পাক হেফাজতে ভারতীয় বায়ুসেনার উইং কম্যান্ডার। ছবি: সংগৃহীত।
গোটা মুখ রক্তে মাখামাখি। চারপাশে ঘিরে থাকা সশস্ত্র পাক সেনা। রীতিমতো কলার ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ভারতীয় বায়ুসেনার উর্দি পরা এক যুবককে। এ রকমই একটি ছবি দিয়ে পাক সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়, ভারতের এক ফাইটার পাইলটকে গ্রেফতার করেছে পাক সেনা। এর কিছুক্ষণ পরেই পাক সেনা মুখপাত্র একটি ভিডিয়ো প্রকাশ করেন। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ওই যুবকের হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। চোখ বাঁধা। তাঁকে পাক সেনা জেরা করছে।
যেখানে পাক প্রধানমন্ত্রী শান্তির বার্তা দিয়ে আলোচনার কথা বলে বিবৃতি দিচ্ছেন, সেখানে তার ঠিক উল্টো ছবি দেখা গেল ওই ভিডিয়োতে। আর সেখানেই প্রশ্ন তুলেছেন একাধিক অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্তা, আদৌ শান্তির জন্য কতটা আন্তরিক পাকিস্তান?
রক্তাক্ত অবস্থায় যে ভাবে তাঁকে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে তা নিয়ে অসন্তোষ জানিয়েছে ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রক। বুধবার বিকেলে পাক উপরাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠানো হয় সাউথ ব্লকে। সেখানে তাঁকে কড়া বার্তা দিয়ে অবিলম্বে গ্রেফতার হওয়া পাইলটকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। সেই সঙ্গে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলা হয়েছে যে, বায়ুসেনার পাইলটের সঙ্গে যে ব্যবহার করা হয়েছে তা জেনিভা সম্মলনের শর্ত লঙ্ঘন করেছে। ওই পাক দূতকে প্রশ্ন করা হয়, কেন পাকিস্তান সরকারি ভাবে ভারতকে জানায়নি যে তাঁরা ভারতীয় পাইলটকে গ্রেফতার করেছে?
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্তারাও দাবি করেছেন, ছবিতে দেখা ওই ব্যক্তি যদি সত্যি ভারতীয় বায়ুসেনার মিগ-২১-এর নিখোঁজ পাইলট উইং কমান্ডার অভিনন্দন হন, তাহলে তাঁর সঙ্গে এ রকম ব্যবহার করার কোনও অধিকার নেই পাকিস্তানের। তাঁদের দাবি, উইং কমান্ডারের সঙ্গে মানবিক ব্যবহার করা উচিত পাকিস্তানের। যুদ্ধবন্দির মর্যাদাও দেওয়া উচিত।
১৯৪৯-এর জেনিভা কনভেনশনে পরিষ্কার বলা আছে, দু’টি দেশের মধ্যে এ রকম সংঘর্ষের পরিস্থিতিতে কোনও পক্ষের কোনও বাহিনীর সদস্য যদি অন্য পক্ষের এলাকায় সেখানকার বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে, তবে তাঁকে যুদ্ধবন্দির মর্যাদা দিতে হবে। জেনিভা কনভেনশন অনুসারে, একজন যুদ্ধবন্দির একাধিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: নিখোঁজ পাইলটকে নিয়ে উদ্বিগ্ন দেশ, পাক ডেপুটি হাইকমিশনারকে ডেকে পাঠাল নয়াদিল্লি
প্রাক্তন সেনা কর্তাদের অনেকে এখনও মনে করতে পারেন, ১৯৭১-এর যুদ্ধে এ রকম ভাবেই ভারতীয় বাহিনীর হাতে এক পাক বায়ুসেনার পাইলটের ধরা পড়ার ঘটনা। ২২ মার্চ ১৯৭১। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের যশোরের একটা বড় অংশ তখন ভারতীয় সেনার দখলে। ৪ শিখ রেজিমেন্টের ছাউনি লক্ষ্য করে বোমা ফেলতে গিয়ে পাল্টা হামলায় ভেঙে পড়ে একটি পাক ফাইটার। পাইলট প্যারাশুটে করে নামলে তাঁকে ঘিরে ধরেন ভারতীয় জওয়ানরা। সেখানে শিখ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন এইচ এস পনাগ। তিনি মারমুখী জওয়ানদের হাত থেকে ওই পাক পাইলটকে উদ্ধার করে জেনিভা কনভেনশনের নিয়ম মেনে তাঁকে নিয়ে যান বাহিনীর সদর দফতরে। ওই পাইলটই ছিলেন ’৭১-এর যুদ্ধে ভারতের প্রথম যুদ্ধবন্দি। যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানের হাতে তুলে দেওয়া হয় সেই পাইলট পারভেজ কুরেশি মেহেদিকে। তিনিই পরবর্তীতে পাক বায়ুসেনার প্রধান হয়েছিলেন।
#Video: Statement of Wing Commander Abhi Nandan, who in custody, says that Pakistan army has treated him well, they are thorough gentlemen and ‘impressed’ by them. pic.twitter.com/cbRowMurFK
— Rehman Azhar (@rehman_azhar) February 27, 2019
প্রাক্তন সেনা কর্তারা জানাচ্ছেন, কার্গিল যুদ্ধের সময় একই ভাবে পাকিস্তানের মাটিতে ধরা পড়েন অন্য এক বায়ুসেনা পাইলট কমবমপতি নচিকেতা। তাঁকে আট দিন পরে রেড ক্রসের মাধ্যমে ভারতের হাতে ফেরত দেওয়া হলেও, অমানুষিক অত্যাচার করা হয়েছিল তাঁর উপর, এমনটাই অভিযোগ।
জেনিভা কনভেনশনে স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যুদ্ধ বা সংঘর্ষকালীন পরিস্থিতিতে শত্রু সেনার হাতে ধরা পড়া ব্যক্তির উপর কোনও শারীরিক বা মানসিক অত্যাচার করা যাবে না। তাঁর নাম, র্যাঙ্ক এবং বাহিনীতে তাঁর নিজস্ব নম্বর ছাড়া অন্য কোনও তথ্য বলতে বাধ্য করা যাবে না। বন্দি আহত হলে তাঁর চিকিৎসা করাতে হবে। তাঁকে পর্যাপ্ত খাদ্য-পানীয় দিতে হবে। এ রকম একাধিক অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে জেনিভা কনভেনশনে। সে সবই এ দিন পাকিস্তান ভেঙেছে বলে অভিযোগ ভারতের।
আরও পড়ুন: পাকিস্তান রেডিয়োয় ভাষণ দিয়ে যুদ্ধ না করার বার্তা ইমরানের, ফের আলোচনার প্রস্তাব
ভারতের এই অসন্তোষ প্রকাশ্যে আসতেই পাক সেনার মুখপাত্র আসিফ গফুর ফের একটি ভিডিয়ো প্রকাশ করে দাবি করেন, সামরিক রীতি মেনেই রাখা হয়েছে ভারতীয় পাইলটকে। ওই ভিডিয়োতে দেখা যাচ্ছে, উইং কমান্ডার অভিনন্দন চা খাচ্ছেন। তিনি বলছেন যে, তাঁর সঙ্গে পাক সেনা ভদ্র ব্যবহার করেছে। তার আগেই পাক সংবাদমাধ্যমে অন্য একটি ভিডিয়ো দেখা যায়। সেখানে দেখা যাচ্ছে, একটি পাহাড়ি ঝোরার উপর পড়ে রয়েছেন ওই পাইলট। তাঁকে ঘিরে ধরে বেধড়ক মারধর করছে কিছু মানুষ। সেই ভিড়ে দেখা যাচ্ছে সেনা এবং পুলিশের উর্দি পরা কয়েক জনকেও।
পাক বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়া ওই পাইলট সম্পর্কে বিশদে জানা না গেলেও, প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে তাঁর বাড়ি তামিলনাডুতে। তাঁর বাবা অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy