সত্যি হয় না। প্রি-মেডিক্যাল টেস্টের জন্য খাটাখাটি করেও লাভ হয়নি। দিল্লি ছেড়ে দেহরাদূনের সাই ইনস্টিটিউটে ফিজিয়োথেরাপির কোর্সে ভর্তি হয়েছিল। নিজের খরচ, দুই ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ, এত টাকা কোথা থেকে আসবে? বাবার সারা দিন দিল্লি বিমানবন্দরে হাড়ভাঙা খাটুনির চাকরি। মেয়েটি দিনে পড়াশোনার সঙ্গে রাতে কল-সেন্টারের চাকরি নিয়েছিল।

তাতে অবশ্য রেজাল্ট খারাপ হয়নি। ২০১২-র ডিসেম্বরে দিল্লি ফিরে গুরুগ্রামের একটি হাসপাতালে ইন্টার্নের কাজ পেয়েছিল মেয়েটি। তারপরেই সেই ১৬ ডিসেম্বর! মৃত্যুর পরে পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হল। দেখা গেল, জীবনের শেষ পরীক্ষায় ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছিল মেয়েটি। ছ’টি বিষয়ে ১১০০-র মধ্যে ৮০০ নম্বর। প্রায় ৭৩ শতাংশ।

তার আগেই লড়াই শেষ হয়ে গিয়েছে। গণধর্ষণ কাণ্ডে দিল্লি পুলিশের তদন্তকারী অফিসার ছায়া শর্মা বলেছিলেন, ২৩ বছরের মেয়ে ওই রকম শারীরিক নির্যাতনের পরে নিজের বিবৃতি রেকর্ড করিয়েছিল। বারবার বলেছিল, ‘‘যারা আমার এ অবস্থা করেছে, তাদের ছাড়বেন না।’’

মেয়েটির পরিবার আদতে উত্তরপ্রদেশের বালিয়ার। ভূমিহার। জাতপাতের হিসেবে ‘নিচু সমাজের’। কিন্তু বন্ধুত্ব হয়েছিল ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলের সঙ্গে। দেহরাদূন থেকে বন্ধুর সঙ্গে স্কাইপে কথা বলতে গিয়ে গান শোনাত মেয়েটি। সেই বন্ধুর সঙ্গেই ১৬ ডিসেম্বর রাতে সাকেত সিটিওয়াক হলে সিনেমা দেখতে যাওয়ার পরিকল্পনা। কোন সিনেমা দেখা হবে, সেটাও নিজেই ঠিক করেছিল। ‘লাইফ অব পাই’। কালো-খয়েরি সোয়েটার, সঙ্গে জিনস। সিনেমা দেখার আগে উইন্ডো শপিং, আইসক্রিম। নিজের চটি কেনার পাগলামির কথা বলতে গিয়ে নিজেই হাসত। বন্ধু একটা সরু আংটি দিয়েছিল। কিন্তু বন্ধুকে ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিল, এখন তুমি রাখো। পরে চেয়ে নেব।

মেয়ের মৃত্যুর তিন বছর পরে মা মেয়ের নাম প্রকাশ করে দিয়েছিলেন। আশাদেবী বলেছিলেন, কেন মেয়ের নাম লুকিয়ে রাখব? আমার মেয়ে কি অপরাধ করেছে? দেশের আইনে ধর্ষণ-কাণ্ডে নির্যাতিতাদের নাম প্রকাশ করা যায় না। দেশ তাঁকে এখনও ‘নির্ভয়া’ নামেই চেনে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Crime Rape Nirbhaya Case Murder
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE