Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Systemic lupus erythematosus

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকেই ভুল করতে বাধ্য করে, এই অসুখে ভুগেছিলেন মাইকেল জ্যাকসনও

আমাদের দেশে প্রতি ১ লক্ষ মানুষের ৩.২ জন এই অসুখে ভুগছেন।

মাইকেল জ্যাকসনও আক্রান্ত ছিলেন সিস্টেমিক লুপাস এরিথেমাটোসাস নামক এই রোগে। ফাইল ছবি

মাইকেল জ্যাকসনও আক্রান্ত ছিলেন সিস্টেমিক লুপাস এরিথেমাটোসাস নামক এই রোগে। ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৩:২৯
Share: Save:

একদিকে চুল ঝরতে শুরু করেছে, অন্য দিকে নাকের দুপাশে প্রজাপতির মত লালচে গুটি, মাঝে মাঝেই জ্বর আর গাঁটে গাঁটে ব্যথা। ভয় নেই, এসব উপসর্গগুলোর সঙ্গে নভেল করোনা ভাইরাসের কোনও যোগ নেই। চেনা লক্ষণ নিয়ে আসা অসুখের নামের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যে খুব একটা পরিচয় আছে তা কিন্তু নয়। রোগের নাম সিস্টেমিক লুপাস এরিথেমাটোসাস সংক্ষেপে এসএলই। পপ সম্রাট মাইকেল জ্যাকসন এসএলই আক্রান্ত হয়ে ২৩ বছর ভাল ছিলেন। দীর্ঘদিন চিকিৎসা চলেছিল তাঁরও।

খটমট নামের এই অসুখে আক্রান্তের সংখ্যা নেহাতই কম নয়। বেশ কিছু নিয়মের বেড়াজালে রোগীদের থাকতে হয়। নইলে আচমকা বিপদে পড়ার ঝুঁকি থাকে। আমাদের দেশে প্রতি ১ লক্ষ মানুষের ৩.২ জন এই অসুখে ভুগছেন। যদিও আমেরিকার তুলনায় এসএলই আক্রান্তের সংখ্যা যথেষ্ট কম, তাও জনসংখ্যার বিচারে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা অনেকটাই বেশি। আক্রান্তদের পাশে দাঁড়িয়ে মনের জোর বাড়ানোর পাশাপাশি তাঁদের জীবনযাত্রার নিয়মের ব্যাপারে সাহায্যে করতে ইতিমধ্যে আমাদের দেশে একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তৈরি হয়েছে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য লুপাস ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়ান, অটোইমিউন ইন্ডিয়ান, লুপাস ট্রাস্ট ইন্ডিয়ান।

ডাক্তারি মতে সহজ করে বলতে গেলে এসএলই হল সিস্টেমিক অটোইমিউন ডিজিজ বা কানেকটিভ টিস্যু ডিজিজ। অর্থাৎ শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কোনও এক অজ্ঞাত কারণে নিজের শরীরের বিভিন্ন কোষ ও কলাকে ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা করে। ফলস্বরূপ আক্রান্ত অংশে প্রদাহ হয়ে ফুলে ওঠে। ফলত সেই অংশের কাজ কর্ম ব্যাহত হয়ে ক্রমশ জায়গাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এই রোগের কারণ নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে।

আরও পড়ুন: ‘হার্ড ইমিউনিটি’ গড়ে উঠতে আর কত দিন, ভ্যাকসিনই বা কবে?​

এসএলই হলে শরীরের বিভিন্ন অস্থিসন্ধি, ত্বক, রক্তবাহী শিরা ধমনি, হৃদপিণ্ড, ফুসফুস, লিভার, কিডনি সহ একে একে সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে। তবে ইমিউনো সাপ্রেসিভ ওষুধের সাহায্যে রোগের বাড়বাড়ন্ত অনেকাংশে ঠেকিয়ে রাখা যায়, বললেন ইন্টারন্যাল মেডিসিনের চিকিৎসক দীপঙ্কর সরকার। সিস্টেমিক লুপাস এরিথেমাটোসাস বা এসএলই মেয়েদের বেশি হচ্ছে।

আরও পড়ুন: কানের সমস্যায় অবহেলা? কতটা ক্ষতি করছেন জানেন?

লুপাস ফাউন্ডেশন অফ আমেরিকা জানিয়েছে যে ৩৯৩৬ জন লুপাস রোগীর মধ্যে ৩৫৯২ জন নারী এবং বাকি ৩৪৪ জন পুরুষ। বিশ্বব্যাপী সমীক্ষায় জানা গেছে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের এই রোগের ঝুঁকি ৯ গুণ বেশি। দীপঙ্কর বাবু জানালেন যে অটোইমিউন ডিজিজ এসএলই-র অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল শরীরের বিভিন্ন অংশ যখন তখন ফুলে ওঠা এবং ব্যথা করা। ডাক্তারি পরিভাষায় একে বলে অ্যাকিউট ও ক্রনিক ইনফ্ল্যামেশন।

শরীরের নানা অংশে লাল রঙের প্রদাহ তৈরি হয়। ফাইল ছবি

লুপাস অসুখটি হলে শরীরে নানা ধরনের অস্বাভাবিক অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। এই সব অপ্রয়োজনীয় অকেজো অ্যান্টিবডি শরীরের বিভিন অস্থিসন্ধি যেমন আঙুল, কবজি, হাঁটু, কনুই সহ ত্বক, হৃদপিণ্ড, ফুসফুস, চোখ, স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে। ওষুধ দিয়ে এইসব অ্যান্টিবডিকে আটকে না দিলে সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গের কাজ করার ক্ষমতা কমে গিয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ে। এসএলই-র উপসর্গ গুলি একনজরে জেনে নেওয়া যাক-

• হাতের আঙুলের গাঁট, কবজি, কনুই ফুলে গিয়ে ব্যথা হতে পারে, এই অসুখ হলে ৯০ % মানুষই গাঁটের ব্যথায় কষ্ট পান।

• মুখ ও নাকের মধ্যে ছোট ছোট ঘা হয়

• মূত্রনালি সংক্রমণ ও যোনিদ্বারেও আলসার বা ঘা হওয়ার ঝুঁকি থাকে, যন্ত্রণা করে

• নাকের দুপাশে ডানা মেলা প্রজাপতির মত লালচে র‍্যাশ বেরোয়, রোদ্দুর লাগলে সমস্যা বেড়ে যায়

• ৫০% ক্ষেত্রে এসএলই থাকলে রক্তাল্পতার ঝুঁকি বাড়ে

• অণুচক্রিকা কমে যেতে পারে

• লুপাস হলে ধমনিতে প্লেক অর্থাৎ চর্বির স্তর জমে যায়। এর ফলে হার্ট অ্যাটাক ও ব্রেন স্ট্রোকের ঝুঁকি থাকে

• হার্টের বিভিন্ন সমস্যা যেমন পেরিকার্ডাইটিস, মায়োকার্ডাইটিস ও এন্ডোকার্ডাইটিসের সম্ভাবনা বাড়ে

• ফুসফুসের আবরণ প্লুরাতে প্রদাহের ফলে প্লুরাইটিস হতে পারে

• পেনলেস হিমাচুরিয়া অর্থাৎ প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত বেরয় কোনও ব্যথা বেদনা ছাড়াই

• কিডনির কাজ এলোমেলো হয়ে কিডনি থেকে প্রোটিন বেরিয়ে যেতে পারে

তাই এ রকম কোনও উপসর্গ দেখলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া উচিত।

আরও পড়ুন: বাড়ি থেকেই এখনও কাজ, পিঠ-কোমরের ব্যথা কমাতে নিয়মিত এই সব মানতেই হবে​

১৫ – ৩৫ বছর বয়সী মহিলাদের মধ্যে এই রোগের ঝুঁকি বেশি। ঋতু চলাকালীন লুপাসের উপসর্গ বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। দেখা গেছে যে গর্ভনিরোধক ওষুধ খেলে এবং মেনোপজের পরে ইস্ট্রোজেন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি করালে এসএলইর উপসর্গ আরও অনেক বেড়ে যায়। তাই ধারণা করা হয় যে স্ত্রী হরমোন ইস্ট্রোজেন প্রোজেস্টেরনের সঙ্গে এই অসুখের একটা সম্পর্ক আছে। আধুনিক মেডিক্যাল সায়েন্সের কল্যাণে সঠিক চিকিৎসা ও জীবনযাত্রার মান বদল করে আর পাঁচজন মানুষের মতো দীর্ঘায়ু পেতে পারেন এই রোগী। প্রয়োজন সচেতনতা, ভাল থাকুন, আনন্দে থাকুন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE