Advertisement
০৬ মে ২০২৪

পুজোর থিমে পাড়া দক্ষিণ বিলপারে

থিমের পুজো তাঁরা অনেক বার করেছেন। মণ্ডপ-প্রতিমায় সেই ভাবনা ফুটিয়ে তোলাই লক্ষ্য ছিল তখন। এ বারও পুজো প্রস্তুতি তুঙ্গে দক্ষিণ বিলপার সর্বজনীন দুর্গাপূজা কমিটিতে। তবে অন্যান্য বছরের চেয়ে ফারাক হল, মণ্ডপ-প্রতিমায় সেই থিম তুলে আনার কথা ভাবছেন না উদ্যোক্তারা। তা হলে?

উত্তম সাহা
শিলচর শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:৪১
Share: Save:

থিমের পুজো তাঁরা অনেক বার করেছেন। মণ্ডপ-প্রতিমায় সেই ভাবনা ফুটিয়ে তোলাই লক্ষ্য ছিল তখন। এ বারও পুজো প্রস্তুতি তুঙ্গে দক্ষিণ বিলপার সর্বজনীন দুর্গাপূজা কমিটিতে। তবে অন্যান্য বছরের চেয়ে ফারাক হল, মণ্ডপ-প্রতিমায় সেই থিম তুলে আনার কথা ভাবছেন না উদ্যোক্তারা। তা হলে?

পুজো কমিটির সভাপতি বিমল খান ও সম্পাদক তমাল চক্রবর্তী জানান, সম্পর্ক বৃদ্ধি ও সকলের অংশগ্রহণই এ বার তাঁদের বিশেষ ভাবনা। সেই লক্ষ্যে কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে।

বিমলবাবু বলেন, ‘‘পাবলিক স্কুল রোডের ডানে-বামে ১০টি গলির বাসিন্দাদের নিয়ে আমাদের পুজো। অন্তত ৫০০টি পরিবার। কিন্তু অধিকাংশই চাঁদা দেওয়ার বাইরে আর কোনও ভাবে পূজার সঙ্গে যুক্ত হন না। তাতে দুর্গোৎসবের যে মুখ্য উদ্দেশ্য, তা সাধিত হয় না। ফলে মানুষে মানুষে সম্পর্ক বাড়ানো চাই, সে লক্ষ্যেই গত রবিবার ঢাক বাজিয়ে পুরো পাড়া পরিক্রমা করা হয়। পুজো আসছে, নিজেদের পুজো— সে কথা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। বাড়ি বাড়ি থেকে ডেকে এলাকার বাসিন্দাদের মিছিলে সামিল করা হয়। পর দিন প্রবীণ সংবর্ধনা। সত্তরের কাছাকাছি বা তদূর্ধ্বদের আমন্ত্রণ জানিয়ে পুজো কমিটির পক্ষ থেকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। সকলের হাতে তুলে দেওয়া হয় প্রয়াত কুমুদিনী রায় (সুভাষিনী) স্মৃতি সম্মাননা। পুজো-অঞ্চলের ৯১ জন প্রবীণ নাগরিক উপস্থিত হয়ে স্মৃতিচারণ করেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মহিলা মহাবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষা পরিমল দে, রামানুজ গুপ্ত জুনিয়র কলেজের ডিরেক্টর শ্রীমন্ত দত্ত, পূর্ণেন্দু ভট্টাচার্য, সখারঞ্জন রায়, শান্তনু ধর, ভবরঞ্জন সাহা। পুরনো দিনের কথা মনোযোগ সহ শুনছিলেন পুজো আয়োজকরা। তমাল চক্রবর্তী, সুব্রত রায়, বিভাস রায় বলেন— ‘‘আমাদের পুজো আসলে সংবর্ধনার মধ্যে দিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছে। তাঁদের উপস্থিতিতেই সে দিন মণ্ডপের ঈশান কোণে খুঁটি পোঁতা হয়।’’

দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা পাবলিক স্কুল রোডের পুজো দেখতে যান, এই দৃশ্য অনেক দিনের। তাঁদের কাছে মণ্ডপ-প্রতিমা-আলোক সজ্জা নিয়ে বিরাট প্রত্যাশা এই অঞ্চলের মানুষের। সে কথা ভেবেই কুশাসনের মণ্ডপ হচ্ছে এ বার। কাল্পনিক কাঠামো হলেও কল্পনায় যে তাঁরা অনেকটা এগিয়ে, তার প্রমাণ দিতে সচেষ্ট করিমগঞ্জের শিল্পী লিটন রায়। প্রতিমা-আলোতেও তাঁদের যথেষ্ট খ্যাতি। আধুনিক প্রতিমা গড়ছেন নদীয়ার সুখদেব পাল। আলোয় গোটা তল্লাট সাজিয়ে তুলবেন গোপাল দাস। ১৫ লক্ষ টাকার বাজেট ধরে এগোচ্ছে বিমল খান, তমাল চক্রবর্তী, জয়ন্তকিশোর দাসের পুজো কমিটি।

তাঁদের পরিকল্পনায় বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে, কী ভাবে এলাকার কত বেশি মানুষকে পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া যায়। সেই লক্ষ্যে মহালয়ার দিনে মূল রাস্তা-মুখ থেকে মণ্ডপ পর্যন্ত আলপনা তৈরির সিদ্ধান্ত তাঁদের। এলাকার বিভিন্ন বয়সের মহিলাদের তাতে সামিল করা হবে। চতুর্থী বা পঞ্চমীর দিনের মণ্ডপের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হবে। সে দিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নাচবেন-গাইবেন পাড়ার শিল্পীরা। ষষ্ঠীর প্রভাতে হবে আগমনী—প্রতিযোগিতামূলক গ্রুপ ড্যান্সের অনুষ্ঠান। দশমীর দিন সিঁদুরখেলার মধ্যে দিয়ে পারস্পরিক ভাব-বিনিময়ের জন্য তাঁরা চাইছেন সময় বেঁধে দিতে। তাতে অনেক বেশি মা-বোনের দেখা হবে মণ্ডপে। লক্ষ্মীপূজার পরে অন্য বছরের মতোই হবে শারদ সম্মেলন। গান-বাজনা-নাটক। সুব্রতবাবু বলেন, ‘‘নাটকে এই এলাকা শুরু থেকেই এগিয়ে। পুজোয় নাটক করতে করতেই এখানে জন্ম হয়েছে গণসুর-এর।’’

আর তাই পুজোর ইতিহাস জানতে চাইলে তিনঘণ্টার আড্ডা বসে যায় সত্তর বছরের সচ্চিত দত্তের বাড়িতে। একই বয়সের অনুপ চৌধুরী, অমরেন্দ্র রায়ের সঙ্গে আলোচনা জুড়েন ৭৪-র ঋষিকেশ ভট্টাচার্য ও সখারঞ্জন রায়। যোগ দেন ৬৫-র গোরা রায়ও। নীরব উপস্থিতি ছিল বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া, এই বছরের সম্পাদক তমাল চক্রবর্তীর। সে আড্ডায় পুজোর কথা যেমন আসে, আসে নাটকের কথাও। কোন চরিত্রে কবে কে অভিনয় করেছিলেন, বলতে বলতে নস্টালজিয়ায় ডুবে যান তাঁরা।

পুজো আর নাটকের কথা একসঙ্গে চলতে থাকে। সখাবাবু বলেন, ‘‘১৯৫৪ সালে এসেছি এই গ্রামে। পুরো এলাকা জুড়ে হাতেগোনা বাড়িঘর। অধিকাংশ জায়গা ছিল ধানের জমি। এখন যেখানে লক্ষ্মীনারায়ণ বিবাহ বাসর, সে জায়গাটি ফাঁকা পড়ে ছিল। ১৯৫৫ সালে পাড়ায় সরস্বতী পূজা চালু হয়। সেখানেই পুজো হয়েছিল অনেক বছর।’’ সতু রায়, মন্মথ দাস, বিমলেন্দু চৌধুরী, নকুল সাহা, অমূল্যকুমার দাস ছিলেন প্রধান উদ্যোক্তা। মূল উপদেষ্টা অধ্যাপক দীনেশ দত্ত। গুরুচরণ কলেজে পড়াতেন তিনি। তিন অধ্যাপক ছিলেন একই লেনে। তাই এর নাম হয়ে যায় ‘প্রফেসার লেন’। ঋষিকেশবাবু, অনুপবাবুরা যোগ করেন সরস্বতী প্রতিমা নিয়ে পুজোর পর দিনের শোভাযাত্রা ও জমায়েতের কথা। সমস্ত পাড়ার প্রতিমা ও স্কুলের প্রতিমা আদালত প্রাঙ্গণে নিয়ে যাওয়া হতো। পরে রাঙ্গিরখাড়ি পর্যন্ত একযোগে শোভাযাত্রা হতো।

সরস্বতী পূজা থেকেই আসে দুর্গাপূজার ভাবনা। বলতে থাকেন সখাবাবু, ‘‘প্রচুর চাঁদা উঠত সরস্বতী পূজায়। দেখা যায় শোভাযাত্রার পরও বহু টাকা বেঁচে যায়। কথা উঠল, তা হলে দুর্গাপূজায়ও সমস্যা হবে না।’’ সাহস জোগান অধ্যাপক দীনেশ দত্ত। ঠিক কবে প্রথম পূজা শুরু হয়েছিল, তা নিয়ে একবাক্যে সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায়নি। কেউ বলেন, ১৯৫৬ সালে প্রথম দুর্গাপূজা হয় পাবলিক স্কুল নামে পরিচিত দক্ষিণ বিলপারে। কেউ বলেন ১৯৫৭। দুয়েকজন আরও এক বছর পর থেকে গণনার পক্ষে। তবে সব মিলিয়ে, ১৯৫৬ সালকেই সূচনাবর্ষ ধরে নেয় পূজা কমিটি। প্রথম দিকের দুর্গোৎসব আয়োজকদের অন্যতম ছিলেন জিতেন্দ্র (মঞ্জু) পুরকায়স্থ, মহেশ নারায়ণ দাস, বিনোদবিহারী দে, সত্যেন্দু রায়, অমূল্য কুমার দাস, আদিত্য খান, কালীনন্দন কর্মকার, মন্মথ দাস, মনোরঞ্জন দাস, হরিদাস সাহা, সুরেশ রায়, প্রিয়রঞ্জন রায়, ফণী দে, বিজয় রায়, অমিয় দাস, শিবেন্দ্র চক্রবর্তী, নকুল সাহা, প্রাণতোষ রায়, দেবেশ রায়, সতু রায়, সুজিত দত্ত। অধিকাংশই এখন আর বেঁচে নেই।

পুজোস্থল নিয়ে আজও আক্ষেপ যায়নি এলাকার প্রবীণ নাগরিকদের। ঋষিকেশবাবু জানান, প্রথম পুজো হতো মধুভবন লেনে। তখন বলা হতো ভীম পালের মাঠ। পরে এর উল্টোদিকে জমিদার রজনী সাহার জায়গায়। কিন্তু পুজোর জন্য জমিটুকু চাইতেই ফল হয় উল্টো। দ্রুত ঘর বানিয়ে ফেলেন সেখানে। পরে ১৯৬৯ সালে পুজোর জন্য পাবলিক স্কুলের সামনের জায়গাটিকে বেছে নেওয়া হয়।

শুরুর দিকে এক চালার মূর্তি। মণ্ডপ বলতে টিনের চাল। ফুলচুরির জন্য ৫-৭ জন মণ্ডপে রাত জাগতেন। হ্যাজাক লাইটেই আলোর ব্যবস্থা হতো। সাজিয়ে তোলার প্রাথমিক ব্যাপার আসে ১৯৭১ সালে। অনুপ চৌধুরী জানান, সে বার তিনি কলকাতায়। পুজো সম্পাদক ছিলেন বিজয় খান। বড় পূজা হবে বলে চাঁদা চেয়ে চিঠি পাঠান তাঁর কাছে। মানি অর্ডারে তিনি ১০ টাকা পাঠিয়েছিলেন।

তবে দক্ষিণ বিলপার পূজা কমিটির প্রতিযোগিতামূলক ভাবনা আসে ১৯৮৩ সালে। সে দিনের কথা টেনে বর্তমান সভাপতি বিমলবাবু জানান, ১৯৮২ সালে পুজোর পুরস্কার চালু হয়। সে বার প্রথম পল্লী ক্লাব প্রথম হয়। জেদ চাপে সকলের। পরের বছরই প্রথম পুরস্কার। এর পর কত বার কত পুরস্কার যে মিলেছে, তার হিসেব নেই।

দশমীর পরে নাটক হতো। পাড়ার মানুষই তাতে অভিনয় করতেন। সিরাজউদ্দোল্লা, সীতার পাতাল প্রবেশের কথা আজও আলোচনা করেন পাড়ার প্রবীণরা। তাঁরা জানান, বিশেষ উদ্যোগী হতেন মহীতোষ রায়, কল্যাণ ভট্টাচার্য, চিত্তরঞ্জন রায়।

দুর্গোৎসব বা এ উপলক্ষে নাটক— আগের পূজায় অনেক বেশি আনন্দ হতো। সবাই সক্রিয় ছিলেন এলাকার পূজায়। তাই মা-বাবা পুজোর কাজে আপত্তি করতেন না। এখন ঘরে ঘরে আপত্তি। সচ্চিত দত্ত, অমরেন্দ্র রায়দের এই আক্ষেপের জায়গাটা এ বার ঠিক ধরে ফেলেছেন পুজো আয়োজকরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

north bengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE