রুক্ষ ধু ধু জমির মাঝখানে একটুকরো রঙিন দ্বীপ!
তিনতলা রংচংয়ে বাড়ি। সামনে চিলতে মাঠ। কচিকাঁচাদের ভিড়। কেউ দোলনায়। কেউ বাগান সাজাচ্ছে। কেউ জোরে জোরে পড়ছে ইংরেজি কাগজ।
রাঁচী থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে ইটকির অজ গাঁয়ে এই ছোট্ট দ্বীপের নাম ফতিমা গার্লস অ্যাকাডেমি।
প্রত্যন্ত এলাকায় সংখ্যালঘু পরিবারের মেয়েদের শিক্ষিত করার স্বপ্ন নিয়ে এই স্কুল গড়েছিলেন তবসুম ফতিমা। ১০ ভরি সোনার গয়না বিক্রি করে জোগাড় করেছিলেন টাকা। সেটা ১৮ বছর আগের কথা। আজ স্বপ্নের কাছাকাছি পৌঁছে তবসুম বলছেন, ‘‘১০ ভরি সোনা বিক্রি করে যে এত অলঙ্কার ফেরত পাব ভাবতেই পারিনি। স্কুলের শ’পাঁচেক মেয়েই এখন আমার গর্বের গয়না।’’
স্থানীয় আদিবাসী পরিবারের মেয়েরা গির্জার স্কুলগুলিতে পড়তে যায়। সেখানে মুসলিম মেয়েদের যেতে কোনও বাধা নেই। কিন্তু অনেক পরিবার মেয়েদের মিশনারি স্কুলে পাঠাতে রাজি নন। সেই কারণে মুসলিম মেয়েরা পিছিয়ে পড়ছিল। সেটা খেয়াল করেই স্কুল গড়ার কথা মাথায় আসে তবসুমের। যদিও সব ধর্মের পড়ুয়াদের জন্যই দরজা খোলা তবসুমের স্কুলের।
নিজে ইতিহাসের শিক্ষিকা। উত্তরপ্রদেশের বরেলীর স্কুলে পড়াতে গিয়ে তাঁর পরিচয় হয় উর্দু শিক্ষক নাসিম আনওয়ার নদবির সঙ্গে। আদতে দু’জনই ইটকির বাসিন্দা। বিয়ের পর তাঁরা ফেরেন গ্রামেই। তবসুম জানান, ফিরে তাঁরা দেখেন গ্রামের মেয়েদের কী ভাবে পড়াশোনার সুযোগ করে দেওয়া যায় তা নিয়ে নাসিমের সঙ্গে প্রায়ই কথা বলতেন তবসুম। স্কুল খোলার প্রস্তাবে রাজি হন নাসিমও।
সেটা ১৯৯৮ সাল। টালির চালের ভাড়াবাড়িতে ১৭ জন ছাত্রীকে নিয়ে শুরু হয় ফতিমা গার্লস অ্যাকাডেমি। নাসিম বলেন, ‘‘প্রথম দিকে অনেকে মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে চাননি। কেউ কেউ বলেন, মেয়েদের জন্য ধর্মশিক্ষা যথেষ্ট। ওঁদের বুঝিয়েছিলাম, মেয়েরা আধুনিক শিক্ষা পেলে বড় হয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবে।’’ তবসুম নিজের দশ ভরি গয়না বিক্রি করে দিলেন। টালির ছাদের সেই স্কুলবাড়ি এখন বদলেছে তিন তলা ভবনে। গ্রন্থাগার, গবেষণাগার, কনফারেন্স রুম— সবই রয়েছে সেখানে। রয়েছে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার ব্যবস্থা। স্বীকৃতি মিলেছে ঝাড়খণ্ড অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের।
তবসুমের স্কুলে মেয়েরা স্বপ্ন দেখতে শিখছে। ইংরেজির শিক্ষক মহম্মদ ইমতিয়াজ বলেন, ‘‘এক ছাত্রী ইংরেজি খবরের চ্যানেলে সংবাদ-পাঠক হওয়ার স্বপ্ন দেখে। রোজ এক ঘণ্টা জোরে জোরে ইংরেজি কাগজ পড়ে। এটাই নেশা!’’ দশম শ্রেণির ছাত্রী ফৌজিয়া পারভিন বলল, ‘‘বড় হয়ে প্রধান শিক্ষিকার (তবসুম) মতো হতে চাই। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে চাই আমার মতোই অন্যদের মধ্যে।’’
এই আলোর ঠিকানা দিতেই যে স্কুল খুলেছিলেন তবসুম!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy