ইমরান খান। ফাইল চিত্র।
দুপুর থেকেই নরম হচ্ছিল সুর।বুধবার বিকেলে তা আরও নামিয়ে সরাসরি আলোচনায় বসার আহ্বান জানালেন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তবে পাকিস্তানে বসেই যে পুলওয়ামা হামলার ছক তৈরি হয়েছিল, ভারতের সেই অভিযোগ প্রসঙ্গে সুকৌশলে পুরনো অবস্থানেই রয়ে গেলেন পাক প্রধানমন্ত্রী। বললেন তদন্তের কথা। ভারতে নির্বাচন আসন্ন বলেই বিমানহানার মতো পদক্ষেপ নয়াদিল্লি করল— এই রকম কটাক্ষও শোনা গিয়েছে ইমরানের সংক্ষিপ্ত ভাষণে।
বুধবার বিকেলে পাকিস্তানের সরকারি রেডিয়োতে ভাষণ দিয়েছেন ইমরান খান। পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলা হওয়ার পরে এই নিয়ে দ্বিতীয় বার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রত্যাঘাতের হুঁশিয়ারি দেওয়ার পরেই প্রথম বার ভাষণ দিয়েছিলেন ইমরান। পুলওয়ামায় হামলা যে জইশ করেছে এবং চক্রান্তটা যে পাকিস্তানের মাটি থেকেই হয়েছে, ভারত তার প্রমাণ দিক— বলেছিলেন তিনি। প্রমাণ পেলে পদক্ষেপ করবেন বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু এর আগেও একাধিক জঙ্গি হামলার প্রমাণ পাকিস্তানকে দিয়ে যে লাভ হয়নি, নয়াদিল্লির কর্তারা সে কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন এবং ইমরানের দেওয়া আলোচনা প্রস্তাবের বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরব ছিলেন। কেন সে বিষয়ে নীরব ছিল নয়াদিল্লি, মঙ্গলবার তা স্পষ্ট হয়ে যায়। সে দিন ভোররাতে ভারতীয় বায়ুসেনার অতর্কিত হামলায় পাকিস্তানের বালাকোটে জইশ-ই-মহম্মদের সবচেয়ে বড় প্রশিক্ষণ শিবির গুঁড়িয়ে যায়।
আরও পড়ুন: সুখোই থেকে মিগ, সব বিমান ওড়ানোয় দক্ষ অভিনন্দনের স্ত্রীও বিমানবাহিনীর প্রাক্তন স্কোয়াড্রন লিডার
ভারতের প্রত্যাঘাতের পরেই পাকিস্তান পাল্টা হানাদারির হুমকি দিতে শুরু করেছিল। বুধবার সকালে সেই চেষ্টাই পাকিস্তান করল। ভারতের আকাশসীমা লঙ্ঘন করার চেষ্টা করল পাক বায়ুসেনা, ভারতীয় এলাকায় বোমা ফেলল, ফেরার পথে পাক বাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান ধ্বংস হল, ভারতের একটি মিগ যুদ্ধবিমানও পাকিস্তান গুলি করে নামাল। এত কিছুর পরে বিকেলে সামনে এলেন ইমরান এবং আরও একবার ভারতকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানালেন।
আরও পড়ুন: নিখোঁজ পাইলটকে নিয়ে উদ্বিগ্ন দেশ, পাক ডেপুটি হাইকমিশনারকে ডেকে পাঠাল নয়াদিল্লি
পুলওয়ামা হামলা ভারতের কাছে বড় ‘আঘাত’ বলে মন্তব্য করে সমবেদনার বার্তা দিতে চেয়েছেন ইমরান। তার পরে বলেছেন, ‘‘আমরা আলোচনার টেবিলে আসতে চাই এবং সন্ত্রাসবাদ নিয়ে আলোচনা করতে চাই, যা দু’দেশেরই ক্ষতি করছে।’’ পাকিস্তানও সন্ত্রাসের শিকার, পাকিস্তানের বহু মানুষও সন্ত্রাসে ক্ষতিগ্রস্ত এবং পাকিস্তানের মাটিকে সন্ত্রাসের কাজে ব্যবহৃত হতে দিয়ে পাকিস্তানের কোনও লাভ নেই— আগের দিনের ভাষণে বলা এই কথাগুলো এ দিন ফের বলেছেন ইমরান খান।
