Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
International

কথা রাখেননি জিন্নাহ, নবাবকে মেরেছে সেনা, মরিয়া যুদ্ধে বালুচিস্তান

কয়েক বছর সুপ্ত থাকা আগ্নেয়গিরি ফের জেগে উঠেছে। পাকিস্তানে ফের লাভা উদগীরণ শুরু করেছে বালুচিস্তান। ইসলামাবাদের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তির জন্য এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম নতুন নয়। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা বালুচ অঞ্চলকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার পর থেকেই রক্তপাত শুরু। নির্মম দমননীতি চালিয়ে পাকিস্তান বহু বার স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করেছে বালুচদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।

স্বাধীনতাপন্থী বালোচদের পতাকা।

স্বাধীনতাপন্থী বালোচদের পতাকা।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০১৬ ১৯:০৫
Share: Save:

কয়েক বছর সুপ্ত থাকা আগ্নেয়গিরি ফের জেগে উঠেছে। পাকিস্তানে ফের লাভা উদগীরণ শুরু করেছে বালুচিস্তান। ইসলামাবাদের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তির জন্য এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম নতুন নয়। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা বালুচ অঞ্চলকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার পর থেকেই রক্তপাত শুরু। নির্মম দমননীতি চালিয়ে পাকিস্তান বহু বার স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করেছে বালুচদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। কিন্তু বার বার মাথাচাড়া দিয়েছে বালুচ বিদ্রোহীরা।

এই লড়াইয়ের শিকড় কিন্তু সুদূর অতীতে। তার জন্য বালুচদের উদ্ভবের ইতিহাসকে একটু জানা দরকার।

পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং ইরান— বালুচিস্তানকে ঘিরে থাকা এই তিন দেশের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বালুচ জনগোষ্ঠীর কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে বলে ঐতিহাসিকদের একাংশ মনে করেন। সিন্ধু সভ্যতারও আগে যে কৃষিনির্ভর সভ্যতার বিকাশ হয়েছিল ভারতীয় উপমহাদেশের সুদূর পশ্চিমে, তা এই বালুচিস্তানেই ছিল বলে মনে করা হয়। এখন ইরান নামে পরিচিত যে অঞ্চল, সেই দিক থেকে আসা একটি জনগোষ্ঠীই বালুচিস্তানে সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছিল বলে মনে করা হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে সেই জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যায় দক্ষিণ ভারত থেকে বালুচিস্তানে যাওয়া দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর একটি অংশ। অর্থাৎ মধ্য এশিয়া এবং দক্ষিণ ভারতের দু’টি পৃথক জনগোষ্ঠী পরস্পরের সঙ্গে মিশে গিয়ে বালুচ জনগোষ্ঠীর জন্ম। বালুচদের উদ্ভব সম্পর্কে প্রচলিত এই তত্ত্ব নিয়ে ঐতিহাসিকদের অন্য একটি অংশ কিছুটা দ্বিমত পোষণ করেন। তবে ভারতের দক্ষিণাংশ থেকে সিন্ধু উপত্যকা পেরিয়ে পশ্চিমে চলে যাওয়া দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর একটি শাখার সঙ্গে মধ্য এশিয়ার দিক থেকে আসা একটি জনজাতির জিনগত মিলনেই যে বালুচদের উদ্ভব, তা নিয়ে মোটের উপর খুব একটা দ্বিমত ঐতিহাসিক মহলে নেই।

বালোচ বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযানে পাক সেনা।

অনেকগুলো শতাব্দী পার করে এ বার চোখ রাখা যাক ব্রিটিশ ভারতের দিকে। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে। গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসক জাঁকিয়ে বসেছে। কিন্তু বালুচ অঞ্চল তখনও নিজেদের মতো করে স্বাধীন। ব্রিটিশ বাহিনীর কাছে বালুচরা প্রথম নতি স্বীকার করল অনেক পরে। ১৮৭৬ সালে। কালাত চুক্তির মাধ্যমে চার জন স্বাধীন শাসকের (খান) হাতে থাকা চারটি বালুচ অঞ্চল কালাত, খারন, মাকরান এবং লাসবেলা ব্রিটিশ রাজত্বের বশ্যতা স্বীকার করে। এই চারটি অঞ্চলই ছিল বালুচিস্তানের মূল অংশ। ভাষাগত কিছু ফারাক থাকলেও মোটের উপর একই জনগোষ্ঠীর বাস ছিল এই চারটি অঞ্চলে। কিন্তু বরাবরই স্বাধীনচেতা জাতি হিসেবে পরিচিত বালুচরা রাজনৈতিক বিভাজন রেখা টেনে নিয়েছিল নিজেদের মধ্যেও। প্রতিটি গোষ্ঠীই স্বাধীন ভাবে নিজেদের এলাকা নিয়ন্ত্রণ করত।

বালুচিস্তানের অন্য একটি অংশ ছিল আফগান আমিরের শাসনাধীন। কোয়েটা, পিসিন, হরনাই, সিবি সহ কয়েকটি অঞ্চলকে নিয়ে গঠিত সেই এলাকা অবশ্য আড়ে-বহরে স্বাধীন বালোচ রাজ্যগুলির চেয়ে অনেক ছোট ছিল। ১৮৭৯ সালে দ্বিতীয় আফগান যুদ্ধের পর আফগানিস্তানের আমির ওই অঞ্চলগুলি ব্রিটিশের হাতে তুলে দেন। কোয়েটা এবং সিবির মধ্যে সংযোগরক্ষাকারী বোলান গিরিপথ তখনও কালাতের শাসকের অধীনে। আগেই বশ্যতা স্বীকার করে নেওয়া সেই শাসকের কাছ থেকে ১৮৮৩ সালে ব্রিটিশরা বোলান গিরিপথকে পুরোপুরি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়।

গোল বাঁধল স্বাধীনতার পর। বালুচিস্তানের চার স্বাধীন রাজ্য ব্রিটিশের কাছে বশ্যতা স্বীকার করলেও, আত্ননিয়ন্ত্রণের অধিকার কখনোই ছেড়ে দেয়নি। বালুচিস্তানের যে অংশ সরাসরি ব্রিটিশদের হাতে ছিল, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মের পর সেই অংশ ব্রিটিশরা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করে। যে চারটি স্বাধীন বালোচ রাজ্য ব্রিটিশের বশ্যতা স্বীকার করেছিল, তারা পরে ধীরে ধীরে পাকিস্তানে যোগ দেয়। কিন্তু শর্তসাপেক্ষে। কালাতের শাসক বা খানের সঙ্গে ১৯৪৮ সালে পাক সরকারে যে চুক্তি হয়েছিল, তাতে স্বাধীন বালোচ অঞ্চলটিকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বা স্বশাসন দেওয়ার কথা হয়েছিল। মহম্মদ আলি জিন্নাহ নিজে সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অর্থনীতি, বিদেশনীতি এবং প্রতিরক্ষা— শুধু এই তিনটি বিষয় ইসলামাবাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে চুক্তি হয়েছিল। বাকি সব কিছুই বালোচদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে স্থির হয়েছিল। কিন্তু জিন্নাহ কথা রাখেননি। পাকিস্তান পরবর্তী কালে সে চুক্তির শর্ত আর মানেনি। বালোচ মুলুকের সঙ্গে আরও নানা অঞ্চলকে যুক্ত করে, বালুচিস্তান নামে একটি অখণ্ড প্রদেশ গঠন করে তাকে পাকিস্তানের অন্য প্রদেশগুলির সঙ্গে একই আসনে বসিয়ে দেওয়া হয়। বালোচদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দেওয়া হবে বলে যে চুক্তি হয়েছিল, তা ইসলামাবাদ মানতে অস্বীকার করে। পাক সরকারের এই বিশ্বাসঘাতকতাই বিশ্বাসঘাতকতাই বিদ্রোহী করে তোলে বালোচদের। সেই থেকে শুরু হওয়া লড়াই পাকিস্তানে আজও চলছে।

স্বাধীন পাকিস্তান গঠনের পর থেকে এ পর্যন্ত অনেক বার বিদ্রোহ হয়েছে বালুচিস্তানে। পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ১৯৪৮ সালেই প্রথম বার চরমে পৌঁছেছিল ক্ষোভ। শুরু হয়েছিল বিদ্রোহ। তার পর ১৯৫৮ থেকে ১৯৫৯, ১৯৬২ থেকে ১৯৬৩ এবং ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত বার বার পাক সেনার বিরুদ্ধে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী লড়াই করেছেন বালুচ বিদ্রোহীরা। বার বারই নির্মম দমননীতি চালিয়ে, বলপ্রয়োগ করে, বহু প্রাণ কেড়ে নিয়ে বিদ্রোহ দমিয়ে দিয়েছে পাকিস্তান।

২০০৩ সাল থেকে ফের আত্মনিয়ন্ত্রণের লড়াই শুরু করে বালোচরা। পাকিস্তানের সেনাশাসক জেনারেল পারভেজ মুশারফ বালোচ বিদ্রোহ সম্পূর্ণ শেষ করে দেওয়ার পরিকল্পনা নেন। বালোচদের নেতা নবাব আকবর বুগটিকে ২০০৬ সালে একটি পাহাড়ের গুহার মধ্যে ঢুকে খুন করে পাক সেনা। মুশারফ ভেবেছিলেন বালোচ নবাবকে খুন করতে পারলেই শেষ হয়ে যাবে বিদ্রোহ। কিন্তু বিদ্রোহের আগুন তার পর থেকে দাবানলের মতো ছড়িয়েছে বালুচিস্তান জুড়ে। বুগটির হত্যার পর থেকে আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি বদলে গিয়েছে সম্পূর্ণ স্বাধীনতার সংগ্রামে। বালেচরা মনে করছেন, ইসালামাবাদ বিশ্বাসঘাতক। গত প্রায় সাত দশক ধরে পাকিস্তানের সরকার যে নৃশংসতার সাহায্য নিয়ে দমন করতে চেয়েছে বালোচদের, তাতে ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা বালোচদের মনে। ভারত সরকার পাশে দাঁড়ানোয় আরও জোর পেয়েছে বালুচিস্তানের স্বাধীনতার দাবি। পাকিস্তান সেখানে চূড়ান্ত দমননীতি চালিয়ে কী ভাবে রোজ পিশে দিচ্ছে মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক মহলের সামনে তা তুলে ধরছে ভারত। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে তাই ধন্যবাদও জানিয়েছেন বালুচিস্তানের বিদ্রোহী নেতারা। আগের চেয়েও উজ্জীবিত হয়ে ওঠা এই বিদ্রোহীদের রোখা যে আরও কঠিন হয়ে উঠেছে, তা ইসলামাবাদের কাছেও স্পষ্ট। স্বাধীনতার লড়াইকে ছোট করে দেখাতে এখন তাই ভারতকে দোষারোপের পথ বেছে নিয়েছে পাকিস্তান। বালুচিস্তানের অস্থিরতা আসলে ভারতের তৈরি করা, এই বলেই আপাতত মুখ বাঁচাতে চাইছেন নওয়াজ শরিফ।

আরও পড়ুন: বালুচিস্তান নিয়ে বেপরোয়া হতে গিয়ে মোদী এখন ঘোর কূটনৈতিক প্যাঁচে

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE