Advertisement
১১ মে ২০২৪

হাঁড়ি আলাদা করবে কি আইআইটি, বিতর্ক

দেশের প্রথম সারির কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন খাবারদাবারের মনস্তত্ত্ব নিয়ে গবেষণায় ব্যস্ত। কেন? অভিযোগ উঠেছে, আবাসিক ওই প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের নিজস্ব খাদ্যাভ্যাস নাকি বদলে যাচ্ছে! আর তা থেকে নাকি মন-মানসিকতা সবই বদলে যেতে বসেছে! সামাজিক-পারিবারিক অশান্তি বাড়ছে! তাই খাদ্যবিচার আর মনের গড়নের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজতে বসেছে আইআইটি।

অনমিত্র সেনগুপ্ত
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০১৪ ০২:০৭
Share: Save:

দেশের প্রথম সারির কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন খাবারদাবারের মনস্তত্ত্ব নিয়ে গবেষণায় ব্যস্ত।

কেন? অভিযোগ উঠেছে, আবাসিক ওই প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের নিজস্ব খাদ্যাভ্যাস নাকি বদলে যাচ্ছে! আর তা থেকে নাকি মন-মানসিকতা সবই বদলে যেতে বসেছে! সামাজিক-পারিবারিক অশান্তি বাড়ছে!

তাই খাদ্যবিচার আর মনের গড়নের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজতে বসেছে আইআইটি। যদিও এর মধ্যে দিয়ে ঠিক খাবার নয়, বরং গৈরিকীকরণের গন্ধই খুঁজে পাচ্ছেন অনেকে।

গোটা বিষয়টা খুঁচিয়ে তুলেছেন যিনি, তাঁর নাম নরেন্দ্র জৈন। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী স্মৃতি ইরানিকে চিঠি দিয়েছেন মধ্যপ্রদেশের ওই বাসিন্দা। তাঁর অভিযোগ, আমিষাশী সহপাঠীদের প্রভাবে পড়ে নিরামিষাশী পড়ুয়ারা নিজেদের শতাব্দীপ্রাচীন খাদ্যাভ্যাস পাল্টে ফেলছেন। এমনিতে পূর্ব ভারতের ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মাছ-মাংস খাওয়া দেখে যেমন নাক কুঁচকোন উত্তর ও দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাহ্মণেরা। কিন্তু ছেলেমেয়েরা হস্টেলে থেকে আমিষ খাবারও চেখে দেখছে। বদলে যাচ্ছে তাঁদের মানসিকতাও। ফলে পরিবারের সঙ্গে আর তাল মেলাতে পারছেন না তাঁরা। তাই আইআইটি-র কলেজগুলিতে অন্তত আমিষ ও নিরামিষ ক্যান্টিন পৃথক করার দাবি জানিয়েছেন নরেন্দ্র।

এ বিষয়ে আইআইটিগুলি কী ভাবছে, জানতে চেয়ে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রক। ফলে সেকেলে হেঁসেলের মতো আঁশের ছোঁয়া বাঁচিয়ে আলাদা উনুন বসানো হবে কি না, সেটাও এ বার ভাবতে হচ্ছে আইআইটি-কে।

এমনিতে আইআইটি বা সমতুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যান্টিনে নিরামিষ, আমিষ দু’রকম খাবারই পাওয়া যায়। তবু কেন সমস্যা? নরেন্দ্র জৈন চিঠিতে জানিয়েছেন, আমিষাশীদের নিয়ে তাঁর কোনও বক্তব্য নেই। কিন্তু বহু ছাত্র-ছাত্রী পারিবারিক-সামাজিক অভ্যাসে নিরামিষ আহার করে থাকেন। তাঁরা যখন বিভিন্ন আইআইটিতে পড়তে যাচ্ছেন, তখন তাদের সমস্ত ধরনের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মিশতে হচ্ছে। খেতে বসতে হচ্ছে একসঙ্গে। জৈনের অভিযোগ, সেখানেই আমিষদের খাদ্যাভ্যাস প্রভাব ফেলছে নিরামিষাশীদের মধ্যে। একাধিক ছাত্র-ছাত্রী উচ্চশিক্ষায় এসে জীবনে প্রথম বার আমিষ খাওয়া শুরু করছেন। জৈনের উদ্বেগ এই ‘খাদ্যান্তরিত’দর নিয়ে। জৈন লিখেছেন, সেই পড়ুয়ারা যখন বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন তখন পরিবারের সনাতন খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে আর তাল মেলাতে পারছেন না। ফলে শুরু হচ্ছে পারিবারিক অশান্তি।

তাই আমিষ ও নিরামিষ দু’ধরনের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য পৃথক ক্যান্টিন তৈরির দাবি।

আমিষ-নিরামিষের দ্বন্দ্ব নতুন নয় ঠিকই। কিন্তু তা বলে খাবারের বিচার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে! এমন কোনও ফরমান কখনও গিয়েছে বলে মনে করতে পারছেন না মন্ত্রকের কোনও কর্তাই। যে ভাবে মন্ত্রক বিষয়টিতে তৎপর হয়েছে তাতে পিছনে গৈরিকীকরণের ছোঁয়া রয়েছে বলেই মনে করছে বিরোধী দলগুলি। ঘটনাচক্রে মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি নিজে নিরামিষাশী।

কিছু দিন আগে একটি সাক্ষাৎকারে তা জানিয়েওছিলেন তিনি।

ফলে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, এই তৎপরতার পিছনে কি মন্ত্রকের কর্ত্রীর খাদ্যাভাস প্রভাব ফেলেছে?

প্রশ্ন শুনেই মুখে কুলুপ এঁটেছেন মন্ত্রকের আমলারা।

সিপিএমের রাজ্যসভা সাংসদ তথা এসএফআইয়ের সর্বভারতীয় সম্পাদক ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু অভিযোগ করছেন, “এই ঘটনা মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ। এক জন প্রাপ্তবয়স্ক ছাত্র কী খাবেন, কার সঙ্গে বসে খাবেন সেটা তাঁর সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিষয়।

এর আগেও সরকারে এসে বিজেপি গৈরিকীকরণের নামে একাধিক অবৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ করেছিল। এ বারও তা শুরু হয়েছে।”

আবার খাদ্যরসিকেরা প্রশ্ন তুলছেন, আমিষ-নিরামিষ একত্র আহারে আমিষের দলই শুধু ভারী হচ্ছে কেন? অন্যটাও তো হতে পারত! তার মানে কি আমিষ আহারের জনপ্রিয়তা বাড়ছে? সেটা কি খারাপ? এ ব্যাপারে চিকিৎসকদের মধ্যে অবশ্য দু’রকম মতই রয়েছে। একাংশের মতে, আমিষ খাবারে স্বাস্থ্যহানির সম্ভাবনা বেশি। আবার অন্য অংশের যুক্তি, পরিমিত আমিষ আহার দেহের সুষম বিকাশের জন্য জরুরি। নিউট্রিশনিস্ট রেশমী রায়চৌধুরী বলছেন, “আমিষ খাবারে অ্যামাইনো অ্যাসিড থাকে।

যা দেহের বিকাশে অপরিহার্য। প্রোটিনের প্রশ্নে নিরামিষাশীরা পিছিয়ে রয়েছেন। আবার আমিষ যারা বেশি খান, বেশি ক্যালোরি তাঁদের পেটে যায়। ফলে মানসিক চাপ, হার্টের সমস্যা তাঁদের বেশি হয়।”

কিন্তু এই বিশ্বায়নের জমানায় খাদ্যের পাঁচিল গড়ে তোলার প্রস্তাব কতটা যুক্তিসম্মত? রেশমীর মতে, খাদ্যাভ্যাস গড়ে ওঠে সামাজিক ও ভৌগোলিক কারণে। নতুন প্রজন্মকে বিশেষ কোনও খাদ্যাভাসে আটকে রাখা কঠিন। বিশেষ করে যারা হোস্টেলে পড়াশুনো করতে যায়, তাদেরকে গন্ডিতে বাঁধা আরও কঠিন। সুতরাং আইআইটি-র হেঁসেল ভাগ করে দিলেই সব মিটে যাবে কি, সংশয়ী অনেকেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE