Advertisement
E-Paper

সাবেক হোটেলের দেশি স্বাদ

সালটা ১৯৪০। শুরু হয়ে গিয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জাতীয় রাজনীতিতে সে এক উথাল-পাথাল সময়। গাঁধী-সুভাষ মতবিরোধ। কংগ্রেসের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের দূরত্ব তখন স্পষ্ট। ওই বছর ১২ মে ঝাড়গ্রামে এক জনসভায় বক্তব্য রাখেন সুভাষচন্দ্র।

কিংশুক গুপ্ত

শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৬ ০৯:২২

সুভাষচন্দ্র বসু মজেছিলেন বিনোদ ঠাকুরের হোটেলের মৌরলার লটপটির স্বাদে।

সালটা ১৯৪০। শুরু হয়ে গিয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জাতীয় রাজনীতিতে সে এক উথাল-পাথাল সময়। গাঁধী-সুভাষ মতবিরোধ। কংগ্রেসের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের দূরত্ব তখন স্পষ্ট। ওই বছর ১২ মে ঝাড়গ্রামে এক জনসভায় বক্তব্য রাখেন সুভাষচন্দ্র। অবিভক্ত মেদিনীপুরে সেটিই ছিল তাঁর শেষ জনসভা। ওই সভায় সুভাষচন্দ্রের সঙ্গী ছিলেন নাড়াজোল রাজ এস্টেটের কুমার দেবেন্দ্রলাল খান। সভার আগে ঝাড়গ্রামের শান্তিনিকেতন হোটেলে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরেছিলেন দু’জনে। বিনোদ ঠাকুরের উত্তরসূরিদের দাবি, হোটেলের ৩৮ নম্বর টেবিলে বসে সর্ষে-পোস্ত-কাঁচালঙ্কা জারিত মুখরোচক মৌরলা মাছের লটপটি পদটি চেটেপুটে খেয়েছিলেন ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত সুভাষচন্দ্র।

নেতাজির লৌহকঠিন মন যেমন বিগলিত হয়েছিল লটপটি খেয়ে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিমনও নাকি তেমনই ডুবেছিল ওই এক স্বাদে। বিনোদ ঠাকুরের মেজ ছেলে বলরাম আচার্য জানালেন, কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রিয় পদ ছিল মাছের লটপটি। ঝাড়গ্রামে এলেই শক্তিবাবু সটান চলে আসতেন হোটেলে। কবির জন্য লটপটিতে টোম্যাটো-ধনেপাতা দেওয়া হত।

আট দশক অতিক্রান্ত বাঙালির সাবেক রসনা তৃপ্তির এই প্রতিষ্ঠানটিকে ঘিরে রয়েছে সোনালী অতীতের এমনই নানা স্মৃতি। জ্যোতি বসু থেকে সত্যজিৎ রায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো বহু বিশিষ্টজন এই হোটেলে খেয়ে গিয়েছেন। এই হোটেলের কাঁটাচচ্চড়ি, মুড়ি ঘণ্ট আর মেটে চচ্চড়ির বিস্তর সুখ্যাতি রয়েছে। তবে অভিনেতা বলরাজ সাহনির মনে ধরেছিল ধোকার ডালনা। পঞ্চাশের দশকে এক বার ইঞ্জিন বিকল হয়ে যাওয়ায় মুম্বইগামী ট্রেন দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা ঝাড়গ্রাম স্টেশনে দাঁড়িয়েছিল। ঘটনাচক্রে ওই ট্রেনে ছিলেন হিন্দি সিনেমার অভিনেতা বলরাজ সাহনি, দারা সিংহরা। শান্তিনিকেতন হোটেলে এসে ভাত-ডাল-আলু পোস্ত- ধোকার ডালনা তৃপ্তি করে খেয়েছিলেন তাঁরা। ধোকার ডালনা এতটাই পছন্দ হয়েছিল যে, রাঁধুনিকে ডেকে রেসিপি জেনে নিয়েছিলেন বলরাজ।

দূরদূরান্তের ভোজন রসিকরা আজও এক ডাকে চেনেন বিনোদ ঠাকুরের সাবেক হোটেলটিকে। তবে, এই নামডাক এক দিনে হয়নি।

বাঁকুড়ার রাইপুরের শ্যামসুন্দরপুর গ্রামের বিনোদবিহারী আচার্যের বিনোদ ঠাকুর হয়ে ওঠার পথে ছিল নানা প্রতিকূলতা। অভাবী ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান ছিলেন তিনি। জন্ম ১৯১০ সালে। মাত্র নয় বছর বয়সে গ্রামের সম্পর্কিত এক কাকার সঙ্গে চলে আসেন ঝাড়গ্রামে। বালকসঙ্গীতের দলে ছিলেন কিছু দিন। পরে শিলদা-ঝাড়গ্রাম রুটের একটি বাসে সহকারী খালাসির কাজ জুটে যায়। বাসের চালক শ্রীরাম নায়ডু ছিলেন ভোজন রসিক। দীর্ঘ দিন বাংলায় থাকার সুবাদে শুক্তো, পাতুরি, চচ্চড়ি, ঘণ্টর প্রতি বিশেষ অনুরক্ত ছিলেন দক্ষিণ ভারতীয় মানুষটি। বিনোদবাবু স্মৃতিচারণায় বলতেন, ‘‘নায়ডুর জন্যই কিশোর বয়সে আমাকে হাতা-খুন্তি ধরতে হয়েছিল।’ মনের মাধুরী মিশিয়ে একের পর এক পদ নিজের মতো করে রাঁধতেন বিনোদবিহারী। হাতের গুণের জেরে ১৮ বছর বয়সে ঝাড়গ্রামের জামবনি ব্যারাকের কাছে একটি খাবার হোটেলে রান্নার কাজ জুটে গেল। স্বপ্ন দেখতেন নিজেই এক দিন খাবার হোটেল খুলবেন। ১৯৩৩ সালে ঝাড়গ্রাম মেন রেল ক্রশিংয়ের কাছে রাস্তার ধারে মাটির দেওয়াল আর খড়ের ছাউনি দেওয়া ভাতের হোটেল খুলে বসলেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৩। তারই মধ্যে বিনোদবিহারী হয়ে গিয়েছেন বিনোদ ঠাকুর। সাবেক বাঙালি রান্নাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। দীর্ঘ দিন নিজের হাতে রান্না করেছেন। পরে হোটেলটি ইটের গাঁথনি দেওয়াল আর অ্যাসবেসটসের ছাউনি দেওয়া হয়। কাঠের পাটাতন দিয়ে সিলিং। আজও সাবেক কাঠের টানা টেবিল আর বেঞ্চে বসে খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। কয়েকটি মার্বেল বসানো কাঠের ছোট টেবিল রয়েছে। এই রকমই যে টেবিলে বসে খেয়ে গিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র।

২০০৭ সালে বিনোদবাবু ৯৭ বছর বয়সে প্রয়াত হন। এখন হোটেলটি চালাচ্ছেন বিনোদবাবুর দুই ছেলে ও নাতিরা। বিনোদবাবুর ছেলে শিবরাম আচার্য ও বলরাম আচার্য জানালেন, সাবেক হোটেলের কোনও কিছুই পরিবর্তন করা হয়নি। তাঁদের বাবার রেসিপি মেনেই এখনও রাঁধুনিরা দেশি মতে রান্না করেন। যেমন, বিনোদবিহারীবাবুর আমল থেকে প্রতিটি পদ বাটা মশলা দিয়ে রান্না করা হয় বলে জানালেন হোটেলের ম্যানেজার তরুণ সেনাপতি। ব্যবহার করা হয় নামী কোম্পানির সর্ষের তেল। খাবারের স্বাদ-গন্ধ পরীক্ষা করে দেখার পরে পড়ে পাতে।

পদ অনুযায়ী আলাদা আলাদা দাম। এক প্লেট ভাত দশ টাকা। এক বাটি মুগের ডাল দশ টাকা। পোস্ত বড়া ১৫ টাকা পিস। আলু, বেগুন, করলা ও শাকের মতো যে কোনও ভাজা এক বাটি দশ টাকা। শুক্তো, মুড়িঘন্ট, কাঁটা চচ্চড়ি প্রতি প্লেট ১৫ টাকা। ধোকার ডালনা ৩০ টাকা। মাছের ডিমের বড়া ১৫ টাকা পিস। চিংড়ি মাছের বড়া ১৫ টাকা পিস। খাসির মাংস এক প্লেট (৮ পিস) ১৬০ টাকা। চিকেন এক প্লেট (৪ পিস) ৮০ টাকা। দেশি মুরগির ঝোল (৬ পিস) ১৫০ টাকা। মেটে চচ্চড়ি (৮ টুকরো) ১৭০ টাকা। চারা মাছ ৩৫-৪৫ টাকা। কাটা মাছ ৩০-৪৫ টাকা। পমফ্রেট ও ইলিশ ৮০-১০০ টাকা। চুনো মাছ ২০ টাকা। মাছের লটপটি ৬০ টাকা। আম অথবা টোম্যাটোর চাটনি ১০ টাকা। পাঁপড় ৫ টাকা পিস। শীতকালে শেষ পাতে নলেন গুড়ের পায়েসও পাওয়া যায়। এক প্লেট পায়েসের দাম ৫০ টাকা। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা এবং সন্ধে ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত হোটেলটি খোলা থাকে। বিনোদবাবুর নাতি বিশ্বজিৎ ও চিরঞ্জিত আচার্য জানান, মৃত্যুর কয়েক মাস আগে পর্যন্ত বিনোদবাবু নিয়ম করে হোটেলে এসে হুইলচেয়ারে বসে তদারক করতেন। কেউ কোনও পদ চাইলে, না থাকলেও তক্ষুনি রান্না করে পরিবেশনের আদেশ দিতেন। নাতিদের কথায়, ‘‘উনি আমাদের শিখিয়েছেন, খদ্দেরের তৃপ্তির ঢেঁকুরে ঈশ্বরের আশীর্বাদ থাকে।’’

Bengali Hotel Hotel
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy