আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকস্তরে পড়াশোনা করেছি, সেখানে সব রকম সামাজিক-রাজনৈতিক উথালপাথালই ক্যাম্পাসের চিন্তা চেতনা ও সন্দর্ভে ছাপ রেখেছে। তবু দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতায় ক্যাম্পাসের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীরা এ দৃশ্য দেখেননি, যেখান ‘ভারতমাতা কী জয়’ বলতে বলতে উন্মত্ত কিছু ছাত্র তাণ্ডব চালাচ্ছে ছাত্র ইউনিয়নের সভায়। ‘দেশদ্রোহী’ বলে চিহ্নিত করে হুমকি দিচ্ছে নির্বাচিত ছাত্রপ্রতিনিধিদের। হুমকি দিচ্ছে ইউনিয়ন অফিস আর হস্টেল আক্রমণের। হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানের গা-জোয়ারিতে সাধারণ সভায় হুকুম করছে, ‘হিন্দি মে বোল্’। তেরঙ্গা পতাকা হাতে ‘বন্দে মাতরম’ আর ‘ভারতমাতার জয়’ স্লোগান দিতে দিতে তাণ্ডব আর ভাঙচুর চালাচ্ছে। ছিঁড়ে ফেলছে তাদের অপছন্দের সমস্ত পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন। মুছে দিচ্ছে তাদের মতের বিরোধী সমস্ত মত। এই ঘটনা ঘটছে এমন একটা দিনে যখন ক্যাম্পাসে উপস্থিত প্রচুর সাংবাদিক, চিত্রগ্রাহক, টিভি ক্যামেরা। এই ছাত্ররা নিজেদের কোনও রাজনৈতিক সংগঠনের পরিচয় না দিয়ে ‘সাধারণ ছাত্র’ বলে পরিচয় দিচ্ছে। অথচ দারুণ তৎপরতায় তাদের সমর্থনে এগিয়ে আসছেন এবিভিপি (পশ্চিমবঙ্গের ক্যাম্পাসে যাদের অস্তিত্ব দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হয়) এবং বিজেপির নেতারা। যাদবপুরের ‘দেশদ্রোহী’দের রাস্তায় ফেলে মারার ঘোষণা করছে। ‘দেশদ্রোহী’দের বিরুদ্ধে মিছিল বের করছে ক্যাম্পাসের তাণ্ডবের পর পরই।
এই ছকটা যাদবপুরে নতুন দৃশ্য হলেও সারা দেশের প্রেক্ষিতে খুব চেনা ছবি। বলা যেতে পারে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ‘দেশদ্রোহী’ ছাত্র খুঁজতে খুঁজতে আইআইটি মাদ্রাজ, পুনের এফটিআইআই, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, অম্বেডকর বিশ্ববিদ্যালয়, হায়দরাবাদ সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি ইত্যাদি ঘুরে এবিভিপির বাহিনী এসে পৌঁছেছে আমাদের দোরগোড়ায়, যাদবপুরের ক্যাম্পাসে। হায়দরাবাদ আর দিল্লির চেনা ছকে আমরা দেখেছি তাণ্ডব-হামলা করা, আর কয়েক জনকে বেছে বেছে ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হল তাদের স্ক্রিপ্টের প্রথম ধাপ। এর পরের ধাপে বিজেপির কোনও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি-নেতা-মন্ত্রীর অভিযোগের চিঠি পৌঁছবে মহামান্য শিক্ষামন্ত্রী স্মৃতি ইরানির দফতরে (যদি তা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হয়)। তার পরের ধাপে মন্ত্রীর দফতর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে ক্রমাগত চাপ দেওয়া চলবে সেই ছাত্রদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। পুলিশে দায়ের হবে অভিযোগ। কখনও চিহ্নিত করা ‘দেশদ্রোহী’দের ক্লাসরুম-হস্টেল থেকে বের করে দিয়ে এবিভিপির মানসিক নির্যাতন চলবে। যার বলি হয়েছে হায়দরাবাদের দলিত-বামপন্থী ছাত্র সংগঠক রোহিত ভেমুলা। আবার কখনও চলবে ‘দেশভক্তি’র ঠিকাদারি নেওয়া কিছু চ্যানেলে প্রাইমটাইম মিডিয়া ট্রায়াল। যেখানে সাংবাদিকতার তো বটেই, সভ্যতা ও সুস্থতার সমস্ত রীতিনীতি অগ্রাহ্য করে চলতে থাকবে চিহ্নিত করা ছাত্রদের নিরবচ্ছিন্ন চরিত্রহনন। ভুয়ো অভিযোগ। অপ্রমাণিত দাবি। জঘন্য সব বিশেষণের প্রয়োগ। হ্যাশট্যাগ। কখনও কোনও ছাত্রকে বলা হবে পাকিস্তানের গুপ্তচর। কখনও সন্ত্রাসবাদী। কোনও প্রমাণের তোয়াক্কা না করেই। যার ফলে দেশের মধ্যে জাগিয়ে তোলা যাবে একটা ‘দেশভক্তি’র হুজুগে উন্মাদনা। যেখানে ‘গণশত্রু’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হবে এবিভিপির চিহ্নিত করা সেই ছাত্রদের।
আরও পড়ুন:
আজাদির ডাক ছাত্রসমাজ থেকেই বা আসছে কেন?
কেউ ভাবতে পারেন এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু আমার তা মনে হয় না। কেন এবিভিপি-বিজেপি বার বার ক্যাম্পাসে বিরোধী মতকে চুপ করিয়ে দিতে চেয়েছে? কেন অন্য মতের বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ভাবে তর্ক-বিতর্ক নয়, বরং হিংসা ও পুলিশি-প্রশাসনিক চাপের সাহায্য নিয়েছে? এটা বুঝতে গেলে বোঝা দরকার যে এবিভিপির মানসিকতা এবং কর্মপদ্ধতির সাথে ‘সংঘ পরিবারের’ সরাসরি সদস্য বা তার ভাবধারায় অনুপ্রাণিত বহু সংগঠনের বিস্তর মিল রয়েছে। যা তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের সাথেও নিবিড় ভাবে যুক্ত। শিক্ষা বা জ্ঞানচর্চা নিয়ে তাদের মানসিকতার মূলে রয়েছে দু’টি দিক। একটি দিক হল জ্ঞানচর্চার উপাদান হিসেবে যুক্তি, প্রত্যক্ষ প্রমাণ, বিজ্ঞানমনন (scientific temper), মুক্তচিন্তা— সমস্ত কিছুকেই অস্বীকার করে চলা। দ্বিতীয় দিকটি হল শিক্ষার বেসরকারিকরণ করে শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি দায়দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলার প্রক্রিয়াকে ত্বরাণ্বিত করার দিকে তাদের ঝোঁক। অতি সাম্প্রতিককালে শিক্ষাক্ষেত্রে ডব্লিউটিও-গ্যাট চুক্তিকে ঘিরে এবং গবেষণাক্ষেত্রে নন-নেট ফেলোশিপ তুলে নেওয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষানীতি ছাত্রসমাজের প্রবল সংগঠিত প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে। যার নেতৃত্ব দিয়েছেন বর্তমানে ‘দেশদ্রোহী’ বলে চিহ্নিত ক্যাম্পাসগুলির প্রতিবাদী ছাত্র-সংগঠকেরা, যাদের মধ্যে কানহাইয়া কুমার, ওমর খালিদ, রোহিত ভেমুলাও শামিল। জন্ম নিয়েছে ‘ডব্লিউটিও গো ব্যাক’ এবং ‘অকুপাই ইউজিসি’ আন্দোলন, যা দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বহু ক্যাম্পাসে। এ-ও আর এক চক্ষুশূলের কারণ।
এ বারে এই সামগ্রিক প্রেক্ষিত মাথায় রেখে আসা যাক বর্তমান প্রসঙ্গটিতে। প্রথমেই মোদ্দা কথাটা বলে রাখা ভাল যে কাশ্মীরের আজাদির স্লোগান বা আফজল গুরুর ফাঁসির বিরোধী অবস্থান নতুন কিছু নয়। ‘আজাদি’ অত্যন্ত পুরনো একটি স্লোগান। কাশ্মীরের জনগণ বিগত কয়েক দশক ধরে এই স্লোগান দিয়েছেন তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে। সেই দাবি কোনও ভুঁইফোড় দাবি বা পাকিস্তানের চক্রান্ত নয়। রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রস্তাবে কাশ্মীরের আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রসঙ্গটি দীর্ঘ দিন ধরে উত্থাপিত। কাশ্মীরে ভারত রাষ্ট্রের নিপীড়নের অসংখ্য নমুনা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে বহু আলোচিত বিষয়।
আফজল গুরুর ফাঁসির তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্যে থাকা গলদগুলি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে এবং সুপ্রিম কোর্টের রায়ের একটি অত্যন্ত বিতর্কিত কথা (যেখানে বলা হচ্ছে জাতির সামগ্রিক চেতনাকে শান্ত রাখতে এই ফাঁসি দেওয়া জরুরি) নিয়ে অসংখ্য লেখা প্রকাশিত হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি থেকে শুরু করে বিশিষ্ট আইনজীবীরা সেই বিতর্কে অংশ নিয়েছেন। সমাজকর্মী আর লেখকরা সেই বিতর্কে সামিল হয়েছেন। কোর্টের রায়কে পড়া ও তাকে প্রশ্ন করার অধিকার দেশের সংবিধান আমাদের দিয়েছে। এতে আদালতের অবমাননা হয় না। বরং গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রয়োগ হয়। ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের ফাঁসির রায়ের বিরোধিতা করে সম্প্রতি নতুন গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। সেই মামলা নতুন করে খোলার দাবিও কেউ কেউ করেছেন। তা হলে কেউ যদি যুক্তি বা তথ্যের ভিত্তিতে আফজল গুরুর ফাঁসির রায় নিয়ে কথা বলেন, আর কেউ যদি তার ভিত্তিতে বিশ্বাস করে যে অন্যায় ভাবে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, তা হলে সেই অবস্থান নিয়ে অন্য কেউ বিতর্ক করুন, কিন্তু সেই প্রশ্ন করাকেই ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ বলে মুখ বন্ধ করার চেষ্টা কেন হবে?
এই পুরো ঘটনা আমাদের রামায়ণের এক কাহিনিকে যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে। যেখানে শূদ্র তপস্বী শম্বুককে শুধু তপস্যা করার অপরাধে মর্যাদা পুরুষোত্তম রাম হত্যা করেছিলেন। তিনি কিন্তু রামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেননি। রামরাজ্যের কোনও বিষয়ে হাতও দেননি। শুধু শূদ্র হয়েও তপস্বী হওয়ার মতো ভুল করে ফেলেছিলেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যেখানে তরুণেরা বিতর্ক করে। চলে আসা বিশ্বাসগুলোকে নিজেদের যুক্তি-অভিজ্ঞতা দিয়ে নতুন করে বোঝার চেষ্টা চালায়। পুরনো মত ভাঙে, নতুন মত গড়ে। গবেষণা করে। নতুন নতুন বন্ধুত্ব তৈরি হয়। ভালবাসার মানুষকে খুঁজে নেয়। সেই অজস্র শম্বুকদের গলার ওপর তাদের চিন্তার জন্য, আলোচনার জন্য, ভিন্ন মত রাখার জন্য আঘাত নেমে এসেছে। রোহিত ভেমুলার মৃত্যু হয়েছে এই পর্বেই। আর কত জন রোহিতের মৃত্যুর জন্য, আরও কত জন কানহাইয়ার হাজতবাসের জন্য আমরা অপেক্ষা করে আছি?
শেষ করব একটা সিনেমার কথা বলে। ছবিটি ইরানের পরিচালক বাবাক আনভারির তৈরি ‘টু অ্যান্ড টু’। ছবিতে আমরা দেখি এক কড়া শাসনের স্কুলে এক শিক্ষক ক্লাসে ঢুকে ছাত্রদের বলছেন, দুই আর দুই যোগ করলে পাঁচ হয়। কিছু ছাত্র মানে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও। কিন্তু এক ছাত্র মানে না। সে শিক্ষকের সামনেই অন্যদের বলে দুই আর দুইয়ে হয় চার। অন্য কথা বলা ছাত্রটিকে শিক্ষক এক বার হুমকি দিয়ে দ্বিতীয় চান্সে গুলি করে খুন করে ফেলেন। ছবির শেষে দেখা যায়, শিক্ষক যখন সবাইকে বলছেন দুই আর দুইয়ে যোগ করলে পাঁচ হয়, সেটা খাতায় লিখে নিতে, তখন এক জন ছাত্র তার খাতা আড়াল করে লিখতে থাকে, দুই আর দুইয়ে হয় চার। এই কথা-না-শোনা ছাত্রদের জন্যই জ্ঞানচর্চা সমাজচর্চা বেঁচে থাকবে। আশা করতে ভাল লাগবে এই ছাত্রদের কাছে গুলি চালানো শিক্ষকদের মতো মানুষদের হার হবে। আর তা না হলে তা আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়। আমাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আর গণতন্ত্রের পক্ষেও সুখের কথা নয়। স্বস্তির তো নয়ই!
(লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy