প্রচার: রাস্তার ধারে পোস্টার। ইনসেটে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী (বাঁ দিকে) প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন ও বিরোধী নেতা বিল শর্টেন। নিজস্ব চিত্র, ফাইল ছবি
প্রায় দেড় মাস ধরে ভোটবাদ্যিতে সরগরম হয়ে রইল ভারতভূমি। সে দেশে যে দিন ভোট শেষ হচ্ছে, সেই ১৯ মে-র আগের দিন, অর্থাৎ আগামিকাল, অস্ট্রেলিয়ায় ৪৬তম পার্লামেন্ট নির্বাচন। সেই দিনই জানা যাবে ফল। ভারতে নির্বাচনের ফলাফল জানতে অবশ্য সেই ২৩ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
ভারতীয় নির্বাচনের ফলের দিকে তাকিয়ে আছে অস্ট্রেলিয়াও। ভারতের সঙ্গে এ দেশের রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক মোদী জমানায় বেশ গভীর হয়েছে। এ দেশে পড়তে আসা ভারতীয় ছাত্ররা অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ দেশের সরকার জানে, ভারতীয়দের মতো প্রতিভাবান, পরিশ্রমী ও নিরুপদ্রব মানুষ খুব কমই আছে। বেশ কয়েক বছর ধরেই দেওয়ালির আগে অপেরা হাউস আলোকিত হয় দেওয়ালি উদ্যাপনে। এই বছরই দেওয়ালির ঠিক আগে স্থানীয় এমপি-র ‘গ্রিটিংস কার্ড’ পেয়ে বেশ অবাক হয়েছিলাম।
সদ্য ফিরেছি কলকাতা থেকে। দেশের ভোট-প্রস্তুতি এখনও স্মৃতিতে উজ্জ্বল। সেই তুলনায় অস্ট্রেলিয়ায় ভোটে বিশেষ হাঁকডাক হয় না। আমি থাকি সিডনির পশ্চিমে পেনরিথ ভ্যালি এলাকার ছোট্ট শহর ওয়েরিংটনে। খুবই নিরিবিলি, শান্ত জনপদ। ইউরোপীয় ধাঁচে সাজানো শহরটিতে নানা সম্প্রদায়ের মানুষের বাস। এখানকার জীবনযাত্রা নির্ঝঞ্ঝাট, মানুষজনও নির্বিরোধী।
ভারতে নির্বাচনী প্রচারের বহর দেখলে অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতিকেরা নিশ্চয় লজ্জা পাবেন। সংবাদমাধ্যমে প্রচারের তেমন বাহুল্য নেই। প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন আর বিরোধী নেতা বিল শর্টেনের তরজা একটি বারের জন্যও শালীনতার সীমা অতিক্রম করেনি। আমাদের ছোট্ট শহরেও ভোট প্রচার বলতে শুধু রাস্তার ধারে কয়েকটা পোস্টার বা হাতে হাতে প্রচার-পুস্তিকা বিলি।
প্রতিবেশী ও সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, তাঁরা কেউই নির্বাচন নিয়ে খুব একটা ভাবিত নন। তবে সকলে তাকিয়ে রয়েছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা যদি কমে। দৈনন্দিন কয়েকটি বিষয় নিয়েও জোর আলোচনা চলছে। মধ্যবিত্তরা চাইছেন, আয়কর যদি কিছুটা কমে বা অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের পেনশনটা যদি একটু বাড়ে। ভোটপ্রার্থী রাজনীতিকদের আশ্বাসের খামতি এ দেশেও নেই। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি, পরিবহণ, সব কিছুতেই প্রতিশ্রুতির বন্যা। অস্ট্রেলিয়া পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশগুলির একটি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা বেশ খরচসাপেক্ষ। এ নিয়ে মধ্যবিত্তের প্রচুর অভিযোগ রয়েছে। সরকার ঋণ দিলেও তার পরিমাণ খুব বেশি নয়। নির্বাচনী আলোচনায় এ ধরনের কথাগুলো বারবার উঠে এসেছে। তা ছাড়া, এ বার পরিবেশ রক্ষার বিষয়টিও খুব গুরুত্ব পাচ্ছে। গত পাঁচ বছরে এ দেশের গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। এই নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মরিসনের অবস্থান যথেষ্ট সমালোচিত হয়েছে। অন্য দিকে, বিরোধী নেতা বিল শর্টেনের আশ্বাস, তিনি প্রধানমন্ত্রী হলে পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ করবেন।
এ দেশে তিন বছর অন্তর কেন্দ্রীয় নির্বাচন হয়। অধিকাংশ সময়েই নির্বাচনটি হয় ‘ডাবল ডিজ়োলিউশন’। যেমন এ বার। অর্থাৎ একই সঙ্গে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ‘হাউস অব রিপ্রেজ়েন্টেটিভস’ এবং উচ্চকক্ষ সেনেটে নির্বাচন হবে। ভোট হবে হাউসের সব ক’টি (১৫১) আসন এবং সেনেটের ৭৬টির মধ্যে ৪০টি আসনে। এখন মসনদে রয়েছেন লিবারাল নেতা স্কট মরিসন। তাঁর ফের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে বাধা লেবার নেতা বিল শর্টেন। যে দল হাউসে ৭৬ বা তার বেশি আসন পাবে, তারাই আগামী তিন বছর ক্ষমতায় থাকবে।
গত বারো বছরে অস্ট্রেলিয়ার রাজনৈতিক চালচ্চিত্র অনেকটাই বদলে গিয়েছে। একটা সময়ে এ দেশে মানসিক রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করার সময়ে জিজ্ঞাসা করা হত, দেশের প্রধানমন্ত্রী কে। কারণ, যিনি প্রধানমন্ত্রী হতেন, তিনি বেশ কয়েক বছর সেই আসনে থাকতেন। ২০০৭ সাল থেকে ছবিটা অনেকটাই পাল্টে গিয়েছে। ন’বছর প্রধানমন্ত্রী থাকার পরে বিরোধী নেতা কেভিন রুডের কাছে হেরে যান জন হাওয়ার্ড। তার পর থেকে, গত ১২ বছরে পাঁচ জন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। যার কারণ, লিবারাল এবং লেবার, দু’দলেরই অন্দরে নেতৃত্বের টানাপড়েন। ২০০৭ সালে লেবার দল ক্ষমতায় আসার পরে প্রথমে কেভিন রুড, তার পরে জুলিয়া গিলার্ড এবং তার পর আবার তিন মাসের জন্য কেভিন রুড প্রধানমন্ত্রী হন। ২০১৩-তে গঠিত হল লিবারাল জোট সরকার। প্রধানমন্ত্রী হলেন টনি অ্যাবট। কিন্তু পুরো তিন বছর প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারেননি তিনিও। তাঁর হাত থেকে ক্ষমতার ব্যাটন যায় ম্যালকম টার্নবুলের কাছে। তিনি আবার হঠাৎ সরে যাওয়ায় পরে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন স্কট মরিসন। এই ডামাডোলের মধ্যে যে কারও পক্ষেই ভুলে যাওয়া স্বাভাবিক যে, এই মুহূর্তে কে আমাদের প্রধানমন্ত্রী! তাই সাধারণ মানুষ চাইছেন, এই নির্বাচনের পরে রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা ফিরে আসুক।
লেখক রেজিস্টার্ড নার্স
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy