Advertisement
E-Paper

সন্ধের পরে...

‘গ্রে ডিভোর্স’ নিয়ে এখন দুনিয়াজোড়া আলোচনা! দীর্ঘ দাম্পত্যজীবন কাটিয়ে বিচ্ছেদের কথা কেন ভাবছেন?

কোয়েনা দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৮:৫৩
Share
Save

তোমাদের মায়ের কাছ থেকে আমি বিচ্ছেদ মানে ডিভোর্স চাইছি... ‘বেলাশেষে’ ছবিতে প্রায় পঞ্চাশ বছর একসঙ্গে থাকার পরে স্ত্রী আরতির থেকে বিচ্ছেদ চেয়েছিলেন স্বামী বিশ্বনাথ। সেখানে কার্যকারণ যাই হোক, সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল ছবিটি। দীর্ঘ দাম্পত্যের পর সম্পর্কে ইতি টেনেছেন মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস ও তাঁর স্ত্রী মেলিন্ডা গেটস। অ্যামাজ়নের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস, হলিউডের অভিনেতা হিউ জ্যাকম্যান, টম ক্রুজ়, বলিউডে হৃতিক রোশন, আমির খান... বেশি বয়সে সম্পর্ক ভেঙেছেন অনেকেই। সম্প্রতি বিচ্ছেদের কথা জানিয়েছেন এআর রহমান। আর তার পর থেকেই ফের আলোচনায় উঠে এসেছে গ্রে ডিভোর্স বা ধূসর বিচ্ছেদ।

বিচ্ছেদের রং কি ধূসর?

ভালবাসার রং গোলাপি বা লাল হলে, বিচ্ছেদের রং ধূসর হতেই পারে। স্বামী-স্ত্রীর বিয়ের বয়স যখন পনেরো-কুড়ি বা তারও বেশি, তখন যদি তাঁরা বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন, চুলে পাক ধরা সেই দুই পরিণতবয়সির বিচ্ছিন্ন হওয়ার সিদ্ধান্তই ‘গ্রে ডিভোর্স’। সমাজমাধ্যমে ট্রেন্ডিং এই শব্দবন্ধ নিয়ে ইতিমধ্যে হ্যাশট্যাগ তৈরি হয়েছে। ম্যারেজ কাউন্সেলর দেবলীনা ঘোষ বলছেন, “আইনি পরিভাষায় এ ধরনের শব্দ নেই। সাধারণ ডিভোর্সের মতো এ ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। তবে গত দশ বছরে চল্লিশোর্ধ্ব দম্পতির বিচ্ছেদের সংখ্যা বেড়েছে।”

তোমার পাশে, পুরনো অভ্যাসে

প্রশ্ন হল, বিয়ের এত বছর পরে, যখন নতুন করে সঙ্গী না-ও পেতে পারেন, তখন বিচ্ছেদের কথা কেন ভাবছেন কেউ? অনেকেরই বক্তব্য, এই বয়সে একসঙ্গে থাকাটা কেবল অভ্যেস। শুরুর দিকে যে ভালবাসা ছিল, রোজকার একঘেয়ে জীবনে তাতে মরচে ধরে যায়। আর তার ফাঁক গলে ভুল বোঝাবুঝি, ঝগড়া, সন্দেহ, পরকীয়ার মতো বিষয় ঢুকে পড়ে। আবার কিছু সম্পর্ক হয়তো প্রথম থেকেই আলগা ছিল। কিন্তু জোর করে জুড়ে ছিলেন তাঁরা। সমাজতত্ত্ববিদ সুহৃতা সাহা বলছেন, “এখনকার
সমাজ ডিভোর্সকে যত সহজ চোখে দেখে, তিরিশ
বছর আগে তেমন
ছিল না। এখন সমাজমাধ্যমে বিয়ে ও বিচ্ছেদ নিয়ে খোলামেলা আলোচনায় অনেকেই নিজেদের সম্পর্কের স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার সাহস পাচ্ছেন।”

দূরে হেঁটে চলে গেছি রোজ

মনোবিদরা বলছেন, কম বয়সে যাঁরা বিয়ে করেন, তাঁরা যখন পরিণত হচ্ছেন, নিজেদের চিনছেন, তখন দেখেন যে সঙ্গ আশা করেছিলেন, তা পাচ্ছেন না। চাওয়া-পাওয়ার মিল না থাকায় অনেকেই বয়সকালে নিজেদের মধ্যে আর আকর্ষণ খুঁজে পান না। কিছু ক্ষেত্রে সম্পর্কের সুতো বেঁধে রাখে সন্তান। তারা বড় হলে সুতো আলগা হয়ে যায়। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রাম বলছেন, “তখন ‘এম্পটি নেস্ট সিনড্রোম’ কাজ করে। শূন্যতা থেকে বিষণ্ণতা, অবসাদ আসে। একসঙ্গে থাকাটা অসম্ভব হয়ে যায়।”

অভিমান আড়াল করে...

কিছু সম্পর্কের প্রথম দিকে স্বামী হয়তো স্ত্রীকে প্রাপ্য মর্যাদা দেননি। শারীরিক নির্যাতন করেছেন, পারিবারিক কলহে স্ত্রীর পাশে থাকেননি বা তৃতীয় সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন... এ নিয়ে ক্ষোভ থেকেই যায়। “মধ্যবয়স পেরিয়ে যাওয়ার পরে অভিজ্ঞতা, জীবনবোধ বাড়লে মহিলাদের জমে থাকা ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে,” বলছেন সুহৃতা। এ ক্ষেত্রে মেয়েদের আর্থিক স্বাধীনতারও ভূমিকা রয়েছে। দেবলীনা প্রায়ই এমন কেস পান যেখানে স্বামী, সংসার ছাড়লে মা-বাবা-ভাইয়ের মুখাপেক্ষী হতে হবে, সেই চিন্তায় প্রথম জীবনে স্ত্রী আপস করেছেন। চাকরি করলেও একা হাতে সন্তান, কাজ সামাল দেওয়ার আশঙ্কায় বিচ্ছেদের পথে হাঁটতে চাননি। কিন্তু তাঁরাই যখন পঞ্চাশের দোরগোড়ায় পৌঁছচ্ছেন, তখন বাবা-মায়ের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়ে তাঁদের পায়ের তলার মাটি শক্ত হচ্ছে। অনেকেরই ছেলেমেয়ে চাকরি পেয়ে গিয়েছে। এ বার তাঁরা বিচ্ছেদের পথে হাঁটার সাহস দেখাতে পারছেন।

আজ দু’জনার দু’টি পথ

সমস্যা হয়, যখন কোনও এক পক্ষ সম্পর্ক শেষের উদ্যোগ নেয়। দেবলীনার মতে, “অন্য জন অনেক সময়েই মানসিক অবসাদের শিকার হন। নিজেকে সামলে সমাজের সঙ্গে মিশতে পারেন না তাঁরা।” পরিণত বয়সে মা-বাবার বিচ্ছেদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সমস্যা হয় অনেক সন্তানেরও। বাবা বা মা একজনের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়। সন্তানকে সপক্ষে রাখতে কাদা ছোড়াছুড়ির পথেও হাঁটেন স্বামী-স্ত্রী। তবে ডা. জয়রঞ্জনের অভিজ্ঞতায়, “বেশির ভাগ সময়েই দেখা যায় মেয়েটি ভিক্টিম। যে সন্তানরা ছোট থেকে দেখেছে বাবা মাকে সম্মান করেন না, আর্থিক ভাবে সক্ষম হওয়ার পরে তাঁরা কিন্তু মায়ের পাশে দাঁড়ান।”

যেন তুমি আমি ভাল থাকি

অবশ্য গ্রে ডিভোর্স এখনও সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তবে সাধারণ মানুষ অনেকেই সাংসারিক জীবনে এখন আত্মসম্মানের সঙ্গে আপস করছেন না। ‘আর তো ক’টা দিন, কোনও ভাবে কাটিয়ে দিতে পারলেই হল!’ এ যেমন একপক্ষের ভাবনা, তেমনই ‘আর তো কয়েকটা দিন, এ বার নিজের মতো করে বাঁচব’ এমনটাও ভাবতে চাইছেন অনেকেই। দেবলীনা বলছেন, “তবে ম্যারেজ কাউন্সেলরের সঙ্গে আলোচনার পরে তাঁরা বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত বদলেছেন, এমন নজিরও কম না।”

তবে বিচ্ছেদের পথে হাঁটলে আগে সন্তানের সঙ্গে বসে আলোচনা করুন। বিচ্ছেদের রাস্তায় যাওয়ার আগে সম্পত্তির ভাগাভাগি, খোরপোষ সংক্রান্ত আলোচনা সেরে নিন। সুহৃতা বলছেন, “বয়সকালে স্বামী, স্ত্রীর কেউ একজন আগে মারা যাবেন, অন্যজন একা থেকে যাবেন বেশ কিছু বছর… এখন সে ভাবেই আগেভাগে পরিকল্পনা, সঞ্চয় সেরে রাখেন দম্পতিরা। ফলে জীবনের শেষ ক’টা দিনের কথা না ভেবে, অপছন্দের সম্পর্কের থেকে মুক্তি চাইতেই পারেন।” তবে বিচ্ছেদের আগে শেষ বয়সের একাকিত্ব, পারস্পরিক সাহচর্য, বিপদেআপদে অসুস্থতায় দেখভাল করার পাশে থাকার মানুষটিও যে চলে যাবে, সেই বিষয়টাও ভাবনায় রাখুন।


(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Divorce Breakup

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}