Advertisement
২১ মে ২০২৪
বিচারপতি নিয়োগ

প্যাঁচ কংগ্রেসের, ফিরুক কলেজিয়ামই

জাতীয় বিচারপতি নিয়োগ কমিশন গঠনের আইন বাতিল হয়ে যাওয়ায় বেজায় অস্বস্তিতে পড়েছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। তাদের বিড়ম্বনা আরও বাড়িয়ে তুলতে এ বার সুপ্রিম কোর্টের রায়কেই হাতিয়ার করল কংগ্রেস। তাদের এখন দাবি, নতুন করে বিচারপতি নিয়োগের আইন করার পথে না গিয়ে, সরকার আগেকার কলেজিয়াম ব্যবস্থাই ফিরিয়ে আনুক।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:০৬
Share: Save:

জাতীয় বিচারপতি নিয়োগ কমিশন গঠনের আইন বাতিল হয়ে যাওয়ায় বেজায় অস্বস্তিতে পড়েছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। তাদের বিড়ম্বনা আরও বাড়িয়ে তুলতে এ বার সুপ্রিম কোর্টের রায়কেই হাতিয়ার করল কংগ্রেস। তাদের এখন দাবি, নতুন করে বিচারপতি নিয়োগের আইন করার পথে না গিয়ে, সরকার আগেকার কলেজিয়াম ব্যবস্থাই ফিরিয়ে আনুক।

সরকারকে প্যাঁচে ফেলতে দু’টি পথ ছিল কংগ্রেসের সামনে। l মোদী সরকারের যোগ করা প্রস্তাবগুলি বাদ দিয়ে ইউপিএ জমানার বিলটিই পাশ করানো হোক— এই দাবি তোলা। l শীর্ষ আদালতের কথা মতো কলেজিয়াম ব্যবস্থাকে মাজাঘষার কাজে সহযোগিতা করা ও সেই ব্যবস্থাতেই বিচারপতিদের দ্রুত শূন্য পদ পূরণের দাবি তোলা।

সাংবিধানিক বেঞ্চের রায় নিয়ে মোদী মন্ত্রীরা, বিশেষ করে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি যে রকম কড়া সমালোচনা করেছেন রায়ের, সেটাকেই অস্ত্র করে কংগ্রেস আজ দ্বিতীয় পথটি নিল। বিচার বিভাগের উপরে নিয়ন্ত্রণ কায়েমের চেষ্টা চলছে এই অভিযোগ তুলে কংগ্রেস হাইকম্যান্ড আজ কলেজিয়াম ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি জানাল।

নতুন করে আইন করা হবে, এমন কথা সরকারি ভাবে ঘোষণা করা হয়নি এখনও। সংবিধান সংশোধনী বিলে নিজেদের শর্তগুলি রেখে দিয়ে তা যে রাজ্যসভায় পাশ করানো অসম্ভব, জমি বিলে হাত পোড়ানোর পরে সেটা ভালই জানেন নরেন্দ্র মোদী, অরুণ জেটলিরা। তাঁদের কাছে এটা স্পষ্ট, বিচারপতি নিয়োগের নয়া আইন করতে গেলেই কংগ্রেস বলতে পারে, মনমোহন জমানাতেই কলেজিয়াম ব্যবস্থায় ইতি টেনে বিচারপতি নিয়োগ কমিশনের গঠনের জন্য বিল আনা হয়েছিল। মোদী সরকার তাতে নতুন যে সব প্রস্তাব জুড়েছিল, সেগুলির কারণে আইনটিই বাতিল হয়ে গিয়েছে। নিজেদের প্রস্তাবগুলি বাদ দিয়ে সরকার এ বার ইউপিএ জমানার বিলটিকেই পাশ করানোর চেষ্টা করুক। মোদী সরকারের জমি অধিগ্রহণ বিল ও অধ্যাদেশের ক্ষেত্রেও ঠিক মনমোহন জমানার আইন বহাল রাখার দাবিতে অনড় থেকে সাফল্য পেয়েছে সনিয়া ও রাহুল গাঁধীর দল। তাই এই ক্ষেত্রে আগে থেকে জল না মেপে নতুন আইন করার কথা তড়িঘড়ি ঘোষণা করতে চাইছে না সরকার।

সরকার দ্বিধায় থাকলেও সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ গত শুক্রবার মোদী জমানার আইনটি বাতিল করে দেওয়া পরই প্রধান বিচারপতি এইচ এল দাত্তু কলেজিয়াম ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য সক্রিয় হয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের শূন্য পদগুলিতে বিচারপতি নিয়োগ বা মেয়াদ বাড়ানোর জন্য খুব শীঘ্রই তিনি কলেজিয়ামের বৈঠক ডাকতে পারেন বলেও খবর পাওয়া যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতেই কংগ্রেস আজ দাবি করে, অবিলম্বে বিচারপতি নিয়োগের জন্য পুরনো কলেজিয়াম ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনুক সরকার। কারণ, সরকার ও সর্বোচ্চ আদালতের মধ্যে টানাপড়েনের কারণে এত দিন ধরে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে।

এই মুহূর্তে বিভিন্ন হাইকোর্টের তিরিশ জন বিচারপতির মেয়াদ বাড়ানো জরুরি। সুপ্রিম কোর্টে তিন জন বিচারপতির পদ শূন্য রয়েছে। প্রধান বিচারপতি ও আরও দুই বিচারপতির মেয়াদও শেষ হতে চলেছে। তা ছাড়া সব ক’টি হাইকোর্ট মিলিয়ে ৪০৬ জন বিচারপতি পদ শূন্য রয়েছে। অন্তত সাতটি হাইকোর্টে অস্থায়ী প্রধান বিচারপতিকে দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। মামলার পাহাড় জমে ভোগান্তি বাড়ছে মানুষের। আনন্দ শর্মার বক্তব্য, সাংবিধানিক কাঠামোয় এই পরিস্থিতি দীর্ঘদিন ধরে চলতে পারে না। এবং সেই কারণেই দ্রুত কলেজিয়াম ব্যবস্থা ফিরিয়ে এনে বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার দাবি জানাচ্ছে কংগ্রেস।

প্রশ্ন হল, কংগ্রেসই অতীতে কলেজিয়াম ব্যবস্থায় ইতি টানতে বিল এনেছিল। তারা কেন এখন সেই ব্যবস্থার পক্ষে দাঁড়াচ্ছে? এর পিছনে মূলত তিনটি কৌশল দেখতে পাচ্ছেন বিজেপি ও কংগ্রেসের নেতারা।

• প্রধান বিচারপতি দাত্তুর তৎপরতা সরকার ও বিচার বিভাগের মধ্যে সংঘাত বাড়াবে। সেই সংঘাতের আঁচে হাওয়া জোগাতেই কংগ্রেস আজ কলেজিয়াম ব্যবস্থায় ফেরার দাবি তুলেছে।
• নতুন করে বিচারপতি নিয়োগ কমিশন গঠন এখনও বিস্তর বাধা। কাজটি সময়সাপেক্ষও। এর মধ্যে প্রধান বিচারপতি দাত্তু যে ভাবে শূন্য পদ পূরণের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন, তার পাশে দাঁড়ালে আম আদমির সমর্থন বেশি পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব।
• সরকার যত বিচারপতি দাত্তুর পদক্ষেপের বিরোধিতা করবে, কংগ্রেস ততই প্রচার করতে পারবে, কেন্দ্র এখনও বিচার বিভাগের উপরে নিয়ন্ত্রণ কায়েমের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

এই কংগ্রেসই অতীতে বিচারপতি নিয়োগে দুর্নীতি ও স্বজনপোষণ বন্ধ করতে একটি নিয়োগ কমিশন গড়তে চেয়ে বিল এনেছিল সংসদে। বিজেপি শিবির তাই কংগ্রসের নয়া অবস্থানকে ভোল বদল বলে মনে করলেও, কংগ্রেসের নেতাদের মতে এটা ভূমিকা-বদল মাত্র। অতীতে ইউপিএ জমানায় বিচার ব্যবস্থার অতিসক্রিয়তা নিয়ে কংগ্রেস যখন উষ্মা প্রকাশ করত, তখন আদালতের পর্যবেক্ষণকে রাজনৈতিক অস্ত্র করত বিজেপি। আপাত ভাবে কংগ্রেস এখন সেই রাজনীতিই করছে বলে মনে হলেও আনন্দ শর্মার দাবি, বিচার প্রক্রিয়ায় গতি আনার বৃহত্তর স্বার্থেই কংগ্রেস এই অবস্থান নিয়েছে।

দু’দশক ধরে চলা কলেজিয়াম ব্যবস্থার ফাঁকফোকর নিয়ে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সেগুলি দূর করার জন্য সব দলের সমর্থন নিয়ে মোদী সরকার যে আইন পাশ করেছিল, সুপ্রিম কোর্ট তা বাতিল করেছে, বিচারপতি নিয়োগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের আশঙ্কা প্রকাশ করে। সরকারি ভাবে না হলেও অর্থমন্ত্রী ব্যক্তিগত ভাবে সেই রায়ের সমালোচনা করে কাল ফেসবুকে লেখেন, ‘‘সর্বোচ্চ আদালতের রায় চূড়ান্ত হলেও অব্যর্থ নয়। গণতন্ত্রে অনির্বাচিতদের স্বৈরাচার চলতে পারে না।’’ জেটলির এই মন্তব্যকেই এখন রাজনৈতিক হাতিয়ার করছে কংগ্রেস। আনন্দ শর্মা জানান, একটি কমিশন গড়ে বিচারপতি নিয়োগের পক্ষে ছিল কংগ্রেসও। কিন্তু সরকার বিচারপতি নিয়োগে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে সেই বিল বদলেছে।

ওই বিল পাশের সময়ও আপত্তি করেছিল কংগ্রেস। গত শুক্রবার আইনটি খারিজ হওয়ার পর ঘরোয়া ভাবে কংগ্রেসের তরফে সরকারকে জানানো হয়, আইনটিতে ফের সংশোধন করার জন্য কংগ্রেস আলোচনায় প্রস্তুত। কিন্তু তার পরেও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী যে ভাষায় সুপ্রিম কোর্টের অমর্যাদা করেছেন, তাতে আলোচনার পথটাই বন্ধ হয়ে যায়। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের উপরে নিয়ন্ত্রণ কায়েমের যে মনোভাব সরকার দেখাচ্ছে, সেটাই সব থেকে আশঙ্কার বিষয়।

সরকার নয়া আইন করতে চাইলে কী হবে?

আনন্দর কথাতেই এ দিন স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, সর্বসম্মতির আশা এখন দূর অস্ত্। কংগ্রেসকে পাশে পেতে গেলে এ বার সরকারকে মাথা নোয়াতে হবে। নইলে বিচারপতি নিয়োগ কমিশন গঠনের ভবিষ্যৎ ফের জমি বিল বা পণ্য পরিষেবা কর বিলের মতোই হতে চলেছে। কংগ্রেস আপাতত তাই কলেজিয়ামেই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

abpnewsletters
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE