Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Social Change

সময়ের কাঁটা

বছর বাইশের কোনও তরুণী সাদা শাড়ি পরলে, মনে হয় ‘এই বয়সেই এত বৈরাগ্য?’ আবার ষাটোর্ধ্ব কেউ যদি গাঢ় রঙের সাজে নিজেকে সাজায়, তা হলে শোনা যায়, ‘বুড়ো বয়সে কচি সাজার ইচ্ছে হয়েছে।’

আমাদের অজান্তেই মনের মধ্যে অদৃশ্য ঘড়ি চলতে থাকে, যা জানান দেয় বয়সের ধর্ম। কিন্তু বয়সের কি আদৌ কোনও ধর্ম আছে?

আমাদের অজান্তেই মনের মধ্যে অদৃশ্য ঘড়ি চলতে থাকে, যা জানান দেয় বয়সের ধর্ম। কিন্তু বয়সের কি আদৌ কোনও ধর্ম আছে? ছবি: শুভদীপ সামন্ত।

দীপান্বিতা মুখোপাধ্যায় ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০২৩ ০৮:৩২
Share: Save:

ছোট পর্দায় ‘মহাভারত’-এর শুরুতে মেঘমন্দ্র স্বরে উচ্চারিত হত, ‘ম্যায় সময় হুঁ’। কী অমোঘ বাণী! সময়, এমন এক জিনিস যাকে কোনও শিকলেই বাঁধা যায় না। কালের নিয়মে বয়স বাড়বেই। কিন্তু বয়সের নিক্তিতে কি কোনও ব্যক্তির কার্যকারণকে বিচার করা যেতে পারে?

বছর বাইশের কোনও তরুণী সাদা শাড়ি পরলে, মনে হয় ‘এই বয়সেই এত বৈরাগ্য?’ আবার ষাটোর্ধ্ব কেউ যদি গাঢ় রঙের সাজে নিজেকে সাজায়, তা হলে শোনা যায়, ‘বুড়ো বয়সে কচি সাজার ইচ্ছে হয়েছে।’ কোনও টিনএজার রান্নাঘরে আগ্রহ দেখালে, তাকে বলা হয়, ‘বড় হলে তো হাঁড়ি-কড়া ঠেলতেই হবে...’ বিচার করার সময়ে আমরা ভুলে যাই কারও মনের ইচ্ছে, ভাল লাগার আসলে কোনও বয়স হয় না। আর বেশি বয়সে কেউ প্রেম বা বিয়ে করলে? সেই মহিলা বা পুরুষ রীতিমতো দ্রষ্টব্য হয়ে ওঠেন। সময়ের কাঁটা আমাদের মাথায় গেঁথে আছে। যা সারাক্ষণ মনে করিয়ে দেয় ‘বয়সের ধর্ম’।

চিন্তাধারার বীজ আমাদের সংস্কৃতিতে

মনোবিদ জয়রঞ্জন রাম বলছেন, ‘‘এই মানসিকতা আমাদের সমাজ ব্যবস্থার ফসল। বিদেশে কিন্তু বয়স দিয়ে কারও চিন্তাধারা, কাজ বিচার করা হয় না। সেখানে প্রবীণ ব্যক্তির বিয়ে করা বা নতুন করে পড়াশোনা করা কোনও আলাদা ঘটনা নয়।’’

হিন্দু সংস্কৃতিতে চতুরাশ্রমের যে ভাগ আছে, যুগের পর যুগ কেটে গেলেও সেই ধ্যানধারণা আজও বহাল। ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বাণপ্রস্থ এবং সন্ন্যাস— আধুনিক সমাজেও এই পর্যায়ের মধ্যেই আটকে আমাদের জীবনবৃত্ত। সেই কক্ষপথের বাইরে কেউ পদক্ষেপ করল, জড়ো হয়ে যায় অনেক প্রশ্নচিহ্ন। ‘‘আসলে এটা আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ। ‘বয়স হয়ে যাচ্ছে, আমাকে কাশী দিয়ে আয় খোকা’— এখন আক্ষরিক অর্থে না ঘটলেও ধ্যানধারণাটা রয়ে গিয়েছে। বিত্তশালীরা অনেক সময়ে বিষয়গুলো এড়িয়ে যেতে পারেন, যেটা মধ্যবিত্ত সমাজে সহজে সম্ভব হয় না। কিন্তু বয়সের নিক্তিতে বিচার সমাজের সব স্তরেই আছে,’’ মন্তব্য জয়রঞ্জন রামের।

বয়সের বেড়া টপকে

এমন অনেক মানুষই আছেন, যাঁরা স্রোতের বিপরীতে হেঁটেছেন। সাতান্ন বছরের সম্পা সেন মজুমদার ফের পড়াশোনা শুরু করেছিলেন মধ্য চল্লিশে গিয়ে। এখন তিনি সর্বশিক্ষা অভিযানের সঙ্গে যুক্ত। তাঁর মেয়ে সৃজনী সেন মজুমদার জানালেন, তিনি যখন এমএসসি পড়ছেন, তখন তাঁর মা ফের নিজের পড়াশোনা শুরু করেন। মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ করার পরে স্পেশ্যাল বিএড করেন সম্পা। তার পর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সেরিব্রাল পলসিতে যোগ দেন। ঠিক কীসের তাগিদে মধ্য চল্লিশে গিয়ে নতুন পথে পা বাড়ালেন? ‘‘উচ্চমাধ্যমিকের পরেই আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তবে বিয়ের পরে আমি স্নাতক হই, বিএড করি। কিন্তু পারিবারিক কারণে কাজ করতে পারিনি। স্বাবলম্বী হওয়ার ইচ্ছেটা চিরকালই ছিল। একটা সময়ে মনে হল, এখন তো মেয়েও বড় হয়ে গিয়েছে, এ বার জীবনটা নতুন ভাবে শুরু করা যাক। কীসে ভাল থাকব, সেটা আমি জানতাম। বয়স আমার কাছে কোনও দিনই বাধা ছিল না,’’ বললেন প্রত্যয়ী সম্পা। পঞ্চাশের পর তিনি গাড়ি চালানোও শিখেছেন। এখন তাঁর ইচ্ছে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ শেখার।

ছকভাঙার চেষ্টা করেছেন আটান্ন বছরের কল্যাণী দাস। এই বয়সেও একা বেড়াতে যাওয়া তাঁর কাছে খুব স্বাভাবিক। কল্যাণী বলছিলেন, ‘‘নিজের মতো করে, নিজের জন্য বাঁচা আমার কাছে খুব জরুরি ছিল। আমার স্বামী দীর্ঘ দিন অসুস্থ ছিলেন। একা হাতে সব কাজ করেছি। বাড়ির এমন কোনও কাজ নেই, যা আমি পারি না। ইলেকট্রিকের ছোটখাটো সমস্যাও ঠিক করে দিতে পারি।’’ এক বছর হল তাঁর স্বামী চলে গিয়েছেন, মেয়ে স্বাবলম্বী। এখন তিনি ব্যাগ গুছিয়ে ইচ্ছেমতো বেড়িয়ে পড়েন। বয়সজনিত ভয়, দ্বিধা কোনওটাই কল্যাণীর আত্মবিশ্বাসকে টলাতে পারেনি।

সম্পা, কল্যাণীরা যেটা পেরেছেন, সেই কাজটা সহজ নয়। রোজকার ছোটখাটো কথাতেই আমরা বয়স নিয়ে তুলনা করি। সেই মানসিকতা না বদলাতে পারলে, নিজেকে আধুনিক বলাই বৃথা। নিজের উত্তরণের সঙ্গে সন্তানকে সেই মানসিকতার ছোঁয়া দেওয়াটাও জরুরি। নয়তো আগামী প্রজন্মও বদ্ধ সংস্কৃতির প্যাঁচ থেকে বেরোতে পারবে না। তাই যে শাড়ির রংটা চড়া বলে তুলে রাখা, সেটা বরং নামিয়ে নেওয়া যাক। গ্রাফোলজি শেখার ফর্মটা দ্বিধা ঝেড়ে ভর্তি করে ফেলা যায়। জ়ুম্বা শিখলেও মন্দ হয় না।

ছবি: শুভদীপ সামন্ত।

যখন বড় হলাম

বছর বারোর রাহি রান্না করতে বেজায় ভালবাসে। আইটি সেক্টরে কর্মরত তার মা মনে করে, এই বয়সে পড়াশোনাটাই আসল। তাই বাহবা নয়, রাহির কপালে বকুনিই জোটে। ছোটরা বড়দের অনুকরণ করতে ভালবাসে। বড়দের মতো সব কিছু করার তাগিদ থাকে ওদের মধ্যেও। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বাবা-মায়েরা সন্তানের ‘পাকামি’ দেখে মনে মনে খুশি হচ্ছেন। আবার কখনও বেশ রেগেও যাচ্ছেন। মনোবিদ জলি লাহা ব্যাখ্যা করলেন, ‘‘বাচ্চারা বয়সের আন্দাজে পরিণত কোনও কাজ করলে বাবা-মায়েরা সেটা সন্তানের বুদ্ধিমত্তা ভাবেন এবং গুরুত্ব দেন। আবার খুব রক্ষণশীল পরিবার, যেখানে একটা স্তরবিন্যাস আছে, সেখানে তাদের দমিয়েদেওয়ার ঘটনাও দেখা যায়। একটা শিশু কোন পরিবেশে থাকছে, কতটা এক্সপোজ়ার পাচ্ছে, তার উপর নির্ভর করে অনেক কিছু।’’ কখন ছোটদের উৎসাহ দেবেন এবং কখন তাদের সংশোধন করবেন, এটা বাবা-মাকেই স্থির করতে হবে। উল্টো দিকে সমাজের নিম্নবিত্ত স্তরের ছবিটা একেবারে আলাদা। সেখানে ছোটরা খুব কম বয়স থেকেই বাড়ির অনেক কাজ করে। তারা মুখের ভাষা খারাপ করলেও, সেটাই স্বাভাবিক ধরে নেওয়া হয়।

যথার্থ অর্থে আধুনিক হতে হয়তো আমাদের আরও অনেকটা পথ পেরোতে হবে। যখন আর বয়সের মাপকাঠিতে কারও সিদ্ধান্তকে বিচার করা হবে না। নিজেকে অন্তর্মুখীকরব না, লোকে কী বলবে ভেবে।এই উত্তরণের পথে সোশ্যালমিডিয়া ট্রোলিং, পড়শির কৌতূহলী চোখ অনেক কিছুই আসবে। তবে সেই বাধা কাটাতে হবে নিজেকেই। কেউ সঙ্গ দিলে ভাল, নয়তো একলা চলো রে...

ছবি: শুভদীপ সামন্ত।

মডেল: মনীষা তালুকদার, ইন্দ্রনীল চট্টোপাধ্যায়, ভদ্রা বসু, নিকুঞ্জবিহারী পাল; মেকআপ: অভিজিৎ কয়াল; স্টাইলিং: সুব্রত বসু; শাড়ি: ইন্ডিয়ান সিল্ক হাউস; লোকেশন: ক্লাব ভর্দে ভিস্তা; ফুড পার্টনার: বাবু কালচার, গড়িয়াহাট।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Social Change Indian Society
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE