Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

ভারত-বন্ধনে তৃপ্ত মমতা, বোঝালেন নিজের জনপ্রিয়তাও

গত দু’দিন ধরে এই ভাবনা পেয়ে বসেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। বারবার বলছিলেন, ‘‘জানি না, শেষ পর্যন্ত কী করে সামলাব!’’ 

বদলের ডাক: বক্তা মুখ্যমন্ত্রী। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

বদলের ডাক: বক্তা মুখ্যমন্ত্রী। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

দেবাশিস ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৯ ০৪:১৮
Share: Save:

মাঠ ভর্তি লোক, মঞ্চ ভরা নেতা। চিন্তা ছিল দু’টোই। নেতাদের সকলকে বক্তৃতার সুযোগ দিতে হবে। আবার সভা দীর্ঘক্ষণ চলতে থাকলে ভিড় ধরে রাখা কঠিন হবে। তা হলে কী উপায়? গত দু’দিন ধরে এই ভাবনা পেয়ে বসেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। বারবার বলছিলেন, ‘‘জানি না, শেষ পর্যন্ত কী করে সামলাব!’’

শনিবার সমাবেশ শেষের পরে দৃশ্যতই তৃপ্ত তৃণমূল নেত্রী বললেন, ‘‘আমি খুব খুশি। নেতারা সবাই এসেছেন। বক্তৃতা করেছেন। চার ঘণ্টা ধরে সভা চলেছে। মানুষ কিন্তু বসে থেকেছেন। এটাই আমাদের প্রেরণা।’’

ছ’মাস আগে মমতা যখন এই সমাবেশের ডাক দেন, তখন বোঝা যায়নি, মঞ্চের চেহারা কী হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যা হল, তাতে যে কোনও রাজনীতিকের আত্মবিশ্বাস আকাশ ছুঁতে পারে। সব বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের এক মঞ্চে হাজির করার এই ‘কৃতিত্ব’ অনেকের মতে, ১৯৭৭ সালে জয়প্রকাশ নারায়ণের সঙ্গে তুলনীয়।

পাশাপাশি, দীর্ঘক্ষণ ভিড় ধরে রেখে জাতীয় নেতাদের কাছে নিজের ‘জনপ্রিয়তাও’ এ দিন বুঝিয়ে দিতে পেরেছেন মমতা। বস্তুত গোড়া থেকেই এ নিয়ে সতর্ক ছিলেন তিনি। তাই অন্যদের বক্তৃতার মাঝে মাঝেই জনতাকে বলেছেন, তিনি বলবেন সবার শেষে। ভিড় অপেক্ষা করেছে নেত্রীর কথা শোনার জন্য।

আরও পড়ুন: দেশে সরকার বদল করতেই হবে, ব্রিগেডে সুর মিত্রশক্তির

মমতার যে কোনও কর্মসূচিতেই তিনি কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে ওঠেন। নেতৃত্বের লাগাম নিজের হাতে নেওয়ার সেই দক্ষতা তাঁর করায়ত্ত। শনিবারের ব্রিগেডেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সভা যে হেতু তাঁর ডাকে, তাই সেটা হয়তো খুব অস্বাভাবিকও নয়।
কিন্তু এ দিন যেটা লক্ষ করার তা হল, দেশের সব বিরোধী নেতা তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁর তৈরি এই মঞ্চকে ব্যবহার করতে কলকাতায় হাজির হয়েছেন। এক দিক থেকে দেখলে, বিরোধী শিবিরে মমতার ‘গ্রহণযোগ্যতার’ এ ছিল বড় পরীক্ষা এবং বলা যেতেই পারে, তৃণমূল নেত্রী তাতেও সসম্মানে উত্তীর্ণ।
দেশে সরকার বদলের জন্য বিরোধীদের সম্মিলিত আহ্বান যত তীব্র হচ্ছে, ততই প্রশ্ন জাগছে, কে হবেন বিরোধী শিবিরের প্রধান মুখ? সোজা কথায়, সরকার বদলালে প্রধানমন্ত্রীর দৌড়ে এগিয়ে থাকবেন কে? প্রকাশ্যে এ নিয়ে কোনও আলোচনা কেউ করেননি। এখনই তা করার কথাও নয়। কিন্তু জনসমাবেশ ডেকে মমতা প্রবীণ, নবীন সব বিরোধী নেতাকে এক জায়গায় বসানোর ফলে এটা অন্তত প্রমাণ হয়ে গেল, তাঁর আহ্বান কেউ ফেলতে পারছেন না। নেতারাও তা বলে গেলেন। জোট-রাজনীতিতে এটা খুব অর্থবহ।
মমতা আঞ্চলিক দলগুলির উত্থানের যে কথা বলে আসছেন, তাঁর শনিবারের ব্রিগেড সাফল্য তারও একটি বড় স্বীকৃতি। বিরোধী শিবিরের জাতীয় দল কংগ্রেসের সঙ্গে মমতার পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে কী সম্পর্ক তৈরি হবে, তা নিয়ে জল্পনা এখনও জারি আছে। তবে, কংগ্রেস হাইকম্যান্ড লোকসভার বিরোধী দলনেতাকে ব্রিগেডে পাঠিয়ে এই সমাবেশকে শুধু গুরুত্বই দেননি, রাহুল গাঁধী ও সনিয়া গাঁধী আলাদা আলাদা করে বার্তা পাঠিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, মমতার এই উদ্যোগে তাঁদের সায় আছে। এই রাজ্যে ৪২টি লোকসভা আসনের সিংহভাগ মমতার হাতে থাকবে, এমন আন্দাজ করেই কংগ্রেস নেতৃত্ব তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে ‘সুসম্পর্ক’ রাখা প্রয়োজন বলে মনে করছেন কিনা, সেই চর্চা চলছে রাজনৈতিক মহলে। তবে, আপাত ভাবে মমতাকে যে ‘অস্বীকার’ করা যাচ্ছে না, এতে ভুল নেই।
এর আগে বেঙ্গালুরুতে কুমারস্বামীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে সব বিরোধী নেতা হাজির ছিলেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সেটা ছিল একটি আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি। এবং পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল সেখানে ভোটের ফলাফলের পরে উদ্ভূত তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে। মমতা ব্রিগেড সমাবেশ ঘোষণা করেছিলেন জুলাই মাসে। সেই থেকে এত দিন ধরে একটু একটু করে প্রস্তুতি চলেছে। শীর্ষস্থানীয় বিরোধী নেতারাও সবাই ভাবনাচিন্তার দীর্ঘ সময় পেয়েছেন। নানা দিক পর্যালোচনার সুযোগ পেয়েছেন এবং ভেবেচিন্তে মনে করেছেন, মমতার মঞ্চে যাওয়া দরকার। বিরোধী-জোট গঠনে মমতার উদ্যোগকে সাধুবাদ দিতেও তাঁরা কার্পণ্য করেননি। সমাবেশের পরে আলিপুরের নবনির্মিত ‘সৌজন্য’ ভবনে চা-চক্রেও হাজির ছিলেন অতিথি-নেতাদের প্রায় সকলেই। সেখানে চন্দ্রবাবুর সঙ্গে মমতার আলাদা বৈঠকও রাজনৈতিক মহলের নজর এড়ায়নি। কারণ, কংগ্রেসের ‘দূত’ হিসেবে চন্দ্রবাবুই মাস কয়েক আগে মমতার কাছে দিল্লির বিরোধী-বৈঠকে যোগ দেওয়ার অনুরোধ নিয়ে এসেছিলেন। মমতা গিয়েছিলেন।
রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু হয় না। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা আরও বেশি সত্যি। তবে একটা কথা বোধহয় নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, মমতা ব্রিগেডে যা করে দেখালেন আপাতত অন্য কারও পক্ষে তা করা সম্ভবপর নয়। কারণ এ জন্য যে ধরনের প্রস্তুতি দরকার, তা করতে করতে হয়তো ভোট ঘোষণা হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে আরও এক বার মমতা বলতে পারবেন, শুধু তিনিই পেরেছেন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE