Advertisement
E-Paper

ছন্দার মতো টাকার চিন্তা তাড়া করে অরুণাচলের আনসুকেও

ছন্দা যা করেছে, আমি ওর জায়গায় থাকলে ঠিক তা-ই করতাম। বলছেন আনসু জামসেনপা। তিন-তিন বার এভারেস্ট ছোঁয়া দুই সন্তানের মা আনসু। তার মধ্যে একই অভিযানে দু’বার এভারেস্ট জয়ের রেকর্ডও আছে অরুণাচলের এই পর্বতারোহীর। আনসু বললেন, “শেষ ক্যাম্পের পরে সামনে যখন চূড়ান্ত আরোহণের হাতছানি থাকে, তখন শুধু চুড়ো নয়, চোখে ভাসে স্পনসরের চুক্তিপত্রও।”

রাজীবাক্ষ রক্ষিত ও তিয়াষ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০১৪ ০৩:৫৭

ছন্দা যা করেছে, আমি ওর জায়গায় থাকলে ঠিক তা-ই করতাম।

বলছেন আনসু জামসেনপা। তিন-তিন বার এভারেস্ট ছোঁয়া দুই সন্তানের মা আনসু। তার মধ্যে একই অভিযানে দু’বার এভারেস্ট জয়ের রেকর্ডও আছে অরুণাচলের এই পর্বতারোহীর।

আনসু বললেন, “শেষ ক্যাম্পের পরে সামনে যখন চূড়ান্ত আরোহণের হাতছানি থাকে, তখন শুধু চুড়ো নয়, চোখে ভাসে স্পনসরের চুক্তিপত্রও।” জানালেন, যে পরিমাণ খরচ করে ঝুঁকি নিয়ে পাহাড় চড়তে হয়, ব্যক্তিগত খেলার জগতে তা সব চেয়ে বেশি। অথচ এতে অর্থাগমের উপায় নেই। তাই টাকা দিয়ে যাঁরা পাহাড়ে পাঠাচ্ছেন, তাঁদের দাবি পূরণ না হলে, পরের বার টাকা মিলবে কী করে!

এ বছর নিজের রেকর্ড ভাঙতেই ফের এভারেস্টের পথে পা বাড়িয়ছিলেন আনসু। কিন্তু এভারেস্ট বেসক্যাম্পের কাছে খুম্বু আইসফলে তুষারধসে ১৬ জন শেরপা মারা যাওয়ায় বাতিল হয়ে যায় অভিযান। তবে খালি হাতে ফেরার উপায় ছিল না। তাই এভারেস্ট না হলেও লোবুচে, পোখালডে আর আইল্যান্ড এই তিনটি শৃঙ্গ ছুঁয়ে আসেন। জানালেন, এর পিছনে যতটা না কাজ করেছে শৃঙ্গ জয়ের নেশা, তার চেয়ে বেশি তাড়া করেছে খালি হাতে ফিরলে স্পনসরশিপ না পাওয়ার ভয়।

একই কথা ছন্দাও বলেছিলেন ইয়ালুং কাং যাওয়ার পথে। তাঁর শেরপা তাশি জানিয়েছেন, খারাপ আবহাওয়া, দড়ির কমতি এ সব কারণে ছন্দাকে এগোতে বারণ করলে কেঁদে ফেলেছিলেন ছন্দা। বলেছিলেন, শৃঙ্গ না ছুঁয়ে ফিরলে সমতলে প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে। মিলবে না স্পনসরশিপ। তাই বিপদ বুঝেও এগোতে চেয়েছিলেন তিনি। ফল যে ভাল হয়নি, তা তো এখন সকলের জানা।

ছন্দা গায়েনের কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযান স্পনসর করতে উদ্যোগী হয়েছিল ‘হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশন’ (ন্যাফ)। ন্যাফের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর অনিমেষ বসু বহু বছর ধরে পর্বতারোহণ ও সেই সংক্রান্ত নানা পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত। তিনি জানালেন এটা ঠিকই যে শৃঙ্গ জয় করতে পারলে পরের বার ফের টাকা চাইতে সুবিধা হয়। তবে স্পনসরদের তরফে জয়ের জন্য আলাদা করে চাপ দেওয়া হয় না বলেই অনিমেষবাবুর দাবি। তাঁর কথায়, ইয়ালুং কাং চড়তে না পারলে যে স্পনসররা ছন্দার টাকা ফেরত নিয়ে নিতেন এমনটা নয়। তাঁর কথায়, “তাশির কথা মতো ছন্দা যদি স্পনসরশিপের কথা বলে জেদ করে থাকেন, তবে তা বোকামি।”

গত বছর অসম থেকে প্রথম এভারেস্ট ছুঁয়েছিলেন তরুণ শইকিয়া। তাঁরও একই মত। বললেন, “শীর্ষ জয় সবারই লক্ষ্য থাকে। কিন্তু কোনও চুক্তিপত্রে এমন লেখা থাকে না, যে চূড়া ছুঁতেই হবে। কেউ এমন করলে তা অনৈতিক।”

এ সব মেনে নিয়েও আনসু কিন্তু ছন্দার পক্ষেই। জানালেন শৃঙ্গ না ছুঁলে টাকা ফেরত দিতে হবে না এটা যেমন ঠিক, তেমনি এটাও ঠিক যে পরের বার সেই সংস্থা আর সাহায্য করবে না। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বললেন, “২০১১ সালে এভারেস্ট অভিযানের শেষ দিকে আবহাওয়া খুব খারাপ হয়। শেরপারা জানান, আর এগোনো আত্মহত্যার সামিল।” কিন্তু অরুণাচলের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আসা আনসু যদি এত কাছে গিয়েও বিফল হয়ে ফিরতেন, তবে পরের বার স্পনসর জোগাড় আরও কঠিন হতো। জেদ করেই শেষ পর্যন্ত বিশ্বের উচ্চতম শৃঙ্গে পা রাখেন তিনি।

কী রকম দাবি থাকে স্পনসরদের? কীসের আশাতেই বা এক জন অভিযাত্রীকে স্পনসর করে কোনও সংস্থা?

বাংলার পর্বতারোহী দেবরাজ দত্ত জানালেন, বিদেশের অভিযাত্রীদের নির্দিষ্ট স্পনসর থাকে। তার সঙ্গে শৃঙ্গ জয়ের সম্পর্ক থাকে না। কিন্তু এ দেশে এক বার স্পনসর নিয়ে অভিযানে গিয়ে সফল না হলে পরের বার সেই সংস্থা থেকে টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না প্রায়। বড় অভিযানের জন্য টাকা জোগাড় করাটাই তখন বড় অভিযান হয়ে ওঠে।

পর্বতারোহীরা বলছেন, বেসরকারি কর্পোরেট সংস্থাগুলি ‘কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি’র খাতে টাকা দেয়। এতে তাদের করের ক্ষেত্রে ছাড় মেলে। সেই লক্ষ্যেই মূলত খেলোয়াড়দের স্পনসর করে তারা। পর্বতারোহণও সেই তালিকায় পড়ে। কিন্তু কোনও ক্লাব বা সংস্থার হয়ে এই স্পনসরশিপ জোগাড় করা যতটা সহজ, ব্যক্তিগত ভাবে স্পনসর মেলা ততটাই কঠিন। তাই সাধারণত কোনও সংস্থার মাধ্যমে টাকা তুলেই অভিযাত্রীর হাতে দেওয়া হয়। এক বার অভিযানের প্রস্তুতিতেই অনেকটা টাকা আর সময় খরচ হয়ে যায়। শৃঙ্গ না ছুঁয়ে ফিরলে পরের বার ফের টাকা লাগে। সেই কারণেই সামিটের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন অভিযাত্রীরা। এক যাত্রায় একাধিক শৃঙ্গের লক্ষ্যও সেই টাকা আর সময় বাঁচানোরই নামান্তর।

স্পনসর করার বিনিময়ে সংস্থাগুলি কী সুবিধা পেতে পারে, সে ব্যাপারে বিস্তারিত জানালেন আনসু। আন্তর্জাতিক স্তরে বেসরকারি ক্ষেত্রে ৩০ হাজার টাকা থেকে ৩০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত স্পনসরশিপ মেলে। অভিযানের জন্য ইন্টারনেটে যে ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়, ৫০ হাজার টাকার স্পনসরশিপের বিনিময়ে তাতে সংস্থার নাম ওঠে। দু’লক্ষ টাকার বিনিময়ে অভিযান শেষের স্লাইড শো, মিডিয়া কভারেজে সংস্থার লোগো থাকে।

পাঁচ লক্ষ টাকার বেশি দিলে সংস্থার লোগো থাকা পতাকা শৃঙ্গের চূড়ায় উড়বে। তার ছবি এবং ভিডিও মিলবে। আরও বেশি স্পনসর করলে সম্পূর্ণ যাত্রা পথের ছবি ও ভিডিওতে দেখাতে হবে স্পনসর সংস্থার চিহ্ন।

এ ভাবেই চড়তে থাকে দর, বাড়তে থাকে প্রচার।

আনসুর কথায়, “আমার আর ছন্দার গল্পে তফাৎ নেই। কেবল আমি বেঁচে ফিরেছি, আর ও হারিয়ে গেল।”

arunachal aansu
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy