Advertisement
২১ মার্চ ২০২৩
Tripura

সন্ত্রাসের স্মৃতি, দারিদ্রের যুদ্ধ আর সাগিনা মাহাতো

নির্বাচনী সংগ্রাম দেখতে এসে ব্যক্তিমানুষের জীবন সংগ্রামের আখ্যানও এ ভাবে মন টানে!

শালখলা ইন্ডাস্ট্রি এলাকায় এস বি স্কুলের পড়ুয়ারা।—নিজস্ব চিত্র।

শালখলা ইন্ডাস্ট্রি এলাকায় এস বি স্কুলের পড়ুয়ারা।—নিজস্ব চিত্র।

তাপস সিংহ
সিমনা (পশ্চিম ত্রিপুরা) শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১২:৩৯
Share: Save:

সিমনাছড়া চা বাগানে দাঁড়িয়ে কেন জানি না সাগিনা মাহাতোর কথা মনে এল!

Advertisement

চা বাগানের সেই লড়াকু শ্রমিক সাগিনার নাম পশ্চিম ত্রিপুরা জেলার এই প্রত্যন্ত এলাকায় দাঁড়িয়ে মনে আসার কথা নয়। কিন্তু, মনের গতি বিচিত্র! চা বাগানের মাঝখান দিয়ে যে রাস্তাটা সীমন্ত-রেখার মতো চলে গিয়েছে, ভরদুপুরে সেখানে দাঁড়িয়ে মনে হল, এখন আর চা বাগানের শ্রমিকদের জন্য কোনও সাগিনা মাহাতো নেই। নিজেদের লড়াই নিজেদেরই লড়তে হয় তাঁদের।

এই যেমন সিমনাছড়া বাগানের শ্রমিক বস্তির দুলাল সাঁওতাল। বাড়ির দাওয়ায় দাঁড়িয়ে বড় চমৎকার হাসেন মাঝবয়সী এই মানুষটি। বাড়িতে স্ত্রী ছাড়াও তিনটি সন্তান। দু’টি ছেলে, একটি মেয়ে। বয়স ৫, ৭ ও ১০। তাদের পড়াচ্ছেন দুলাল। বাগানেরই স্কুলে। ক্লাস এইট অবধি সেখানে পড়ে তারা যাবে দূরের কাতলামারা হাইস্কুলে। জীবন চলে তার নিজের গতিতে। চা বাগানের এই শ্রমিকের বেতনও বাড়ে তার নিজের গতিতে। বছর দেড়েক আগে বাগানের এই শ্রমিক পেতেন দৈনিক ৯৫ টাকা করে মজুরি। সে মজুরি এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৫ টাকায়!

কিন্তু, এত কিছুর পরেও রাজ্য ভাগ চান না এই চা বাগান শ্রমিক। তিনি বলছেন, ‘‘এতে কারও ভাল হবে না। না বাঙালিদের, না উপজাতিদের। তার থেকে উপজাতি এলাকার উন্নয়নে আরও কাজ করুক সরকার।’’

Advertisement

আরও পড়ুন
প্রচারে গেরুয়া ঝড়, প্রদীপ আগলাতে মরিয়া মানিক

নির্বাচনী সংগ্রাম দেখতে এসে ব্যক্তিমানুষের জীবন সংগ্রামের আখ্যানও এ ভাবে মন টানে!

এর কিছু ক্ষণ আগেই দেখা হয়েছিল সিমনা (সংরক্ষিত) কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী প্রণব দেববর্মার সঙ্গে। দলের রাজ্য কমিটির সদস্য প্রণব টানা পাঁচ বার এই কেন্দ্র থেকেই বিধায়ক হয়েছেন। এ বার ষষ্ঠ দফা। পঞ্চম বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভায় তিনি মন্ত্রীও ছিলেন। শালখলা ইন্ডাস্ট্রি এলাকায় এস বি স্কুলের মাঠে একেবারে স্থানীয় স্তরে জনসভার আয়োজন করেছে তাঁর দল। একেবারে শেষের ক’দিন ছোট ছোট সভা আর বাড়ি বাড়ি ঘুরে প্রচারের উপরেই জোর দিচ্ছেন তাঁরা। কথায় কথায় প্রণব বলেই ফেলেন, ‘‘যে হারে আলাদা রাজ্যের কথা সুকৌশলে উপজাতিদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তা বিপজ্জনক। এক জন উপজাতীয় মানুষ হিসেবে তাঁদের বোঝানোর মধ্যে সূক্ষ্ণ ভারসাম্য রাখতে হয়। খুবই সংবেদনশীল বিষয়।’’

এই সিপিএম নেতাকেই ’৯৮ সালের ডিসেম্বরে অপহরণ করেছিল জঙ্গি সংগঠন টাইগার ফোর্স। নিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের হবিগঞ্জ এলাকায়। সঙ্গে অপহৃত হন তাঁর ব্যক্তিগত দেহরক্ষীও। দেহরক্ষীকে গুলিও করেছিল জঙ্গিরা। তিনি জখম হন। দীর্ঘ ১১ মাস তাঁদের থাকতে হয়েছিল জঙ্গিদের ডেরায়। এর মধ্যে আট মাস পায়ে শেকল পরানো অবস্থায়। প্রতি মুহূর্তে প্রণব দেববর্মার মনে হত, যে কোনও সময় তাঁকে মেরে দিতে পারে জঙ্গিরা। বেশির ভাগ সময় তাঁদের পাহারা দিত পাঁচ থেকে সাত জন জঙ্গি। এক দিন সকালে প্রণব লক্ষ্য করেন, জঙ্গি শিবিরে প্রহরীর সংখ্যা মাত্র দুই। তাদের মধ্যেও এক জন গিয়েছে বহু দূরে জল আনতে। সামনে জলের কোনও উৎস ছিল না। আর এক জন জঙ্গলের কাঠ কাটছে। সে দিন সকালেই পায়ে সর্ষের তেল মেখে রাখেন তিনি ও তাঁর দেহরক্ষী। সর্ষের তেল থাকত ক্যাম্পের রান্নার জন্য। সেই দিন গভীর রাতে প্রহরীদের অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে পায়ের বেড়ি কোনওক্রমে খুলে পালান তাঁরা।

এর পর কী ভাবে গভীর জঙ্গলের পথে পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ পুলিশের হাতে পড়েন তাঁরা, কী ভাবে দু’দেশের কথার পরে ফিরে আসতে পারেন সিপিএমের এই বিধায়ক, সে এক ভিন্ন রোমহর্ষক গল্প।

আরও পড়ুন
‘নীতি থাকলে কি এমন জোট করত বিজেপি?’

প্রণব বলেন, ‘‘দীর্ঘ আড়াই দশক ধরেই তো সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়ছি আমরা। পাঁচ দফা বিধায়ক পদের মধ্যে চার দফাই তো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়েছি। তাই এ বারের চ্যালেঞ্জকেও সে ভাবেই নিচ্ছি।’’ উপজাতীয় মানুষদের মধ্যে গিয়ে গিয়ে সিপিএম নেতৃত্ব বোঝাচ্ছেন, মাত্র ১০ হাজার ৪০০ বর্গ কিলোমিটারের একটা রাজ্য কী ভাবে উপজাতীয়দের জন্য ভাগ হতে পারে, যেখানে গোটা ত্রিপুরা জুড়েই বাঙালি ও উপজাতিরা মিলেমিশে রয়েছেন। কী ভাবে তাঁদের আলাদা করে এক জায়গায় আনা হবে? কেনই বা? ত্রিপুরার জনসংখ্যার ৬৯ শতাংশ বাঙালি ও ৩১ শতাংশ উপজাতি।

সিপিএমের এই সীমান্ত ঘেঁষা শক্ত ঘাঁটিতে আইপিএফটি (ইন্ডিজেনাস পিপল’স ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা) দাঁড় করিয়েছে নবীন আইনজীবী বৃষকেতু দেববর্মাকে। মজার কথা হল, এই বিশ্বকেতুর বাবা রবীন্দ্র দেববর্মা সিপিএমের সক্রিয় কর্মী, তিনি রাজ্য সরকারি কর্মীও ছিলেন। এবং বিশ্বকেতুর শ্বশুরমশাই রঞ্জিৎ দেববর্মা এখন স্বশাসিত জেলা পরিষদের (এডিসি) চেয়ারম্যান। বাড়ির দু’-দু’জন বয়োজ্যেষ্ঠ যে পার্টির এ হেন সক্রিয় কর্মী সেখানে তিনি কেন অন্য শিবিরে? সিমনা বাজারের কাছে দাঁড়িয়ে ক্ষোভ উগরে দেন বিশ্বকেতু। বলেন, ‘‘সিপিএম মিথ্যা কথা বলে। ওরা পাহাড়ে উপজাতিদের কাছে এক কথা বলে আর সমতলে আর এক। ২৫ বছর ধরে উপজাতি এলাকায় ওরা উন্নয়নের কোনও কাজ করেনি। তাই আমি এই দলের হয়ে দাঁড়িয়েছি। মনে রাখবেন, এই সরকারের বিরুদ্ধে বেশির ভাগ জনস্বার্থ মামলাই (পিআইএল) আমার করা।’’ নবীন প্রজন্মের আগ্রাসী শরীরী ভঙ্গি নিয়ে বি‌শ্বকেতু বলেন, ‘‘এই এমএলএ বিধানসভায় স্রেফ চুপ করে থাকেন। এলাকার উন্নয়ন নিয়ে মুখ খোলেন না। বিধানসভা অধিবেশনের প্রশ্নোত্তরের ইতিহাস ঘেঁটে দেখুন, আমার কথার প্রমাণ পাবেন।’’

তা হলে কী হবে এ বার?

আগরতলা শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরের সীমান্ত লাগোয়া এই এলাকা এক কথায় মুখ খোলে না। শুধু সিমনা বাসস্ট্যান্ডের কাছে দাঁড়ানো সব্জিবিক্রেতা যতীন্দ্রনাথ দাস কিংবা চা বাগানের মহিলা শ্রমিক বিনয়মণি সাঁওতালের মতোই বলতে থাকে, ‘‘দেখুন, এ বার কী হয়। বলা খুব কঠিন। তবে যারাই আসুক, এলাকার উন্নতি যেন করে।’’

আরও পড়ুন
ত্রিপুরায় বিজেপি-র এই উত্থান কী ভাবে?

আগরতলা-সিমনা রোড ধরে আসার সময় সার সার রবার গাছের জঙ্গল চোখে পড়ে। সোনাই নদীর কাছে দাঁড়িয়ে স্থানীয় এক যুবক বলছিলেন, ‘‘দেখবেন, জঙ্গলে ঘেরা আমাদের এই মোহনপুর চা বাগান, কালাচরা চা বাগান, বর্ডার এলাকা কত সুন্দর। তবু, কেন যে আজকাল কেমন অন্ধকার লাগে কে জানে!’’

আঁধার নামে। সাগিনা মাহাতো আর ফেরে না!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.