নাতিদীর্ঘ ভাষণে প্রায় আগাগোড়াই যুদ্ধে না যাওয়ার বার্তা এ দিন দিতে চেয়েছেন পাক প্রধানমন্ত্রী। যুদ্ধে সব সময় হিসেব গোলমাল হয়ে যায় এবং যে হিসেব করে যুদ্ধে নামা হয়, যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি সে দিকে গড়ায় না— ইমরান এই রকমই মন্তব্য করেন এ দিন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ায় হিটলারের জার্মানির বিপর্যয়, আফগানিস্তানে যুদ্ধ করতে এসে ১৭ বছর ধরে সে দেশে সেনা রাখতে আমেরিকার বাধ্য হওয়া, ভিয়েতনামে মার্কিন অভিযানের ব্যর্থতা— এই সব প্রসঙ্গ তুলে ধরে এ দিন ইমরান সম্ভবত বোঝানোর চেষ্টা করেন, ভারত নিজের সামরিক সক্ষমতার কথা মাথায় রেখে যুদ্ধে জড়ালেই যে যুদ্ধের ফল ভারতের পক্ষে যাবে এমনটা ভেবে নেওয়ার কোনও কারণ নেই। তিনি বলেন,“কোনও যুদ্ধেই সমস্ত অঙ্ক মেলেনা। আমি ভারতকে প্রশ্ন করতে চাই, ভারত বা আমাদের হাতে যে ধরনের সমরাস্ত্র রয়েছে, তাতে এই রকমভুল পদক্ষেপের ঝুঁকি কি আমরা আদৌ নিতে পারি?” যুদ্ধ এক বার শুরু হলে পরিস্থিতিটা তাঁর বা নরেন্দ্র মোদীর নিয়ন্ত্রণে আর থাকবে না বলে মন্তব্য করেন পাক প্রধানমন্ত্রী।
আরও পড়ুন: সন্ত্রাসদমনে অভিযানের পর ভারতীয় সেনা ছাউনি লক্ষ্য করে পাক হামলা, বলছে বিদেশ মন্ত্রক
এ ভাবে সুর নামিয়ে বার বার ভারতকে আলোচনার বার্তা দিলেওনরেন্দ্র মোদীকে খোঁচা মারতে ছাড়েননি পাক প্রধানমন্ত্রী। পুলওয়ামার ঘটনার পরে তাঁর যে অবস্থান ছিল, সেই অবস্থান ধরে রেখেই এ দিন ইমরান বলেন, “ভারতকে আশ্বাস দিয়েছিলাম যে, আমরা তদন্ত করব। কিন্ত তারপরেও আমার একটা আশঙ্কা ছিল যে, ভারত এই রকম কিছু একটা করতে পারে। কারণ ভারতে সামনেই নির্বাচন।” ভারতীয় কূটনৈতিক শিবির ইমরানের এই মন্তব্যকে মোটেই ভাল ভাবে নেয়নি। এই মন্তব্য করে ইমরান পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলার ঘটনাকেই লঘু করতে চেয়েছেন বলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশারদরা মনে করছেন।
যুদ্ধের বিরুদ্ধে যে ভাবে বার বার সওয়াল করছেন ইমরান খান, তাকে অবশ্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন কূটনীতিক এবং প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা এই মুহূর্তে যুদ্ধে যাওয়ার মত শক্তিশালী নয়,যুদ্ধের বিপুল খরচ পাকিস্তান এখন বহন করতে পারবে না।সেই কারণেই সরাসরি যুদ্ধে যাওয়া এড়াতে চাইছে পাক সরকার।
আরও পড়ুন: সন্ত্রাসে মদত দিয়ে ভাবমূর্তি খুইয়েছে পাকিস্তান, চিনও পাশে নেই: প্রাক্তন পাক রাষ্ট্রদূত
কিন্তু মঙ্গলবার ভোররাতে ভারতের প্রত্যাঘাতের পর পাকিস্তানের অন্দরে যে বিপুল চাপের মুখে ইমরান পড়েছিলেন, তাতে প্রত্যাঘাতের একটা চেষ্টা তাঁর সরকারকে দেখাতেই হত। সেই কারণেই বুধবার সকালে পাক বায়ুসেনা ভারতের আকাশসীমা লঙ্ঘনের চেষ্টা করেছে বলে বিশেষজ্ঞদের মত।তবে নিজের বায়ুসেনার এই পদক্ষেপকে এ দিন মহিমান্বিত করতে চেয়েছেন ইমরান। তিনি বলেছেন, “আমি আমার বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে কথা বলে আগে আমাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমান যাচাই করে নিতে চাইছিলাম।”মঙ্গলবার থেকেই পাকিস্তান সেনা দাবি করে এসেছে ভারতের বিমানহানায় আদৌ তাঁদের কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। অর্থাৎ শুরু থেকেই ক্ষয়ক্ষতি প্রসঙ্গ লঘু করে দেখাতে চেয়েছে পাকিস্তান। এ দিনও ইমরান খান দাবি করেছেন যে, ভারতের বিমানহানায় পাকিস্তানে কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ইমরান আরও দাবি করেন যে, এ দিন ভারতের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে পাকিস্তান নিজেদের সক্ষমতা বুঝিয়ে দিতে চেয়েছে। তবে ভারতেও যাতে কোনও ক্ষয়ক্ষতি না হয়, নিজের বায়ুসেনাকে তিনি সেই নির্দেশই দিয়েছিলেন বলে ইমরান দাবি করেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy