পর্রীকর তাঁর বক্তব্যের দ্বিতীয় ভাগে এটা স্পষ্ট করে দিতে চেয়েছেন, কোনও দেশ যেন ভারতের এই অবস্থানকে দাদাগিরি বলে ধরে না নেয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জানিয়েছেন, শুধু সামরিক প্রভাব নয়, প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সহযোগিতাও অনেক গুণ বাড়াতে চাইছে ভারত। তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রীর সেসেলস ও মরিশাস সফর ওই দেশ দু’টির সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়ানোর পথ সুগম করেছে। ভারত মহাসাগরের দেশগুলির নৌবাহিনীর সঙ্গে আরও বেশি যৌথ মহড়া, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রফতানি বাড়ানো হবে। যাতে এই দেশগুলি ভারত মহাসাগর দিয়ে তেল ও অন্যান্য পণ্য আরও নিরাপদে আনানেওয়া করতে পারে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জানান, সমুদ্র পথে দস্যুবৃত্তি দমনেও ভারত আরও সক্রিয় ভূমিকা নেবে। বিশ্বের দুই তৃতীয়াংশ তেল এই মহাসাগর দিয়েই যাতায়াত করে। ভারতের জ্বালানির প্রায় পুরোটা এই পথেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছয়। ফলে এই অঞ্চলে নয়াদিল্লি আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে চায়। আডেন উপসাগরে ভারত-সহ বিভিন্ন দেশের নৌবাহিনীর কড়া প্রতিরোধের মুখে পড়ে সোমালিয়ার জলদস্যুরা ইদানীং ভারতের দিকে ৪০ নটিক্যাল মাইল সরে এসে উৎপাত শুরু করেছে। যা নিয়ে এখন থেকেই তৎপর হচ্ছে নৌবাহিনী। ভারত মহাসাগরে ভারতের প্রভাব বাড়ানোর অন্য দিকও রয়েছে। তাতে চিনের জ্বালানি আমদানির উপরেও নজরদারির সুযোগ তৈরি হবে। অতীতে চিনের বাগড়ায় চিন উপসাগরে তেল সন্ধান ও উত্তোলনের বরাত হাতছাড়া হয়েছে ভারতের। ভারত মহাসাগরে তাই চিনকে জমি ছাড়তে নারাজ নয়াদিল্লি।
সম্মেলনে উপস্থিত প্রতিনিধিরা মানছেন, মহাসাগরীয় এলাকায় ভারতের এই সক্রিয় বিদেশ ও সামরিক নীতি আগের জমানায় দেখা যায়নি। মনমোহন জমানায় ভারত মহাসাগরে চিনের প্রবেশ ও মার্কিন নৌবহরের আনাগোনা নিয়ে কখনও প্রকাশ্যে কিছু বলা হয়নি। নরম বিদেশ নীতির কারণেই চিনের ডুবোজাহাজ ভারত উপকূলে টানা নজরদারি চালিয়ে শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দরে বিশ্রাম নিয়েছে। সে দেশে বন্দর নির্মাণেও হাত দিয়েছিল চিনা সংস্থা। এই পরিস্থিতি বদলাতে তৎপর মোদী। তাঁর শ্রীলঙ্কা সফরের আগেই ওই বন্দর প্রকল্প স্থগিত করে দিয়েছে শ্রীলঙ্কা সরকার। সম্মেলনে উপস্থিত এক প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ জানাচ্ছেন, ভবিষ্যতে চিনা ডুবোজাহাজ কলম্বো বন্দরে নোঙর করতে দেওয়া হবে না, এই মর্মে প্রতিশ্রুতিও আদায় করেছে নয়াদিল্লি। এবং মোদী সরকারের এই প্রো-অ্যাক্টিভ প্রক্রিয়া যে এ বার থেকে নিরন্তর চলবে, তা-ও এ দিন উল্লেখ করেছেন বিদেশ মন্ত্রকের এক কর্তা।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জানিয়েছেন, ‘পুবে তাকাও’ নীতি অনুসরণ করে ১০ বছর পর ফের আন্তর্জাতিক নৌ-মহড়ার আয়োজন করা হচ্ছে বিশাখাপত্তনমে। বিশ্বের সব শক্তিশালী নৌবাহিনীকে নৌবহর নিয়ে আসার আমন্ত্রণ জানানো হবে। চিন কি ডাক পাবে তাতে? উত্তর এড়াতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শুধু বলেছেন, “এখনও আমন্ত্রণপত্র বিলি শুরু হয়নি।” এই সম্মেলন থেকে জারি করা হয়েছে একটি ঘোষণাপত্র। সমুদ্রপথে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের প্রসঙ্গে বেজিং সিল্ক রুটের তত্ত্বকে সামনে রাখে। সেই তত্ত্ব খারিজ করে ভুবনেশ্বর ঘোষণাপত্রে তুলে ধরা হয়েছে ভারতের কটন রুটের ইতিহাস। এক সময় মৌসুমি বায়ুতে পাল তুলে যে পথে যেত ভারতের তুলো তথা সুতি কাপড়, সেই পথের যত দেশ, তাদের আবার কাছে পেতে চায় ভারত। বাণিজ্যে তো বটেই। তার সঙ্গে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর স্বপ্ন, “একসঙ্গে ৩০-৪০টি যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে আমরাও দাপিয়ে বেড়াতে চাই মহাসাগরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত।”
চিনের সঙ্গে বৈঠক আজ
প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলএসি) নিয়ে মতপার্থক্য মেটাতে হবে শান্তিপূর্ণ ভাবেই। এবং এ ব্যাপারে চিনের চোখরাঙানি বরদাস্ত করা হবে না। নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর এই প্রথম বার বিশেষ সীমান্ত আলোচনায় বসতে চলেছে ভারত ও চিন। রাজনৈতিক সূত্রের খবর, আগামী কালের ওই বৈঠকে লাদাখ সেক্টরে চিনা সেনার ধারাবাহিক অনুুপ্রবেশ নিয়ে এমনই কড়া অবস্থান নিতে চলেছে সাউথ ব্লক। আজই শহরে এসে পৌঁছেছেন চিনের বিশেষ প্রতিনিধি ইয়াং শিয়েচি। আগামী কাল ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের সঙ্গে সীমান্ত বিষয়ক বৈঠকের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করবেন তিনি। এর আগে দুই দেশের মধ্যে বিশেষ প্রতিনিধি পর্যায়ে ১৭ দফা বৈঠক হয়ে গেলেও সুফল মেলেনি। কূটনীতিকদের একাংশের আশা, নতুন সরকার আসার পর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে যে ইতিবাচক অভিমুখ তৈরি হয়েছে, তার প্রতিফলন এ বার নিশ্চিত দেখা যাবে সীমান্ত সমস্যা সমাধানে।