Advertisement
০১ মে ২০২৪

গীতা-ই কেন, গন্ধ কুরুক্ষেত্রের

জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত তো আছেই। জাতীয় ফুল-পশু-পাখিও আছে। এ বার কি জাতীয় গ্রন্থের পালা? প্রশ্নটা আজ উস্কে দিলেন মোদী সরকারের বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। লালকেল্লায় সপ্তাহব্যাপী ‘গীতা মহোৎসবে’র শেষ দিনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সুষমা বললেন, তিন বছর আগেই তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে গীতাকে জাতীয় গ্রন্থের মর্যাদা দেওয়ার দাবি তুলেছিলেন। আনুষ্ঠানিক ভাবে সেটার ঘোষণা এখনও বাকি। কিন্তু সুষমার দাবি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখনই নিজের হাতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে গীতা উপহার দিয়েছেন, তখনই সেই মর্যাদায় উত্তীর্ণ হয়েছে ওই গ্রন্থ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:০৭
Share: Save:

জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত তো আছেই। জাতীয় ফুল-পশু-পাখিও আছে। এ বার কি জাতীয় গ্রন্থের পালা?

প্রশ্নটা আজ উস্কে দিলেন মোদী সরকারের বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। লালকেল্লায় সপ্তাহব্যাপী ‘গীতা মহোৎসবে’র শেষ দিনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সুষমা বললেন, তিন বছর আগেই তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে গীতাকে জাতীয় গ্রন্থের মর্যাদা দেওয়ার দাবি তুলেছিলেন। আনুষ্ঠানিক ভাবে সেটার ঘোষণা এখনও বাকি। কিন্তু সুষমার দাবি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখনই নিজের হাতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে গীতা উপহার দিয়েছেন, তখনই সেই মর্যাদায় উত্তীর্ণ হয়েছে ওই গ্রন্থ। সুষমার কথার সূত্র ধরেই বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা অশোক সিঙ্ঘল দাবি করেছেন, প্রধানমন্ত্রী এ বার সংসদে গীতাকে জাতীয় গ্রন্থ বলে ঘোষণা করুন।

রাজনীতির কুরুক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গেই নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়ে গিয়েছে। গীতাকে জাতীয় গ্রন্থ বলার মধ্য দিয়ে হিন্দুত্ববাদের প্রসার হচ্ছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিমধ্যেই সুর চড়িয়ে বলেছেন, “আমাদের সংবিধান অনুযায়ী, ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। গণতন্ত্রে সংবিধানই পবিত্রতম গ্রন্থ। সব পবিত্র গ্রন্থকেই আমরা শ্রদ্ধা করি। কোরান, পুরাণ, বেদ-বেদান্ত, বাইবেল, ত্রিপিটক, জেন্দ আবেস্তা, গুরু গ্রন্থসাহিব, গীতা সবই আমাদের গর্ব।” কংগ্রেস মুখপাত্র মনীশ তিওয়ারি বিদেশমন্ত্রীকে এক রকম কটাক্ষ করেই বলেছেন, “কেউ যদি সত্যিই মন দিয়ে গীতা পড়ে আত্মস্থ করে থাকেন, তিনি এমন ছেঁদো মন্তব্য করবেন না।” অন্য দিকে অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের সদস্য জাফরইয়াব জিলানির প্রশ্ন, “গীতা নিঃসন্দেহে একটি পবিত্র গ্রন্থ। কিন্তু ভারতের মতো ধর্মনিরপেক্ষ দেশে কেন একটি বিশেষ ধর্মগ্রন্থকে জাতীয় গ্রন্থ হিসেবে ঘোষণা করা হবে?”

প্রশ্ন শুধু রাজনীতির শিবিরেই নয়। বিদ্বৎসমাজের একটি বড় অংশও প্রশ্ন তুলছেন, জাতীয় গ্রন্থ হিসেবে গীতার গ্রহণযোগ্যতা কতটা। ভারতের মতো বহু জাতি, বহু ধর্মের দেশে একটি বিশেষ ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনও বইকে জাতীয় গ্রন্থ ঘোষণা করা কতটা বাঞ্ছনীয়, এই সংশয় তাঁদেরও। স্বাধীনতার পরে জাতীয় সঙ্গীত বাছার সময় হিন্দু রূপকল্প মিশে থাকার যুক্তি দেখিয়েই ‘বন্দেমাতরম’-এর বদলে ‘জনগণমন’ প্রাধান্য পেয়েছিল। ‘বন্দেমাতরম’-এর জন্য জাতীয় গান-এর স্বীকৃতি বরাদ্দ হয়। শিক্ষাবিদদের প্রশ্ন এখন যদি মোদী সরকার কোনও ধর্মগ্রন্থকেও জাতীয় গ্রন্থ হিসেবে ঘোষণা করতে চায়, তা হলেই বা গীতা কেন? জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের গবেষক চেরি কুঞ্চেরিয়া মনে করিয়ে দিচ্ছেন, গীতার জন্ম একটি যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। তার মধ্যে দু’টি অংশ রয়েছে। একটি অংশে রণনীতির আলোচনা, অন্যটি দর্শনের। কুঞ্চেরিয়ার কথায়, “গীতার মধ্যে দর্শনচিন্তার পাশাপাশি পেশীশক্তির মিশেল রয়েছে। এমন একটি গ্রন্থ কেন জাতীয় গ্রন্থের মর্যাদা পাবে?”

শিক্ষাবিদরা বরং উল্লেখ করছেন, হিন্দু ভাবধারায় কোনও দিনই একটি নির্দিষ্ট কোনও গ্রন্থকে সর্বমান্য ধর্মগ্রন্থ হিসেবে তুলে ধরা হয়নি। মুসলিমদের যেমন কোরান, খ্রিস্টানদের যেমন বাইবেল, বৌদ্ধদের ত্রিপিটক বা শিখদের গুরু গ্রন্থসাহিব হিন্দুদের কিন্তু এমন কোনও একটি গ্রন্থ নেই। উপরন্তু হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক অরিন্দম চক্রবর্তীর কথায়, কোনও হিন্দু আকরের কোনও একটি ভাষ্যও কখনও সকলের কাছে মান্য বলে গৃহীত হয়নি। তাঁর মতে, ‘ভারতীয় ভাষা’ বলে যেমন কোনও একটি ভাষা নেই, ‘গীতা’ বলেও কোনও একটি বিশেষ বই নেই। তার অজস্র ভাষ্য রয়েছে। ঠিক যেমন রয়েছে রামায়ণের, মহাভারতের।

বিরোধীদের বক্তব্য, গেরুয়া রাজনীতির শিবিরেও অনেক দিন ধরে এই নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। সেই জন্যই কোনও একটি গ্রন্থকে হিন্দুদের জন্য সর্বোচ্চ ধর্মগ্রন্থ হিসেবে তুলে ধরতে চায় তারা। যাতে হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ কী, এই প্রশ্নের উত্তরে কোথাও কোনও সংশয়ের অবকাশ না থাকে। গীতাকে জাতীয় গ্রন্থ বলে ঘোষণা করার ভাবনা সেই চেষ্টারই ফসল বলে বিরোধীদের দাবি।

কিন্তু প্রশ্ন হল, যদি হিন্দুত্বের আকরগ্রন্থই খুঁজতে হয়, তা হলে বেদ বা উপনিষদ নয় কেন? পুরাণ-বিশেষজ্ঞ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর মতে, গীতার মধ্যে অসাধারণ দার্শনিক ভাবনা রয়েছে ঠিকই। কিন্তু সাধারণ ভাবে ব্যবহারিক কিছু ধর্মীয় আচারের সঙ্গেই বইটি জড়িয়ে। তাঁর কথায়, “গীতা এ দেশে এখনও শ্রাদ্ধবাসরে পড়া হয়। সাধারণ মানুষের চেতনায় এর ধর্মীয় দিকটাই বেশি। ভারতের সংবিধান-ভাবনার সঙ্গে বরং বেদের শেষ মন্ত্র ‘সমানা মন্ত্রঃ সমিতিঃ সমানী’-র প্রতিফলন রয়েছে। যার অর্থ, সবার মন্ত্র যেন এক হয়।”

বিজেপি তা হলে কী করতে চলেছে? দু’দিন ছুটির পর কাল ফের সংসদ শুরু। সুষমার মন্তব্য নিয়ে যে ঝড় উঠবে, সেটা আঁচ করে এখন প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে চাইছেন না বিজেপি নেতারা। সাধ্বী নিরঞ্জন জ্যোতির কুকথা নিয়ে এমনিতেই হট্টগোল চরমে, তার মধ্যে গীতা নতুন অস্ত্র তুলে দিয়েছে বিরোধীদের হাতে। তবে সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠ এক বিজেপি নেতার দাবি, “পশ্চিমের দৃষ্টি থেকে অনেকে গীতার মূল দর্শনকে বুঝতে পারেন না। কিন্তু এ যাবৎ ভারতের দর্শন যদি কোনও একটি পুস্তকে সঙ্কলিত হয়ে থাকে, সেটি হল গীতা।”

অতএব, মা ফলেষু কদাচন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE