Advertisement
E-Paper

কাব্যগ্রন্থে মিশে উজ্জ্বল অতীত

‘আমি কবিতা-টবিতা বুঝি না’ কথাটা অনেকটা ‘আমার ছেলে তো বাংলা পড়তে পারে না’-র মতো। ছেলে বড় সাহেবি স্কুলে পড়ে, সেটা জানান দিতে না হয় গর্বিত মা-বাবার এমন বলা।

অমিত সিকিদার

শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:১১

‘আমি কবিতা-টবিতা বুঝি না’ কথাটা অনেকটা ‘আমার ছেলে তো বাংলা পড়তে পারে না’-র মতো।

ছেলে বড় সাহেবি স্কুলে পড়ে, সেটা জানান দিতে না হয় গর্বিত মা-বাবার এমন বলা। এরই মধ্যে শ্রীমান কতটা সাহেব হয়ে উঠেছে, সেটাও বিজ্ঞাপিত করা যায়! কিন্তু ‘কবিতা-টবিতা আমি ঠিক বুঝি না’ বা ‘কম বুঝি’ বলার মধ্যে কী মানসিকতা যে কাজ করে তা আজও আমার বোঝা হলো না! তবে হ্যাঁ, অঙ্ক, পদার্থবিদ্যা, রসায়নের রস গলে যাওয়া, উপগ্রহ-যান, শেয়ার বাজারের হিসেব আমার তেমন ভাবে বোঝা হয় না। ক্যালকুলাসের মতো জটিল, সলিড জিওমেট্রির মতো কুটিল গদ্য বা পদ্য যে সব সময় বুঝি, তাও হলফ করে বলতে পারব না।

সব জিজ্ঞাসার উত্তরই বুঝি রবীন্দ্রনাথে আছে! কবিতা বোঝার ব্যাপার নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ২১ শ্রাবণ ১৩৪৪ বঙ্গাব্দে প্রমথনাথ বিশীকে লিখেছেন ‘কবিতা লিখেছি বলেই যে তার মানে সম্পূর্ণ বুঝেছি এমন মনে করবার কোন হেতু নেই। মন থেকে কথাগুলো যখন উৎসারিত হচ্ছিল, তখন নিশ্চয়ই এর মধ্যে একটা মানের ইঙ্গিত প্রচ্ছন্ন ছিল। সেই অন্তর্যামী কাজ সারা হতেই দৌড় দিয়েছে। এখন বাইরে থেকে আমকে মানে বের করতে হবে, সেই বাইরের দেউড়িতে যেমন আমি আছি, তেমন তুমিও আছ এবং আরও দশজন আছে, তাঁদের মধ্যে মতান্তর নিয়ে সর্বদা হট্টগোল বেঁধে যায়। সেই গোলমালের মধ্যে আমার ব্যাখ্যাটি যোগ করে দিচ্ছি, যদি সন্তোষজনক না মনে করো, তোমার বুদ্ধি খাটাও, আমার আপত্তি করবার অধিকার আছে।’

রবীন্দ্রনাথের এই উক্তি পড়ে কবিতা-টবিতা যাঁরা বোঝেন না, এবং এই যে আমি বোঝার দাবি করে লিখতে বসেছি, দু-পক্ষেরই সুবিধা হলো। তাই বাকি কথা লিখতে গিয়ে ভুল হলে কোনও ভয় নেই, কারণ কবি তাঁর অধিকার প্রয়োগ নিশ্চয়ই করবেন। তবে হ্যাঁ প্রেমাংশু পালচৌধুরীর ‘ছায়া বিকেল কুয়াশা ভোর’ কাব্যগ্রন্থের অনেকগুলি, বলা চলে প্রায় সবগুলি কবিতা বোঝা গেল। কারণ পড়তে পড়তে মনে হল এগুলি তো আমারও কথা। আমার অনুভবে যা আছে তা কেমন করে অন্যের কলমের টানে উজ্জ্বল হয়ে উঠল! প্রাথমিক আচ্ছন্নতা কাটিয়ে বুঝলাম, যখন অন্য কারও গদ্য-পদ্য পড়তে পড়তে নিজের স্মৃতি-সত্ত্বা-ভবিষ্যৎকে খুঁজে পাওয়া যায়, তখনই তো তা আপন হয়ে ওঠে।

‘ছায়া বিকেল কুয়াশা ভোর’ পড়তে পড়তে এই প্রৌঢ়ত্বে এসে যখন নিজের বাল্য-কৈশোর-যৌবন, মা-বাবা, শৈশব-বাল্যের খেলার সাথী, কর্ম এবং অপকর্মের সঙ্গীদের কথা এবং অবশ্যই সেই তার এবং তাদের কথা সেলুলয়েডের মতো পরপর ভেসে ওঠে, তখন ছেড়ে আসা পৃষ্ঠাগুলিতে আবারও চোখ বোলাতে ইচ্ছে করে। হঠাৎ যেন চোখের পাতা ভারী হয়ে ওঠে।

জীবনযুদ্ধে লড়তে লড়তে এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ এমন সব রচনা হাতে এসে পড়ে, যখন আমরা নিজের জীবনটাকে এক বার ফিরে দেখার সুযোগ পাই। ব্যক্তিগত ভাবে আবৃত্তির প্রতি একটা বিশেষ টান থাকায় কবিতার বই হাতে পড়লে স্বভাবত চোখ খুঁজতে থাকে আবৃত্তিযোগ্য কবিতা। প্রেমাংশুর ‘ছায়া বিকেল কুয়াশা ভোর’ পড়তে গিয়ে যখন সেই খোঁজ কাজ করছিল তখন পাতার পর পাতা উল্টাতে গিয়ে মন বিপুল ভাবে আলোড়িত হল। প্রথমেই ‘ধুলো-খেলা’। মাতৃ-পিতৃহারাদের চিরকালীন হাহাকার সে তো একা প্রেমাংশুর নয়। বিশেষ করে আকাশে-বাতাসে যখন উৎসবের মেজাজ তখন তো সব মাতৃ-পিতৃহারাদের জিজ্ঞাসা— ‘মা, তুমি ভালো আছো? /জানি, বুঝি তবুও সীমানা ছাড়িয়ে/বলতে ইচ্ছে হয়...তুমি ভালো আছো? আর বাবা?’

এমনই আরেকটি কবিতা ‘নবমী’। ‘শরত একই ভাবে মোহময়/বয়ে নিয়ে আসে বাবার পাঞ্জাবির/স্বর্গীয় গন্ধ।/নবমীর দিন মাকে পুজোর নতুন/কাপড়ে মুড়ে তুলেছি চিতায়/মা, তুমি এসো প্রতিবছর।/ফিরে ফিরে এসো...’

‘গল্পকথা’ আর ‘পাগল ছেলেটা’-র হাত ধরে ফিরে আসে শৈশব আর বাল্যের মন খারাপ করা সুখস্মৃতি। ‘ডাকবাক্স’, ‘রবীন্দ্রনাথ তোমাকে’ নিয়ে কল্পনার জগতে পদচারণা। ‘জীবনের কত কথা বাকি রয়ে যায়।/কেনও একদিন বলার প্রতিশ্রুতি আছে।’ আরও একটা মন-কাড়া ‘গোলাপি চিঠি’। কুয়াশার ভোর-এ দিগন্তের পথে হেঁটে যাওয়ার বাসনা –এ ইচ্ছা তো কোনও দিনই শেষ হওয়ার নয়। জীবনের রথ এগিয়ে চলে। আর পাঠক একবার ফিরে দেখার সুযোগ পাবেন বালক-কিশোর-যৌবনবেলার ব্যথাবেদনা-আনন্দ জয়-পরাজয়ের কথা।

historic past literature
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy