Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ন্যায় প্রতিষ্ঠা করাটাও কিন্তু রাজনীতি

লোকসভায় প্রার্থী বাছাইয়ের পদ্ধতি, পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস, রাজনীতিতে আসা, অর্থনীতির মডেল, পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে তাঁর নীতি— সব কিছু নিয়ে জয়ন্ত ঘোষালের কাছে অকপট রাহুল গাঁধী।লোকসভায় প্রার্থী বাছাইয়ের পদ্ধতি, পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস, রাজনীতিতে আসা, অর্থনীতির মডেল, পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে তাঁর নীতি— সব কিছু নিয়ে জয়ন্ত ঘোষালের কাছে অকপট রাহুল গাঁধী।

শেষ আপডেট: ১১ মে ২০১৪ ০৩:২৩
Share: Save:

মমতা বা চিটফান্ড, এ সব নিয়ে কিন্তু প্রশ্ন করব না। ভোটের সময়ে কলকাতায় গিয়েও এ সব নিয়ে অনেক কথা বলেছেন।

রাহুল গাঁধী: প্রশ্নকর্তা আপনি। এটা সম্পূর্ণ আপনার ব্যাপার। যে রকম ইচ্ছে, প্রশ্ন করতে পারেন।

প্রার্থী বাছাইয়ের পদ্ধতি নিয়ে আপনার তো কিছু সুনির্দিষ্ট মতামত আছে। ২০১৪ সালে যে ভাবে প্রার্থী বাছাই হল, তাতে আপনি খুশি?
রাহুল গাঁধী: আমার দৃঢ় বিশ্বাস, একটা দিন আসবে, যখন কংগ্রেসে প্রার্থী বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত কোনও এক জন বা দু’জন ব্যক্তি নেবেন না। শয়ে-শয়ে, হাজার-হাজার মানুষ নেবেন। এটাই তো সাধারণ মানুষের ক্ষমতা। সব দল গণতন্ত্রের কথা বলে। কিন্তু প্রার্থী বাছাইয়ের সময়ে একমাত্র কংগ্রেসই গণতান্ত্রিক ভাবে প্রার্থী বাছাই করল।

কিন্তু গোটা দেশে কতটুকু?
রাহুল গাঁধী: ঠিক, এটা ছোট্ট পদক্ষেপ। মাত্র ১৫টি লোকসভা কেন্দ্রে আমরা সংস্কার করতে পেরেছি। সেখানে কর্মীরা ইনপুট দিয়েছেন। সেই ভিত্তিতে প্রার্থী বাছাই হয়েছে। এই ১৫টি আসনের জন্য ১২ হাজার কর্মীর মতামত নেওয়া হয়েছে। ব্লক সভাপতি, জেলা সভাপতি, মহিলা কংগ্রেস সভানেত্রীসকলেই নিজেদের মত জানিয়েছেন।

তা হলেও এটা তো গোটা দেশের তুলনায় অনেক কম?
রাহুল গাঁধী: কিন্তু আমি খুব খুশি। আমেরিকার ধাঁচে এই প্রাইমারিগুলি অনুষ্ঠিত করার অভিমুখ একদম ঠিক। এটি একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া। আমরা এই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষালাভ করব। যে সব দুর্বলতা ধরা পড়বে, সেগুলিকে অতিক্রম করে এই প্রক্রিয়ার আরও সংস্কার করব।

ও, তার মানে এই সংস্কার চালিয়ে যাবেন?
রাহুল গাঁধী: বোঝার চেষ্টা করুন আমার উদ্দেশ্যটা কী? আমি দেশের সাধারণ মানুষের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে চাইছি। আমি গণতন্ত্রের কথা বলব, অথচ দলের সংগঠনে গণতন্ত্র আনব না এটা কী করে হয়? আর সেই জন্য এনএসইউআই বা যুব কংগ্রেসের মতো সংগঠনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছি। দলের ইস্তাহার তৈরিতেও মানুষের মত নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছি। সেটাও কি গুরুত্বপূর্ণ নয়?

কিন্তু আপনার এই চেষ্টার প্রতিক্রিয়া কী হয়েছে?
রাহুল গাঁধী: এটা তো ওয়ান টাইম ইভেন্ট নয়। এর গুরুত্ব অসীম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই ভাবনার একটি শিকড় আছে। আমার চেষ্টাও অপরিবর্তনীয় প্রক্রিয়া। রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার করতে গেলে প্রথমে রাজনৈতিক দলগুলির সংস্কারের অভিমুখ ঠিক করতে হবে।

পশ্চিমবঙ্গে এই পরীক্ষা করলেন না কেন?
রাহুল গাঁধী: (মুচকি হাসি, এক সেকেন্ডের নীরবতা... তার পর...) আমরা কলকাতার একটি আসনে প্রাইমারি করেছি। একটা জিনিস বোঝার চেষ্টা করুন। প্রাইমারিটা প্রথম পদক্ষেপ। প্রক্রিয়াটি দীর্ঘমেয়াদি। রাতারাতি বদলে দেওয়া যাবে না। তবে যে ভাবে শুরু হয়েছে, তাতে আমি খুশি। পরে একে আরও এগিয়ে নিয়ে যাব।

২০১৬-এ বিধানসভা। তখনও কি এই পরীক্ষা চালাবেন?
রাহুল গাঁধী: আমি কমিটেড। তবে বড় পর্যায়ে এই প্রাইমারিগুলিকে করতে হলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছেলেমেয়ে দরকার। পরিকাঠামোরও প্রয়োজন। সেই পরিকাঠামো পশ্চিমবঙ্গে কী ভাবে তৈরি হবে, তা নিয়ে সকলের সঙ্গে কথা বলতে হবে। অপেক্ষা করুন। ঠিক সময়ে সিদ্ধান্তগুলি নেব।

পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস নিয়ে কি আপনি সিরিয়াস?
রাহুল গাঁধী: পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের হৃতমর্যাদা ফিরে পাওয়া বড় কাজ। ৪২টি আসনেই লড়ছি। সিরিয়াস না-হলে লড়ব কেন? ছাত্র পরিষদ আর যুব কংগ্রেসে দু’রাউন্ড নির্বাচন হয়েছে। মৌসম নূর, শুভঙ্কর সরকার, সাবিনা ইয়াসমিনের মতো নবীন নেতা-নেত্রীদের আমরা তুলে এনেছি। আমি নিশ্চিত, ভবিষ্যতে পশ্চিমবঙ্গকে মজবুত করতে এঁরাই সক্রিয় ভূমিকা নেবেন। তা ছাড়া, রাজ্যে দলের সভাপতি করলাম অধীর চৌধুরীর মতো সক্রিয় নেতাকে, যিনি রাস্তায় নেমে লড়াই করছেন। কংগ্রেসকে শক্তিশালী ও চনমনে করেছেন।

নির্বাচনের মাত্র দু’মাস আগে কেন নতুন সভাপতি বসালেন?
রাহুল গাঁধী: গত কয়েক মাস ধরে আমরা বিভিন্ন রাজ্যে সভাপতি নিয়োগ করেছি। এই সময়কে বেছে নেওয়া হয়েছে অনেকগুলো কারণে। সব দিক বিবেচনা করে আমাদের মনে হয়েছিল, অধীর ডায়নামিক এবং কমিটেড লিডার। এমন একটা সময়ে তাঁকে সভাপতি করলে কংগ্রেস এবং পশ্চিমবঙ্গ দুটোই পুনরুজ্জীবিত হবে।

অধীর চৌধুরীর কথা থাক। আপনার সম্পর্কে প্রশ্ন করি। আপনি কি রাজনীতির ব্যাপারে উদাসীন?
রাহুল গাঁধী: না। আমি ভারতের রাজনীতির মধ্যে গভীর ভাবে আছি। আগামী দিনেও থাকব। এই রাজনীতির মানেটা আমার কাছে ঠিক কী, সেটা নিয়ে আপনার সঙ্গে আমার বিতর্ক হতে পারে। রাজনীতি মানেই মন্ত্রী হওয়া, সাংসদ হওয়া সেটাই জীবনের অভিলাষ বা লক্ষ্য হতে পারে না। ভারতের হতদরিদ্র মানুষের জন্য ন্যায় প্রতিষ্ঠা করাটাও কিন্তু রাজনীতি।

কিন্তু আপনি রাজনীতিতে এলেন কেন? কোনও ভিতরের আর্তি? বিলেতে ডিউক অব এডিনবরা ঠাট্টা করে বলেছিলেন, রাজতন্ত্র ওখানে পারিবারিক ব্যবসা। আপনি কি সেই কারণেই রাজনীতিতে অংশ নিয়েছেন?
রাহুল গাঁধী: আমি যে পরিবারে জন্মেছি, সেই পরিবারে জন্মানোর ব্যাপারে আমার তো কোনও হাত নেই। কিন্তু আমি যে রাজনীতি করব, ছোটবেলা থেকেই এমনটা ভাবিনি। বাবা যে দিন মারা গেলেন, সে দিনই ভিতর থেকে আমি রাজনীতিতে যোগ দিয়েছি। সে দিনই আমার মনে হয়েছিল, যে মানুষগুলির জন্য কাজ করতে গিয়ে বাবা মারা গেলেন, তাঁদের জন্য আমাকেও কাজ করতে হবে। নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে দিয়ে গিয়ে যত পরিণত হয়েছি, তত রাজনীতি করার আর্তি অনুভব করেছি। আমি রাজনীতি করব, কি করব না, সেই সিদ্ধান্তটা আমার উপর কেউ চাপাননি। এই সিদ্ধান্ত একান্ত ভাবেই আমার নিজস্ব।

আসলে আমি কোথায় জন্মেছি, সেটা ইনসিডেন্টাল। ঘটনাচক্রে আমি এই পরিবারে জন্মেছি। কিন্তু আমি এ দেশের এক জন নাগরিক। আমার বোধবুদ্ধি দিয়ে আমি এই ব্যবস্থাটাকে ক্রমাগত বদলাতে চাইছি। রাজনৈতিক ব্যবস্থা একটা গতিশীল ধারণা। সময়ের হাত ধরে আধুনিকতার মধ্যে দিয়ে নানা ভাবে এটা পরিবর্তিত হয়। ’৪৭ সালের রাজনৈতিক ব্যবস্থা আর ২০১৪ সালের রাজনৈতিক ব্যবস্থা কিন্তু এক নয়। ব্যবস্থার ত্রুটিগুলির বিরুদ্ধে লড়াইটা আন্তরিক ভাবে চালানো হচ্ছে কি না, সেটাই সব চেয়ে বড় প্রশ্ন। এর বিপরীত দিক থেকেও আপনি ভাবুন। আমজনতা থেকে উঠে আসা এক জন নাগরিক যদি রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ করার পর নিজেই পরিবর্তিত হয়ে যান, মানুষের স্বার্থে কাজ না করেন এবং যদি একটি কায়েমি গোষ্ঠীর হাতের পুতুল হন, তখন সেই ব্যক্তি পরিবারতন্ত্রের প্রতিনিধি না হলেও তিনি কোন মেধাতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করবেন? সেই মেধাটা কার মেধা? সমাজের কোন অংশের স্বার্থে কী ভাবে মেধার উৎকর্ষটা কাজ করছে, সেটাই বড় কথা। রাজনৈতিক পরিবারের সদস্যেরা অন্য পেশার মতো রাজনীতিতেও আসছেন। কেন না, শৈশব থেকে তাঁরা ওই পরিমণ্ডলে বড় হন। কিন্তু এখানে সব চেয়ে বড় প্রশ্ন হল, এই দেশ এবং সমাজের জন্য কিছু করার আন্তরিকতা। সেটা সেই ব্যক্তির মধ্যে আছে না নেই। আমি কোনও বড় কথা বা বড় দাবি করতে চাইছি না। শুধু এটুকু বলতে পারি যে একটা বহুত্ববাদী, অসাম্প্রদায়িক ভারত গড়ার কাজে ব্রতী হয়েছি। আর সেটা করছি মানুষের সমর্থন নিয়েই।

গত দশ বছরে তা হলে সরকারে এলেন না কেন?
রাহুল গাঁধী: রাজনীতিতে আমার দায়বদ্ধতা সরকারি পদে যাওয়ার থেকে অনেক বড়। মন্ত্রী হওয়াটাই আমার প্রধান উপজীব্য ছিল না।

কিন্তু মানুষ কাজ না দেখেই আপনাকে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসাবে, এটা কি ঠিক?
রাহুল গাঁধী: দলের এক জন সিনিয়র কর্মী হিসেবে আমি সংসদে বেশ কিছু দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ সরকারকে দিয়ে করাতে ও সংসদে পাশ করাতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলাম।

সংসদেও তো বক্তৃতা দিতে কম দেখেছি।
রাহুল গাঁধী: যখন বলার প্রয়োজন হয়েছে, বলেছি। কিন্তু শুধু বক্তৃতা দেওয়া তো কাজ নয়। এই ধরুন জমি অধিগ্রহণ বিল। একটা একশো বছরের পুরনো আইন। সেটিকে পরিবর্তন করিয়ে সংসদে পাশ করানোর জন্য বিভিন্ন স্তরে কতখানি লড়াই করতে হয়, সেটা ভাবতে পারেন? তার পর ধরুন লোকপাল বিল। প্রায় ৪৫ বছর পর শেষ পর্যন্ত বিলটি পাশ হল। ভেন্ডরদের নিরাপত্তা বিল, তথ্য জানার অধিকার, একশো দিনের কাজ, খাদ্য নিরাপত্তা বিল--এগুলো নিয়ে ক্রমাগত দলের পক্ষ থেকে চাপ দিয়ে এসেছি। সেই লড়াইয়ে জিতেছি। বিরোধীরা সংসদ চলতে দিচ্ছিলেন না। একটা দুর্নীতি বিরোধী আইন আনার জন্যও চেষ্টা চালাচ্ছিলাম। বিরোধীরা বাধা দিয়েছেন। তবু এই লড়াই চলবে।

সরকারের চেয়েও দলকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
রাহুল গাঁধী: দেখুন, গত বছরের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত আমি দলের এক জন সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। যুব কংগ্রেস ও ছাত্র সংগঠনের দায়িত্বে ছিলাম। আমার মধ্যে সিঙ্গলনেস অব পারপাস কাজ করে। যে দায়িত্বটা আমাকে দেওয়া হয়, সেই দায়িত্বটা আমি পালন করি। আগে যেখানে গুটি কতক লোক সংগঠনের নেতা ঠিক করতেন, সেখানে এখন লাখ-লাখ কর্মী তাঁদের নেতাদের বেছে নিচ্ছেন। যুব কংগ্রেসে এখন ছ’লক্ষ নির্বাচিত পদাধিকারী। যেমন প্রাইমারির কথা বলছিলাম, সে ভাবে আমরা জাতীয় স্তরে যুব কংগ্রেসের সংগঠনেও কাজ করেছি। দলের ইস্তাহার তৈরিতে আমরা পাঁচ লক্ষ মানুষের মতামত নিয়েছি। যে দায়িত্বটা আমাকে দেওয়া হয়েছে, নিষ্ঠা ভরে পালন করেছি।

এ বার আপনি ৭ নম্বর রেসকোর্স রোডের বাসিন্দা হওয়ার জন্য লড়ছেন। আপনি কি প্রস্তুত?
রাহুল গাঁধী: (মাথা নেড়ে) দল এবং দেশের মানুষ আমাকে যে কর্তব্য পালনের দায়িত্ব দিয়েছেন, তার জন্য আমি নিশ্চয়ই প্রস্তুত। কিন্তু এই প্রস্তুতির মানেটা কী? একটা প্রস্তুতি হল, ঢক্কা নিনাদ। লাউড চিৎকার। আর একটা হল, দেশের সমস্যাগুলিকে গভীর ভাবে অনুভব করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা। মেধার উৎকর্ষ দিয়ে প্রশাসনিক ক্ষিপ্রতা গড়ে তোলা। এই প্রস্তুতিটা নিজস্ব ব্যাপার। আপনাকে সাক্ষাৎকার দিয়ে এই প্রস্তুতি প্রমাণিত হয় না।

খুব তাড়াতাড়ি অর্থনীতি নিয়ে দু’টি প্রশ্ন করি। ইউপিএ-৩ কি ইউপিএ ২-কেই অনুসরণ করবে? নাকি অর্থনীতি নিয়ে আপনার কোনও নতুন ভাবনা রয়েছে? ইউপিএ মডেলে বণ্টনে জোর দেওয়া হয়েছে আর এনডিএ মডেলে উৎপাদনে জোর দেওয়া হয়েছিল। আপনি কী বলেন?
রাহুল গাঁধী: বণ্টন আর উৎপাদনের ফারাক করাটাই অতি সরলীকরণ। এটা অনেকটা কী রকম জানেন তো, আমি যে বিনিয়োগ করছি, সেটি আজকের জন্য করছি, না ভবিষ্যতের জন্য করছি। আসলে প্রয়োজন, এই দু’টির মধ্যে ভারসাম্য রাখা। আর বণ্টন কিন্তু ভবিষ্যতের উৎপাদন বাড়াতেই সাহায্য করে। এনডিএ-র চেয়ে ইউপিএ-র আর্থিক বৃদ্ধির হার অনেক দ্রুত। কিন্তু আমরা ১০-১৫ বছরের উৎপাদনেরও প্রস্তুতি নিয়েছি। এই যে একশো দিনের কাজ, খাদ্য নিরাপত্তা, জমি বিল বা আদিবাসী বিল এগুলির মাধ্যমে বণ্টন দীর্ঘমেয়াদি উৎপাদনের দিকে নিয়ে যাবে। আজকের গরিব মানুষই ভবিষ্যতের উৎপাদক। তাঁরাই ভবিষ্যতের বাজার। প্রত্যেক ব্যক্তির মর্যাদা আছে। কংগ্রেস সেই মর্যাদাটি দিতে চায়। এনডিএ তো বালকো-র মতো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকেও বেসরকারি হাতে দিয়েছিল। ওদের কোনও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ছিল না।

কিন্তু সামাজিক ন্যায় কি আয় বৃদ্ধির ফল? নাকি আয় বাড়ুক বা না বাড়ুক, যেনতেন প্রকারেণ ন্যায় প্রতিষ্ঠা করাটাই লক্ষ্য?
রাহুল গাঁধী: আপনার কী ধারণা?

ইউপিএ সরকার সম্পর্কে ধারণা হয়েছে যে, আপনারা ন্যায় প্রতিষ্ঠার নামে অহেতুক ভর্তুকি-নির্ভর হয়েছেন এক ধরনের ঝোলাওয়ালা সংস্কৃতি। সেই ভর্তুকিও মানুষের কাছে যায়নি। ন্যায়ও প্রতিষ্ঠা হয়নি। নেহরু, ইন্দিরা গাঁধীরা কিন্তু একমাত্র উৎপাদনের উপর জোর দিয়েছিলেন।
রাহুল গাঁধী: আসলে এক কথায় বলতে গেলে প্রয়োজন একটা ভারসাম্যের। সর্বদাই উৎপাদন এবং আয়বৃদ্ধিকেই সমাধান হিসেবে দেখাটা যেমন ঠিক নয়, আবার মনে রাখবেন সামাজিক ক্ষেত্রে যে ব্যয় করা হয়েছে সেটাও মূল আর্থিক বাজেটের প্রেক্ষিতে খুবই কম। খুব বিরাট খরচা এ ক্ষেত্রে ইউপিএ সরকার করেনি। আজকের দিনে সামাজিক বণ্টনকে অবজ্ঞা করা যায় না। আবার সামাজিক বণ্টনই বৃদ্ধির দরজা খুলে দেয়।

বণ্টন আর উৎপাদন নিয়ে ইউপিএ ৩-এ আপনার ভাবনা কী?
রাহুল গাঁধী: ভুলে গেলে চলবে না, ইউপিএ সরকারের আমলে কিন্তু ভারতে যথেষ্ট আয়বৃদ্ধি হয়েছে। এক দিকে শিল্পমহলের ভ্যালু ক্রিয়েশন হয়েছে। অন্য দিকে, ১৫ কোটি মানুষের দারিদ্র মুক্তি হয়েছে। কোনও জমানায় এতটা হয়নি। ২০০৪ সালে ভারত যে জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল, সেই জায়গা থেকে আমরা অনেক এগিয়ে এসেছি। স্বাভাবিক ভাবেই ইউপিএ ৩-এ প্রত্যাশা অনেক বেশি।

ইউপিএ ৩-এ আপনার অগ্রাধিকার কী?
রাহুল গাঁধী: উৎপাদনে বিপ্লব আনা। গোটা পৃথিবীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। যেমন আমরা শুনি ‘মেড ইন চায়না’, এ বার আমরা শুনব ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’। শিল্প করিডরে আমরা অনেক কাজ করেছি। এ বার তার ফল পাওয়া যাবে। এতে চাকরি হবে। বিশেষ করে যুবকদের। দক্ষতা বাড়াতে অনেক ব্যবস্থা করেছি। কৃষক, শ্রমিক, কারিগর এঁদের নিয়ে এ বার দেশ গড়তে হবে। আমরা এঁদের স্বাস্থ্যের অধিকার, পেনশন, আবাসন দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। এগুলি দিলে কম রোজগারের পরিবারেও আর্থিক নিরাপত্তা তৈরি হবে। আর তৃতীয় অগ্রাধিকার হচ্ছে, মহিলাদের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ভূমিকা বাড়ানো। এমনকী, রাজনীতিতেও আমরা অনেক বেশি সংখ্যায় মহিলাদের পঞ্চায়েত প্রধান, বিধায়ক, সাংসদ করার চেষ্টা করেছি।

পশ্চিমবঙ্গেও এখন বিজেপি খুব আক্রমণাত্মক। সিপিএম এত বছর ধরে ছিল। এখন তৃণমূল ক্ষমতায়। আপনারা কোথায়? পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে আপনার নীতি কী?
রাহুল গাঁধী: পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে বামেরা ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। তারা শিল্পের বৃদ্ধি স্তব্ধ করেছে। প্রশাসনের রাজনীতিকরণ হয়েছে। হিংসাকে প্রশ্রয় দিয়েছে। এখন পরিবর্তনের স্লোগান দিয়ে সেখানে ক্ষমতায় এসেছে তৃণমূল। কিন্তু বাস্তবে পতাকার রং বদলানো ছাড়া পরিবর্তন কিছুই হয়নি। দু’টো দলই পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে পিছিয়ে দিয়েছে। অন্য দিকে দেশের সব প্রাকৃতিক সম্পদ, জমি এক জন বা দু’জন বড় শিল্পপতিকে দিয়ে দেওয়াই যেন বিজেপির কাজ। তা হলেই যেন সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এই দুই মতাদর্শ ‘টু এন্ডস অব স্প্রেকট্রাম’। এই মতাদর্শ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে না।


আপনার মডেল?
রাহুল গাঁধী: পার্টনারশিপ। এক দিকে ব্যবসায়িক উন্নয়নের স্বার্থ। অন্য দিকে গরিব মানুষের স্বার্থ। আমি বলছি, এটা সম্ভব। পশ্চিমবঙ্গের সম্ভাবনা অসীম। একটা সময় কলকাতার সঙ্গে গোটা পৃথিবীর যোগাযোগ ছিল। এটি ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র। তার পক্ষে আবার সেই আসন দখল করাটা মোটেই অসম্ভব নয়। আমরা যদি এই অংশীদারিত্বকে গুরুত্ব দিই, তা হলে বাংলা ফের শিল্পায়ন, শিল্প-সংস্কৃতি -সহ বহু বিষয়েই শীর্ষে চলে আসতে পারে। আর কংগ্রেসই একমাত্র দল, যারা এই অংশীদারিত্ব ঘটিয়ে বাংলাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। কেন্দ্রে যত দিন কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল, পশ্চিমবঙ্গকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছে। এনডিএ যে অর্থ সাহায্য দিয়েছিল, তার পাঁচ গুণ বেশি অর্থ সাহায্য আমরা দিয়েছি। তা সত্ত্বেও এই তহবিলকে রাজ্য সরকার পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারেনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

jayanta ghoshal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE