Advertisement
E-Paper

স্বপ্নপূরণের রঙ্গোলি

কথা নেই, বার্তা নেই, হুট করে মেয়েটি জানলা দিয়ে মুখ বাড়াল। চমকে উঠেছিলুম। সন্ধে উতরে গেছে। এই সময়টা ভাল নয়। রাস্তায় রাস্তায় আলো-অন্ধকারে দেহপসারিণীরা দাঁড়িয়ে থাকে সম্ভাব্য খদ্দের ধরার আশায়। লাল আলোয় ভাড়াটে হাওয়া গাড়ির মধ্যে আটকে গেছি। স্বামী বিবেকানন্দ রোড ও হিল রোডের মোড়ে। আগে পিছে গাড়ির সারি।

মুম্বই মনতাজে মিলন মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০১৬ ০০:০০

কথা নেই, বার্তা নেই, হুট করে মেয়েটি জানলা দিয়ে মুখ বাড়াল। চমকে উঠেছিলুম। সন্ধে উতরে গেছে। এই সময়টা ভাল নয়। রাস্তায় রাস্তায় আলো-অন্ধকারে দেহপসারিণীরা দাঁড়িয়ে থাকে সম্ভাব্য খদ্দের ধরার আশায়। লাল আলোয় ভাড়াটে হাওয়া গাড়ির মধ্যে আটকে গেছি। স্বামী বিবেকানন্দ রোড ও হিল রোডের মোড়ে। আগে পিছে গাড়ির সারি।

—‘‘দাদা!’’ অনুনয়ের গলায় ডাকল মেয়েটি।

এ রাজ্যে দাদা ডাকের দুটি অর্থ। আবালবৃদ্ধ তাবৎ বঙ্গসন্তানকে অবাঙালিরা দরকারমাফিক ‘দাদা’ ডেকে সম্মান দেখান। অপর অর্থ— পাড়ার গুন্ডা। অবৈধ দলের পান্ডা। যাদের অন্য সম্বোধন ‘ভাই’। ট্যাক্সির ভেতরে অন্ধকার। জানালার ফ্রেমের মধ্যে মুখটি। রাস্তায় ইরানি হোটেলের ঝকঝকে আলো এসে পড়েছে মেয়েটির মাথার পেছনে। চুলের দুপাশে সেই আলো পড়ে চকচকে হাইলাইট। মুখ ঠাহর করতে পারছি না স্পষ্ট। জানতে চাইল—‘‘আপ তো আন্ধেরিমে যায়েঙ্গে!’’

হ্যাঁ। আন্ধেরি হয়েই যেতে হবে, কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদের হেতু পরিষ্কার হল না। চালকসায়েব ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিলেন। রাস্তায়, ফুটপাথে দাঁড়ানো লোকেরাও বেশ উৎসুক চোখে দেখছে। কণ্ঠস্বরে যথেষ্ট অসোয়াস্তি মাখিয়ে জানতে চাইলুম, কী করতে পারি ওর জন্যে।

—‘‘ওদিকে আমাকে একটু লিফট দিন না! বাসের লাইনে প্রচণ্ড ভিড়, খালি ট্যাক্সি একটাও পাচ্ছি না, অথচ ভীষণ দেরি হয়ে গেছে।’’ মিনতির গলায় জানাল মেয়েটি।

লাল থেকে হলুদ। গাড়ি নড়ে উঠল। হ্যাঁ-না কিছু বুঝে ওঠার আগেই হুট করে দরজা খুলে ঢুকে পড়ল মেয়েটি। টেনে দরজা বন্ধ করতে করতে করুণ সুরে বলল, ‘প্লিজ!’

গাড়ি চলতে শুরু করেছে। পেছন ফিরে দেখি, ইরানি হোটেল, পানের দোকানের সামনে দাঁড়ানো লোকগুলো গাড়ির দিকে তাকিয়ে, হাত নেড়ে নিজেদের মধ্যে কীসব বলাবলি করছে। এহেন কিংকর্তব্যবিহীন অবস্থায় কী করব, কী বলব, আদৌ কিছু বলা উচিত কি না, ঠাহর করতে পারছি না। মেয়েটিই প্রশ্ন করল, অনেকটা যেন নিশ্চিত হয়েই, ‘‘দাদা তো গোরগাঁওতে থাকেন, না?’’

ও জানল কী করে? গম্ভীর মুখে সামনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে, নাক দিয়ে জানালুম, খানিকটা বিরক্তি মাখিয়ে, ‘হুঁ’।

—‘‘আমাকে বোধহয় ঠিক চিনতে পারছেন না’’।

চলতি গাড়ির ভিতরে এক এক ঝলক বাইরের আলো এসে পড়ছে, পিছলে যাচ্ছে বারবার। ওরই মধ্যে মেয়েটির হাতের দিকে চোখ পড়ল। পরনে সালোয়ার-কামিজ। হাঁটুর ওপরে, কোলের কাছে হাতদুটি চিৎ করে রাখা। মেহেন্দি লাগানো হাত। গেরুয়া রঙের ফুল, পাতা, বিন্দু মিলিয়ে, যেন আলপনা করা। দেখে বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠল। হিন্দি সিনেমার মতো বিয়ের কনে! পালাচ্ছে না তো? শেষে ‘ইলোপ’ মামলায় ফেঁসে গিয়ে থানা-পুলিশ...সরাসরি পাশে বসা মেয়েটির মুখের দিকে তাকালুম। ছপাত করে রাস্তার আলোয় ঝলমল করে উঠল ওর বাঁদিকের গাল। না, মুখের কোথাও ক’নে ক’নে ভাব নেই। গায়ে অলংকারও নেই।

চোখে চোখে তাকিয়ে আবার মন্তব্য করলে—‘‘কী! চিনতে পারছেন নাতো!’’

—‘‘না। ঠিক...তবে কোথায় যেন দেখেছি-দেখেছি মনে হচ্ছে।’’

কোথায় যেন ভিড়ের মধ্যে একা। প্রচুর আলো। নানান কণ্ঠস্বর মিলেমিশে কেমন যেন চাপা অস্পষ্ট গোলমাল। তারই মধ্যে থেকে থেকে হেঁকে ওঠা আওয়াজ—‘‘তিন নম্বর দে।’’

—‘‘ছ’নম্বরটা আরেকটু ডিম কর...আরেকটু...আর একটু....’’

সব আলো, সমস্ত সরঞ্জাম, সকল ব্যবস্থাই সেই মুহূর্তে একজন নারীকে কেন্দ্র করে। বহু পরিচিতা হিন্দি সিনেমার নায়িকা করিশ্মা কপূর। আজকালকার চলতি হিরোইনদের কাছে সেই নায়িকা আজ প্রায় তামাদি হয়ে গিয়েছে। বিজ্ঞাপনে এলেও সিনেমার বাজারে আজ তার সেই রমরমা নেই। আট-দশ বছর আগে কপূর বংশজাত করিশ্মার গরমাগরম বাজার ছিল। চারপাশে স্তাবকরা ঘিরে থাকত। প্রযোজক-পরিচালকরা ঘুরঘুর করত ওকে মধ্যমণি করে। সেই হিরোইন হাতের তেলো ও পায়ের পাতা পেতে সমর্পণের ভঙ্গিতে বসে ছিল সেদিন একটি মেয়ের সামনে।

—‘‘আমি মুমতাজ।’’

মেয়েটি নিজে থেকেই জানাল।

—‘‘ও হ্যাঁ।’’ মনে পড়েছে ওর কথায়। ভাবনা-পূরণ।

রোগা মুমতাজ নায়িকার হাতে ও পায়ে আলতা পরিয়ে দিচ্ছিল। ভুল বললুম। মেহেন্দি লাগিয়ে দিচ্ছিল। অনেকটা লক্ষ্মীপুজোর আলপনার মতো। অমন ভিড়, হইহট্টগোলের মধ্যেও মুমতাজ একমনে ডিজাইন করছে। ওর লক্ষ্য তখন একটি ডট বা লাইন। করিশ্মা ছটফটে। এর-ওর-তার সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কথা বলছে। পাশে হাঁটু মুড়ে বসে তার পরিচারিকা একটি একটি করে আঙুর নায়িকার মুখে তুলে দিচ্ছে, সেই সাবেক কালের সম্রাজ্ঞীর মতো। ছবির পরিচালকমশায় মাঝেমধ্যে এসে মুমতাজকে তাড়া দিয়ে যাচ্ছেন—‘‘জলদি করো, জলদি।... উঃ! অউর কিতনা টাইম....’’

মুখ না তুলেই মুমতাজের জবাব—‘‘এই তো...হয়ে এল!’’

—‘‘শুকোতেই তো দু’তিন ধণ্টা লাগবে....’’ পরিচালক গজগজ করতে করতে সরে গেলেন এবং জোর গলায় হুকুম দিলেন, —‘‘ওরে! ক্লোজআপ নে! ক্লোজাপের লাইটিং কর...’’

সেই মুমতাজ! নায়িকাকে কনের ভূমিকায় সাজিয়ে দিচ্ছিল।

—‘‘অনেক দিন পর দেখা হল।’’

—‘‘হ্যাঁ। পাঁচ সাল তো হোগাহি।’’ ম্লান হাসল মেয়েটি।

—‘‘অ্যাদ্দিন দেখিনি তো কোথাও! বম্বেতেই ছিলে, নাকি....’’

—‘‘এখানেই। মরতে আর যাব কোথায়? ধান্ধার জন্য ঘোরাঘুরি করতে হয় তো!’’ চাপা রঙের মুখে শুকনো হাসি।

ভিলে পার্লের রেলপুলের তলা দিয়ে ছুটছি আমরা। দু’পাশে অন্ধকার। আর কোনও কথা খুঁজে না পেয়ে বললুম,—‘‘কাজকম্ম কী রকম চলছে?’’

—‘‘এই মোটামুটি।’’

—‘‘ফিল্ম লাইনে বিয়ে তো খুব হচ্ছে।’’

শব্দ করে হাসল মুমতাজ।

বললে, —‘‘তা হচ্ছে। তবে মেহেন্দি লাগাবার অর্ডার খুব একটা জুটছে না। কনেকে ঘটা করে সাজিয়ে বিয়ে হচ্ছে কম। চলন উঠে যাচ্ছে বোধয়। কাগজেপত্তরে হয়ে যাচ্ছে সব।’’

মেয়েটির শিক্ষাদীক্ষার দৌড় জানা নেই। তবে কথাবার্তায় বেশ স্মার্ট। স্মার্ট অথচ মার্জিত। গড়ন রোগা থেকে এখন যেন একটু ভারী হয়েছে। সাত-আট বছরে তফাত তো হতেই পারে।

—‘‘আসল বিয়ে না হলেও ছবির বিয়েতে তো ক’নে সাজাতে হয়ই....’’ আমার কথা শেষ না হতেই বলে উঠল,—‘‘তা মাঝেমধ্যে ডাক পড়ে দাদা। কম্পিটিশন খুব বেড়ে গেছে আজকাল। অনেক মেয়েই এসে গেছে এ লাইনে...’’।

—‘‘তবু নতুন পথ তো বেরিয়ে গেছে। দূরদর্শন! টিভি-পর্দায় তো রোজই দু’চার জোড়ার বিয়ে লেগেই রয়েছে।’’

—‘‘সেই ভরসাতেই তো লড়ে যাচ্ছি। সংসার সামলাচ্ছি।’’

—‘‘বিয়েশাদি করেছ?’’

—‘‘কোথায় আর করলাম! পাত্তরই জুটল না।’’ হেসে উড়িয়ে দিল, যেন ঠাট্টার কথা।

—‘‘কেন, সেই ছেলেটির কী খবর? যার সঙ্গে তোমার খুব বন্ধুত্ব ছিল!’’

—‘‘অ!’’ বলে বাঁদিকের জানলার দিকে দেখল। তারপর মুখ ঘুরিয়ে এদিকে দেখে, হেসে বললে,—‘‘কে? সেই আখতার? ও আর সহকারী পরিচালক নেই। নিজেই পরিচালক।’’ দুষ্টুমির হাসির সঙ্গে জবাব দিল মুমতাজ।

—‘‘শাদি করেছ?’’

শুনে শব্দ করে হেসে ফেলল মেয়েটা।

ট্যাক্সি ড্রাইভার সামনের ছোট আয়নায় পেছনে দেখছে। ভাবখানা ‘খুব জমে গেছে দেখছি’! একটু সরে বসলুম। হাইওয়ে দিয়ে আন্ধেরির কাছাকাছি এসে গেছি প্রায়।

হাসি শুনে মনে হল, একটু যেন মনমরা ভাব। আর এ নিয়ে ঘাঁটিয়ে কাজ নেই। তবু ও-ই হাসতে হাসতে একটা মেয়ের নাম বললে,—‘‘সি-গ্রেড ছবির বেশ নামকরা নায়িকা, সেই পরিচালকের সঙ্গে ওর বিয়ে আজ। সেই জন্যেই যাচ্ছি।’’

—‘‘কোথায়?’’

জবাব না দিয়ে মেলা হাতদুটি তুলে ধরে জিগ্যেস করলে,—‘‘আগের মতো অত ফুল-পাতা আর তেমন চলে না আজকাল। দেখুন তো কেমন হয়েছে?’’ কথার মধ্যে কোথায় যেন বিষণ্ণতার ছোঁয়া।

চলতি গাড়ির আলো-অন্ধকারে দেখলুম ওর মেলে ধরা জোড়া হাত। শিরা-ওঠা রোগা আঙুলগুলি একটু কষ্টেই যেন আধুনিক ডিজাইন ধরে আছে।

—‘‘সেই নায়িকার হাত ফর্সা। আমার মতো নয়। বেশ মানাবে।’’ নিজের মনেই বললে।

একটু কি উদাস কণ্ঠ? হয়তো আমার মনের ভুল!

প্রশ্ন করলুম—‘‘ছবির ক’নে?’’

—‘‘না, না। আমার সেই বন্ধুর সঙ্গে কাল ওর বিয়ে। ডিজাইন দেখিয়ে ওদের পছন্দ করিয়ে আনব আজ স্টুডিওতে।’’

কথা ঘুরিয়ে জানতে চাইলুম, সংসারে কে কে আছেন?

বললে,—‘‘আমার দুই ছেলেমেয়ে।’’

ছেলেমেয়ে শুনে বেশ অবাক হলুম।

—‘‘এই বললে বিয়ে হয়নি।’’

—‘‘বিধবা দিদির সন্তান। আমি ওদের ছোট-মা। আমাকে মায়ের থেকেও বেশি ভালবাসে। ছেলেটা, জান, এবার কলেজে ঢুকল। পড়াশোনায় তুখোড়। ওকে আই বি-এ করিয়ে কম্পিউটরে দেব। মেয়েটা নাচে ভাল। মাধুরীর মতো ডান্সিং স্টার বানাব ওকে। আর ডিজাইনে, রঙ্গোলিতে হাত পাকা। ওকে ‘বডি আর্ট’ বা ‘উল্কি’ শেখাব। দারুণ হাত।’’

ট্যাক্সি চলছে। মুমতাজ তার আশা-ভবিষ্যৎ গড়ে চলেছে। স্বপ্নের জগৎ...নিজের না হলেও, দিদির সন্তানদের মধ্যে দিয়ে স্বপ্নপূরণ...!

Milan Mukhopadhyay Rangoli
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy