Advertisement
১৭ মে ২০২৪

মুক্তির মন্দির সোপানতলে

লিখছেন পারমিতা মুখোপাধ্যায়স্টিয়ারিঙ শক্ত হাতে ধরে বসে আছে চালক। মুখ তার ভাবলেশহীন। অন্তরের শংকা প্রকাশ পাচ্ছে না মুখে। আর সেই পাঠান যুবক? চোখ বুজে সে যেন ধ্যানমগ্ন...। কে এই পাঠান?

শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:২৯
Share: Save:

স্টিয়ারিঙ শক্ত হাতে ধরে বসে আছে চালক। মুখ তার ভাবলেশহীন। অন্তরের শংকা প্রকাশ পাচ্ছে না মুখে। আর সেই পাঠান যুবক? চোখ বুজে সে যেন ধ্যানমগ্ন...।

কে এই পাঠান?

সুধীজন, আপনারা নিশ্চই এতক্ষণে অনুমান করে ফেলেছেন তাঁর পরিচয়! হ্যাঁ, নেতাজী, আমাদের প্রিয় নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। এলগিন রোডের বাড়ি থেকে বৃটিশ পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে দেশের বাইরে পালিয়ে যাচ্ছেন সুভাষ পাঠান যুবকের ছদ্মবেশে। উদ্দেশ্য, ভারতের স্বাধীনতা। স্বাধীনতায় আমাদের জন্মগত অধিকার। আমরা স্বাধীনতা চাই। সুভাষের মনের মাঝে ভেসে ওঠে স্বামী বিবেকানন্দের ছবি, যাঁর প্রেরণা, বাণী বুকের মাঝে নিয়ে এতদূর এগিয়ে আসা। হে মহাপ্রাণ, শক্তি দাও। এই বিরাট কাজের ভার বইবার শক্তি দাও।

চুঁচুড়া, ব্যাণ্ডেল, শক্তিগড়, বর্ধমান, আসানসোল, বরাকর ব্রীজ পেরিয়ে গেল গাড়ি। পুব আকাশে আলো ফুটছে। ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে অন্ধকার। আর দেরি নয়। দ্রুত পৌঁছতে হবে গন্তব্যস্থলে। বলা যায় না, পুলিশের চর চারপাশেই ছড়ানো। অবশেষে গাড়ি থামল ধানবাদে একটি বাংলোর সামনে। সে দিনের মত যাত্রার বিরতি। আবার যাত্রা শুরু হবে সূর্যাস্তের পর।

রাত তখন অনেক। এক পাশে উঁচু পাহাড়ের সারি। নীচ দিয়ে এঁকে বেঁকে চলে গেছে রেললাইন। স্টেশন গোমো জংশন। বেশ খানিকটা দূরে অন্ধকারের আড়ালে লুকিয়ে আছে একটা গাড়ি। ভেতরে চার জন যাত্রী। তাঁদের মধ্যে এক জন মহিলা। ঘুমন্ত স্টেশন একসময় জেগে উঠল। ট্রেন আসছে। গাড়িটা ধীরগতিতে এগিয়ে গেল স্টেশনের দিকে। এ বার সুভাষকে বিদায় নিতে হবে। গাড়ি থেকে নেমে দৃঢ় পদক্ষেপে তিনি এগিয়ে গেলেন প্লাটফর্মের দিকে। বিদায়! সুভাষকে পৌঁছে দিয়ে তিন জন ফিরে এলেন শূন্য মনে। কারা এঁরা? মোটরগাড়িতে করে সুভাষকে নিয়ে এতদূরের পথ পাড়ি দিয়েছিলেন সুভাষেরই ভাইপো শিশির বোস। তিনিই ছিলেন সুভাষের সারথি। আর দুজন ছিলেন শিশির বোসেরই দাদা শ্রী অশোক বোস এবং তাঁর স্ত্রী।

এদিকে ট্রেন ছুটে চলেছে হু হু করে। আর পেছনে তাকানো নয়। এখন শুধুই এগিয়ে চলা। মরণপণ সংগ্রামই এখন জীবনের মূল লক্ষ্য।

ট্রেন অনেক পথ পেরিয়ে যখন পেশোয়ার ক্যান্টনমেন্টে থামল, নামলেন সুভাষ। পূর্ব পরিকল্পনামত উঠলেন তাজমহল হোটেলে। এ বার গন্তব্য কাবুল। কিন্তু কোথায় সেই দুঃসাহসী কর্মী ভকতরাম? যে তাঁকে পৌঁছে দেবে কাবুল?

হ্যাঁ, ভকতরাম হাজির। খুব খুশি সে। বঙ্গাল কা শের সুভাষচন্দ্র বোস আ গয়া। এখন শুধু হুকুম তামিলের অপেক্ষা। কিন্তু দেরি হল কয়েক দিন কাবুলের পথে যাত্রা শুরু করতে। কারণ, আগেকার পথের পরিবর্তে যেতে হবে অন্য পথ দিয়ে। সে পথ আরও দুর্গম, আরও বিপদসংকুল।

১৯৪১ সাল, ২৬শে জানুয়ারি। শুরু হল ঐতিহাসিক যাত্রা। গাড়িতে পাঁচজন যাত্রী। সুভাষ, কমরেড ভকতরাম, গাইড, আবাদ খাঁ ও ড্রাইভার। গাড়ি এগিয়ে চলেছে শহরের সীমানা পেরিয়ে অনেক দূরে খাজুরি ময়দানের দিকে। বহু দূরে আকাশের গায়ে পাহাড়ের সারি। ঢেউখেলানো উপত্যকা। মাঝে আঁকাবাঁকা পথ। খাজুরি ময়দানে গাড়ি এসে থামলে সুভাষ ভকতরাম আর গাইডকে সঙ্গে নিয়ে পা বাড়ালেন দুর্গম গিরিপথের দিকে। এই গিরিপথ ধরেই এ বার এগিয়ে যেতে হবে পায়ে হেঁটে। দুর্ধর্ষ উপজাতীয় অঞ্চল। কোথা থেকে শত্রু এসে হানা দেবে তার কোনও ঠিক নেই। প্রকৃতিও রুক্ষ, শুধু পাথর আর পাথর। পথ বলেও কিছু নেই। এখানে ওখানে পাথরের ফাটলে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বনস্পতির দল। সমতলে বড় হয়ে ওঠা সুভাষ তবু সব কষ্ট সহ্য করে এগিয়ে চললেন। যেভাবেই হোক ভারতের সীমান্ত তাঁকে পেরোতেই হবে। দুচোখে তাঁর স্বাধীনতার স্বপ্ন। কত বড় আদর্শের সংকল্পে এই পথচলা।

পথচলার বিরাম নেই। ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে শরীর। দেহ টলছে, পা কাঁপছে। এ আর কতটুকুই বা পথ! আরো কত পথ পাড়ি দিতে হবে তাঁকে। কি আছে পথের শেষে, তা ঈশ্বরই জানেন। সামনেই উঠে গেছে একটা খাড়া পাহাড়। তার চূড়ো বরফে ঢাকা। তাঁরা এসে থামলেন পাহাড়ের নীচে। ক্লান্ত সুভাষ প্রশ্ন করেন, আর কত পথ বাকি বর্ডার পার হতে?

বর্ডার? বর্ডার তো আমরা কখন পার হয়ে এসেছি। বলে ওঠে সুভাষের বিশ্বস্ত ছায়াসঙ্গী ভকতরাম।

সুভাষের মনের মাঝে আবার ভেসে উঠল স্বামী বিবেকানন্দের মুখ। জয় বীরেশ্বর বিবেকানন্দ। জয় ভারতমাতা কি জয়। বিপদ আপাতত কেটে গেছে।

সঙ্গী ভকতরামকে নিয়ে এবার দুর্গম পাহাড়ি পথে কাবুলের দিকে এগোতে লাগলেন সুভাষ। হাড়-হিম করা ঠাণ্ডা আর পথের বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে আছে মরণ ফাঁদ। চারিদিকে তুষারের প্রাচীর। তা থেকে জল পড়ছে চুঁইয়ে। পিচ্ছিল হয়ে পড়ছে চলার পথ, যদি তাকে পথ বলতে পারা যায়। কোথাও কোথাও লুকিয়ে আছে চোরা ফাটল। ক্ষণিকের ভুলে তলিয়ে যেতে হতে পারে কোনও এক অতল গহ্বরে।

বিপ্লবের পথ কখনই কুসুমাস্তীর্ণ নয়। এ পথ চিরকালই ক্ষুরধার। এ পথে যারাই এসেছে, তারাই পদে পদে হয়েছে লাঞ্ছিত, জর্জরিত। সুভাষচন্দ্র বসুও এর ব্যতিক্রম নন। অভাব তো তাঁর ছিল না কিছুরই – অর্থ, যশ, শিক্ষা, দীক্ষা, সম্মান, প্রাচুর্য। তবু সে সব হেলায় ত্যাগ করে তিনি যুদ্ধে নেমেছেন প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রিটিশের সাথে কেবল তাঁর দেশমায়ের মুখের দিকে চেয়ে।

দুরন্ত দুর্গম পথ পেরিয়ে অবশেষে আফগানিস্তানের কাবুলে এসে পৌঁছলেন সুভাষ। কাবুলে পা রেখেই আর দেরি করলেন না সুভাষ। যোগাযোগ করলেন রুশ দূতাবাসের সঙ্গে। যুদ্ধের আগুনে তখন সারা ইউরোপ জ্বলছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের গুপ্তচরদের কাছে কাবুল হল গিয়ে স্বর্গরাজ্য। এই অবস্থায় এখানে বেশি দিন অপেক্ষা করাও বিপজ্জনক। ইংরেজদের হাতে কোনও ভাবে ধরা পড়ে গেলে এত কষ্ট, এত পরিকল্পনা সব জলে যাবে। কিন্তু রুশ দূতাবাসে কোন আশার আলো দেখা গেল না। রাশিয়ার সাহায্যের আশা ত্যাগ করে সুভাষ পা বাড়ালেন জার্মান দূতাবাসের দিকে। জার্মান রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা হল। প্রতিশ্রুতিও পাওয়া গেল সাহায্যের। তবে তৎক্ষণাৎ কিছু করা সম্ভব নয়। এ দিকে চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে গোয়েন্দা পুলিশের চর। এই অবস্থায় সুভাষকে আশ্রয় দিলেন উত্তমচাঁদ নামে এক ভারতীয় ব্যবসায়ী। নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে জার্মান দূতাবাসের সঙ্গে। কিন্তু বার্লিন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নির্দেশ আর আসে না। না, আর অপেক্ষা করতে রাজি নন সুভাষ। অদূরে রুশ সীমান্ত। যেভাবেই হোক সীমান্ত পার হয়ে তাঁকে রাশিয়ায় ঢুকতে হবে। সেই অনুযায়ী পরিকল্পনাও ছকে ফেলা হল। কিন্তু ঈশ্বরের অভিপ্রায় ছিল অন্য। কারণ হঠাৎই বার্লিন থেকে খবর এল সুভাষকে ইতালীয় দূতাবাসে দেখা করতে হবে। ওখান থেকেই সুভাষের আফগানিস্তানের বাইরে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু এক জায়গায় একটু গোলমাল হল। রুশ সরকার সুভাষকে ভিসা দিতে দেরি করায় যাত্রা পিছিয়ে গেল কিছু দিন। অবশেষে রুশ সরকারের অনুমতি পাওয়া গেলে ইতালিয়ান দূতাবাসের মারফত সুভাষ যাত্রা করলেন ইউরোপের উদ্দেশ্যে। ১৯৪১ সাল, ১৭ই মার্চ। বিদায়ের লগ্ন আসন্ন। কাবুলপ্রবাসী ভারতীয়দের ঋণ তিনি কোনও দিনই শোধ করতে পারবেন না। কিছুদিন পর বার্লিন থেকে ইথার-তরঙ্গে ভেসে এল সেই দৃপ্ত কন্ঠস্বর, ‘আমি সুভাষ বলছি’।

আর এ দিকে ব্রিটিশ সরকার; কি করল তারা; তাদের ধরপাকড় আর পৈশাচিক নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পেলেন না, সুভাষের অন্তর্ধানে যাঁরা সাহায্য করেছিলেন, তাঁরা।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এমনিভাবেই রক্তের অক্ষরে লেখা হয়ে গেছে বিপ্লবীদের নাম। হয়তো এমন সব নাম যাঁরা কালের গহ্বরে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে গেছেন নিজেদের শেষ রক্তবিন্দু দেশের জন্য উৎসর্গ করে। নামের জন্য নয়, যশের জন্য নয়, অর্থের জন্যও নয়, কেবল দেশমাতৃকার পরাধীনতার শৃংখলমোচনের জন্য। তাঁদের এই নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ কি বিন্দুমাত্র বিচলিত করে না আমাদের? আমরা যারা স্বাধীন ভারতের নাগরিক; যেন কখনও ভুলে না যাই কত মানুষের রক্তের মূল্যে এসেছে আমাদের এই বহু আকাংক্ষিত স্বাধীনতা।

আসন্ন তেইশে জানুয়ারি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিন। এই লেখার মাধ্যমে তাঁকে জানালাম আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। এবার বলব এমন একজন বিপ্লবীর কথা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তো বটেই, বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসেও যাঁর একটি বিশেষ স্থান রয়েছে।

মানবেন্দ্রনাথ রায়, যাঁর পিতৃদত্ত নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। মানবেন্দ্রনাথ রায় ছিল তাঁর ছদ্মনাম এবং এই নামেই তিনি জগদ্বিখ্যাত হন। প্রথম জীবনে তিনি সন্ত্রাসবাদী ও সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী দল অনুশীলন ও যুগান্তরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। বিপ্লবীদের অর্থসাহায্যের জন্য দুটি রেল ডাকাতির নেতৃত্ব দেন তিনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারত-জার্মান মৈত্রী সমিতি গঠন করে ইংরেজ-জার্মান ষড়যন্ত্রে যোগ দেন। সি মার্টিন ছদ্মনামে বিদেশযাত্রা করেন তিনি। এই সময় ওড়িশার উপকূলে বালাশোর বুড়িবালামের তীরে পরিখা যুদ্ধে বাঘাযতীনকে সাহায্য করেন তিনি। বিশ্বের নানা দেশ ঘুরেছেন। বাটাভিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়, সুমাত্রা, জাপান, জার্মানী প্রভৃতি। মাহমুদ হোসেন এই ছদ্মনামে আমেরিকায় পাড়ি দেন। সেখানে মার্ক্সবাদের ওপর গভীর পড়াশোনা করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ-ভারতের বিপ্লবীদের কাছে আমেরিকা আর নিরাপদ রইল না। তখন তিনি তাঁর পৈত্রিক নাম পালটিয়ে মানবেন্দ্রনাথ রায় ছদ্মনাম গ্রহণ করেন, সংক্ষেপে এম এন রায়। এই নামেই তিনি সারা বিশ্বে পরিচিত হয়েছেন। আমেরিকা যখন বিপ্লবীদের জন্য আর নিরাপদ রইল না, তিনি পালিয়ে গেলেন মেক্সিকোয়। মেক্সিকোয় জড়িয়ে পড়লেন সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে। সেখানে তিনি কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনিই রাশিয়ার বাইরে পৃথিবীতে প্রথম কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা। লেনিন মেক্সিকোর সমাজতান্ত্রিক দলের মুখপত্রে এম এন রায়ের লেখা পড়ে মুগ্ধ হন এবং তাঁকে রাশিয়ায় আসার আমন্ত্রণ জানান। ক্রমে তিনি বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার সমাজজীবনে জড়িয়ে পড়লেন। ১৯১৯ সালে মস্কোতে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসে এম এন রায় উপনিবেশগুলোতে স্বাধীনতার দাবিতে সংগ্রামরত জাতীয়তাবাদীদের চরিত্র বিশ্লেষণ করে এ বিষয়ে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের ভূমিকার মূল্যায়ন করে এক থিসিস দেন। তিনি ভারত থেকে এসেছেন এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লেনিন তাঁর তত্ত্বকে স্বীকার করে নেন। এর পর এম এন রায় চিনেও যান। কিছু দিন পর তিনি ইউরোপে ফ্যাসিবাদের ব্যাপক অভ্যুত্থানের আশংকায় বৃহত্তর ফ্যাসীবাদ বিরোধী জাতীয় ফ্রন্ট গড়ে তোলার প্রস্তাব দেন। তাঁর প্রস্তাব কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক গ্রহণ করেনি। তিনি এ ব্যাপারে জার্মান কমিউনিস্ট পার্টি নেতৃত্বদের সঙ্গে মত বিনিময় করেন এবং তাঁদের মুখপত্রে তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে প্রবন্ধও লেখেন। তখন তাঁকে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি রেনিগেড বা দলত্যাগী আখ্যা দেয় ও তাঁকে পার্টি কর্তৃক পরিত্যক্ত করা হয়। অবশেষে ১৯৩০ সালে জার্মানি থেকে ইউরোপের বিভিন্ন পথ ঘুরে তিনি ভারতে ফিরে আসেন। কিছু দিন পর তিনি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে। তাঁকে কানপুর ষড়যন্ত্র মামলারও আসামি করা হয় এবং বিচারে তাঁকে বারো বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পরে দণ্ডের মেয়াদ অর্ধেক কমে যায় এবং মুক্তি পাওয়ার পর তিনি জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে যোগ দেন ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য হন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে রাশিয়া জার্মানির দ্বারা আক্রান্ত হলে তাঁর প্রচার ব্রিটিশ সরকারের অনুকূলে যাওয়ায় এবং তিনি ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করায় কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হন। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট থেকেও বহিষ্কৃত হওয়ায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কাছেও তাঁর গ্রহণযোগ্যতা রইল না। অবশেষে তিনি রেডিক্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি নামে এক দল গঠন করেন। কিছু দিন পর এই দলও ভেঙে দিয়ে রেডিক্যাল হিউম্যানিস্ট লিগ নামে এক সংস্থা গড়ে তোলেন এবং একে এক আন্দোলনের রূপ দেন। এখানেই দার্শনিক মানবেন্দ্রনাথ রায়ের পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর নবমানবতাবাদে ব্যক্তিজীবনকে রূপায়িত করার জন্য যে আন্দোলন তা যতটা না রাজনৈতিক তার থেকেও বেশি শিক্ষা ও সংস্কৃতিমূলক। মানুষের অগ্রগতির মূল প্রেরণা তার মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ও সত্যের অনুসন্ধান। জীবজগতে টিকে থাকার আদি জৈব প্রেরণাই ক্রমবিবর্তিত হয়ে রূপ নেয় বুদ্ধি ও আবেগের বিকাশে যা মানুষকে নিয়ে চলে পরম মঙ্গলের পথে। এক কথায় একে বলা চলে মেটামরফোসিস। মানবেন্দ্রনাথ রায়কে আমরা তাঁর উপযুক্ত মূল্যায়ন হয়তো করতে পারিনি। তাই ভারতের রাজনীতিতে তিনি ব্রাত্য হয়েই রয়ে গেছেন। কিন্তু এই বিপুল প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অবদান—কি স্বাধীনতা সংগ্রামে, কি রাজনীতিতে, কি দার্শনিক চিন্তায় অনস্বীকার্য। ১৯৫৪ সালে ২৫শে জানুয়ারি দেরাদুনে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুদিবসের প্রাক্কালে স্মরণ করলাম তাঁকে। এখানে উল্লেখ্য যে, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পথের দাবী’ উপন্যাসের সব্যসাচীর মধ্যে বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায়েরই ছায়া দেখা যায়। আজ শেষ করি। ভাল থাকবেন।

ঋণস্বীকার:

১) ‘আমি সুভাষ বলছি’, শৈলেশ দে। ২) ‘এম এন রায় বিপ্লবী, রাজনীতিক ও দার্শনিক’, শ্যামলেশ দাশ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

netaji subhas chandra bose mumbai
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE