এড্স ভাইরাসের (সবুজ রং) হানাদারি। - ফাইল ছবি।
ভয়ঙ্কর এড্সকেও তা হলে জয় করা যায়? গত ৪০ বছরে ‘হ্যাঁ’ উত্তরটা শোনা গেল এই নিয়ে দ্বিতীয় বার। ফের এড্সকে জয় করলেন লন্ডনের এক রোগী। নামধাম, বয়স, পরিচয়, হাসপাতাল গোপন রাখতে আপাতত যাঁর নাম দেওয়া হয়েছে, ‘দ্য লন্ডন পেশেন্ট’। ১২ বছর আগে এড্স ফ্রি হয়েছিলেন আরও এক রোগী, জার্মানিতে। তাঁর নাম ছিল ‘দ্য বার্লিন পেশেন্ট’।
এ বার ‘লন্ডন পেশেন্টে’র শরীর থেকে ধুয়েমুছে দেওয়া হয়েছে এড্সের যাবতীয় ভাইরাস। উধাও হয়ে গিয়েছে এড্স ভাইরাসরা। অস্ত্রোপচারের অসাধ্য সাধন করা জাদুতে! বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (‘হু’)-র দেওয়া পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, এই মুহূর্তে বিশ্বে এড্স রোগীর সংখ্যা ৩ কোটি ৭০ লক্ষ। আর আটের দশক প্রথম এই ভাইরাসের কথা জানাজানি হওয়ার পর থেকে এখনও পর্যন্ত এড্স ভাইরাসের হানায় মারা গিয়েছেন সাড়ে ৩ কোটি মানুষ।
এড্স ভাইরাসকে পুরোপুরি নির্মূল করতে অন্যের অস্থিমজ্জা ঢোকানো হয়েছিল রোগীর শরীরে। টানা ৪ বছর ধরে চিকিৎসার পর তাঁকে এখন বলা হচ্ছে, ‘এড্স ফ্রি’! আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নেচার’-এর আগামী সংখ্যায় তা ছাপা হবে বলে রোগী ও হাসপাতালের যাবতীয় পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। যে চিকিৎসকদলের নেতৃত্ব দিয়েছেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, অনাবাসী ভারতীয় এইচআইভি বিশেষজ্ঞ রবীন্দ্র গুপ্তা।
কোন জাদুবলে রোগীর শরীর থেকে এড্স ভাইরাস নির্মূল হয়েছে?
অন্য এক জনের কাছ থেকে অস্থিমজ্জা (বোন ম্যারো) নিয়ে বানানো হয়েছিল বিশেষ এক ধরনের স্টেম সেল। স্টেম সেল এমনই একটি কোষ, যা থেকে আমাদের শরীরের নানা রকমের ও নানা ধরনের কোষ বানিয়ে ফেলা যায়। এইচআইভি বিশেষজ্ঞ রবীন্দ্র গুপ্তা তেমনই একটি স্টেম সেল ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন রোগীর শরীরে। তা টানা তিন বছর ছিল রোগীর শরীরে। সেই স্টেম সেলকে গায়েগতরে বেড়েবুড়ে ছড়িয়ে পড়ার সময় দেওয়া হয়েছিল।
এড্স ‘ভূত’ তাড়ানোর জিনও থাকতে হবে!
তবে যে কারও শরীরের অস্থিমজ্জা নিয়ে স্টেম সেল বানালে আর তা ওই ‘লন্ডন পেশেন্টে’র শরীরে ঢোকালে কাজ হত না। এমন দাতা (ডোনার)-র শরীর থেকে অস্থিমজ্জা নিয়ে সেই স্টেম সেল বানানো হয়েছিল যাঁর শরীরে রয়েছে একটি বিশেষ ধরনের জিন। যা এড্স ভাইরাসকে নাগালে পেলেই নির্বংশ করে দিতে পারে। কোনও ছলচাতুরি করে সেই জিনকে ধোঁকা দিতে পারে না এড্স ভাইরাস। সেই জিনের ‘নখ-দাঁত’ থেকে বাঁচানোর জন্য নিজেদের বদলে নেওয়ারও সময় পায় না। ওই বিশেষ ধরনের জিনের নাম- ‘সিসিআর-ফাইভ’।
আরও পড়ুন- চলে এল কিট, বাড়িতে বসেই এবার যৌন রোগের পরীক্ষা
আরও পড়ুন- এইডস ছড়াচ্ছে ডেটিং সাইট!
সেই জিনের কাজ ছিল, ‘লন্ডন পেশেন্টে’র শরীরে এড্স ভাইরাস দেখলেই তাকে মেরে ফেলা। তারা যাতে শরীরের এক প্রান্ত থেকে দ্রুত অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সে জন্য তাকে ঘিরে ফেলা।
তার পরেও অনেক কাজ ছিল চিকিৎসকদের। টানা দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে নানা রকমের ওষুধপত্র দেওয়া হয়েছে রোগীকে। যাতে কোনও ভাবেই তাঁর শরীরে জন্মাতে বা ছড়িয়ে পড়তে না পারে এড্স ভাইরাস। সব শেষে তাঁরা রোগীকে পরীক্ষা করে চমকে গিয়েছেন! দেখেছেন, হ্যাঁ, তাঁরা ঠিকই ভেবেছিলেন। ঠিক পথেই এগিয়েছিলেন। তাই ‘লন্ডন পেশেন্টের’ শরীরে তাঁরা আর একটিও এড্স ভাইরাস খুঁজে পাননি।
এর পরেও সাবধানী থাকতে চেয়েছেন এড্স বিশেষজ্ঞ রবীন্দ্র। বলেছেন, রোগী ‘ফাংশনালি কিওরড্’। বোঝাতে চেয়েছেন, কোনও ভাইরাস (এড্স) যদি ‘লুকিয়ে’ বা ‘ঘুমিয়ে’ থাকেও ওই রোগীর শরীরে, সে আর কর্মক্ষম হতে পারবে না। যার মানে, লন্ডন পেশেন্টের আর সাড়ে সর্বনাশের আশঙ্কা আর নেই বললেই হয়। রবীন্দ্রের কথায়, ‘‘রোগী পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেলেন কি না, তা বলার জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে।’’
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
তাঁরা তুলে ধরেছেন দু’টি বিষয়। এক, এই ধরনের চিকিৎসা খুবই খরচ সাপেক্ষ। ফলে আমজনতা এতে ততটা উপকৃত হবেন না। গবেষকদের এ বার ভাবতে হবে এই চিকিৎসাকে কী ভাবে আমজনতার কাছেও পৌঁছে দেওয়া যায়। দুই, লন্ডন পেশেন্ট কিছুটা ভাগ্যবানই। কারণ, তিনি সেই ব্যক্তিরই অস্থিমজ্জা দিয়ে বানানো স্টেম সেল তাঁর শরীরে নিয়েছিলেন, যে ডোনারের শরীরে রয়েছে এড্স ভাইরাস বধের জিন। ফলে, এড্স রোগীকে বাঁচানোর জন্য কার শরীর থেকে অস্থিমজ্জা নিয়ে স্টেম সেল বানানো হচ্ছে, সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। ফলে, এই চিকিৎসা পদ্ধতি জনপ্রিয় হয়ে উঠতে কিছুটা সময় নেবে।
তবে সুখবর আছে!
১২ বছর আগে যিনি বার্লিনে এড্স-ফ্রি হয়েছিলেন অভিনব চিকিৎসা পদ্ধতির দৌলতে, সেই তিনি এখন আমেরিকায় থাকেন দিব্য এড্স-ফ্রি হয়েই। কোনও দিন তাঁর এড্স হয়েছিল, ইতিহাসটা না জানা থাকলে, সেই ‘বার্লিন পেশেন্ট’কে দেখলে সেটা বোঝাই যাবে না।
ফলে, লন্ডন পেশেন্টও বোধহয় আশায় বুক বাঁধতে পারেন, এমনটাই দাবি গবেষকদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy