Advertisement
E-Paper

ক্যানসার-যুদ্ধ জারি রেখে জিতে গেলেন মা

নিজে বাঁচতে চাই, আর নিজের বাচ্চাটাকেও বাঁচাতে চাই। ডাক্তারদের কাছে গিয়ে এই একটা কথাই বলেছিলেন ২৯ বছরের শাবানা পরভিন। একাধিক ডাক্তার জানিয়েছিলেন, এ রোগের যা গতিপ্রকৃতি তাতে এমন ইচ্ছাপূরণ অসম্ভব।

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০১:৪৭
সদ্যোজাতকে নিয়ে শাবানা পরভিন। — নিজস্ব চিত্র।

সদ্যোজাতকে নিয়ে শাবানা পরভিন। — নিজস্ব চিত্র।

নিজে বাঁচতে চাই, আর নিজের বাচ্চাটাকেও বাঁচাতে চাই। ডাক্তারদের কাছে গিয়ে এই একটা কথাই বলেছিলেন ২৯ বছরের শাবানা পরভিন। একাধিক ডাক্তার জানিয়েছিলেন, এ রোগের যা গতিপ্রকৃতি তাতে এমন ইচ্ছাপূরণ অসম্ভব। সন্তানকে বাঁচানোর কথা ভুলে যাওয়াই ভাল। হাল ছাড়েননি শাবানা। দিব্যি সুস্থ-সমর্থ ছেলেকে কোলে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার সময়ে তাই আক্ষরিক অর্থেই যুদ্ধজয়ের হাসি তাঁর মুখে।

গর্ভের সন্তানের বয়স যখন তিন মাস পেরিয়ে গিয়েছে, তখনই স্তন ক্যানসার ধরা পড়েছিল শাবানার। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে জানা যায়, রোগটা নেহাত প্রাথমিক পর্যায়ে নেই, ছড়িয়েছে অনেকটাই। এই পরিস্থিতিতে দ্রুত অস্ত্রোপচার দরকার। ডাক্তাররা জানিয়েছিলেন, ক্যানসারের অস্ত্রোপচারের পাশাপাশি দ্রুত ভ্রূণটিকেও নষ্ট করে ফেলতে হবে। কিন্তু তিন মাস পেরোনোর পরে সে ক্ষেত্রেও ঝুঁকি কিছু কম নয়। তা ছাড়া, শাবানা নিজেও এতে সায় দেননি। একের পর এক ডাক্তারের কাছে গিয়ে বিফল মনোরথ হওয়ার পরে শেষ পর্যন্ত তাঁর অনুরোধে সায় দিলেন কয়েক জন ক্যানসার চিকিৎসক। তাঁরা তো বটেই, সঙ্গে স্ত্রী-রোগ চিকিৎসক, শিশু-চিকিৎসককে নিয়ে গড়ে উঠল ডাক্তারদের একটি দল। পরবর্তী ২০ সপ্তাহ তাঁদের তত্ত্বাবধানেই ছিলেন শাবানা। দিন কয়েক আগে ই এম বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালে দু’কিলো ২০০ গ্রাম ওজনের সুস্থ সন্তানের জন্ম দিয়েছেন ওই তরুণী।

তবে শুনতে যতটা সহজ মনে হচ্ছে, আগাগোড়া রাস্তাটা একেবারেই তত সহজ ছিল না। বরং উদ্বেগ, সংশয় ছিল প্রতি পদে। রাজারহাটের কাছে একটি ক্যানসার হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করে তাঁর একটি স্তন বাদ দেওয়ার পরে জানা গিয়েছিল ক্যানসার ছড়িয়েছে লিম্ফ নোডেও। শুরু হল কেমোথেরাপি। তিন-তিনটি কেমোথেরাপির পরে রক্তে শ্বেতকণিকার মাত্রা কমতে লাগল হু হু করে। চতুর্থ কেমোর আগে তাই সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার করে শিশুটিকে বাইরে আনার সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসকেরা। যে স্ত্রী-রোগ চিকিৎসক শাবানার সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার করেছেন, সেই সুদীপ বসু বলেন, ‘‘যেহেতু শ্বেতকণিকা কমছিল, তাই যে কোনও ধরনের অস্ত্রোপচারের পরে সেপ্টিসেমিয়ার ভয় থেকে যায়। তার জেরে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হতে পারে। কিন্তু একে রুখে দেওয়ার পন্থাও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে রয়েছে। তা অনুসরণ করেই তৃতীয় কেমোথেরাপির তিন সপ্তাহ পরে যখন শ্বেতকণিকার পরিমাণ কিছুটা বাড়ল, তখন কড়া অ্যান্টিবায়োটিক এবং অন্য কিছু ওষুধ প্রয়োগ করে সিজারিয়ান-এর সিদ্ধান্ত নিই।’’

সাধারণ ভাবে অস্ত্রোপচার করে স্তন বাদ দেওয়ার পরে রেডিওথেরাপি করা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে রেডিওথেরাপি করলে গর্ভস্থ ভ্রূণের ক্ষতির ঝুঁকি ছিল খুবই বেশি। তাই তা করা যায়নি। কিন্তু দিন কয়েকের মধ্যেই চতুর্থ কেমোথেরাপি শুরু করতে হবে বলে জানিয়েছেন ডাক্তাররা। যে ক্যানসার চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে শাবানার কেমোথেরাপি চলছে, সেই সঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘খুব ভেবেচিন্তে আধুনিক কেমো প্রয়োগ করা হয়েছে। এতে শিশুর তেমন কোনও ক্ষতির ভয় নেই বলেই আমাদের বিশ্বাস।’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘অধিকাংশ চিকিৎসকই সন্তানটিকে নষ্ট করে দেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু আমরা জানতাম, এটা পুরনো ভাবনা। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান বহু দূর এগিয়ে গিয়েছে। তবে কাজটা সফল হওয়ার পিছনে দলের প্রত্যেক চিকিৎসকের পরস্পরের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগটা খুব জরুরি ছিল। সেটা করা গিয়েছে।’’

যে ক্যানসার শল্যচিকিৎসক শাবানার সন্তান-সহ বাঁচার আকুতিকে সফল করতে রাজি হয়েছিলেন, সেই রোজিনা আহমেদ জানান, এ সব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত অনেক বিষয়ের উপরে নির্ভরশীল। গর্ভাবস্থার কোন পর্যায়ে রয়েছে, অসুখটা কতটা ছড়িয়েছে, মেয়েটির মনের জোর কতটা, পারিবারিক সহায়তা কতটা পাবে ইত্যাদি। সব দিক বিচার করে যদি মনে হয় কাজটা সম্ভব, তখনই রাজি হওয়ার প্রসঙ্গ আসে। রোজিনা বলেন, ‘‘কেমোর ওষুধ শরীরে যাওয়ার পরে কিছুটা বিষক্রিয়া হয়, সেই কারণেই আমরা কিছুটা সময় নিয়েছিলাম। ভ্রূণ নির্দিষ্ট আকার নেওয়ার পরে প্রথম কেমো শুরু হয়। শাবানা ওর বাড়ি থেকে সব ধরনের সাহায্য পেয়েছে, সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ।’’

এক জন ক্যানসার আক্রান্তের গর্ভে বেড়ে ওঠার ফলে শিশুটির কি কোনও ঝুঁকি ছিল না? শাবানার সন্তান যাঁর অধীনে জন্মেছে, সেই শিশু চিকিৎসক ব্রজ রায় জানিয়েছেন, শিশুটি গর্ভে থাকা অবস্থায় নিয়মিত পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘শুধু একটি ক্ষেত্রেই আপোস করতে হয়েছে। শিশুটিকে স্তন্যপান করানো যাবে না। এই একটি ক্ষেত্রে বাধ্য হয়েই বেবিফুডের উপরে নির্ভর করতে হবে আমাদের। ব্রেস্ট মিল্ক ব্যাঙ্কের উপরেও ভরসা করতে পারছি না। যদিও এইচআইভি পরীক্ষা করা থাকে, তবুও এ ক্ষেত্রে আমরা কোনও রকম ঝুঁকি নিতে চাই না।’’

প্রশ্ন উঠেছে, শারীরিক এমন জটিলতা নিয়ে কি সন্তানের জন্ম দেওয়াটা খুব জরুরি ছিল? এই প্রশ্নের উত্তরটা শাবানা ও তাঁর চিকিৎসকেরা দিয়েছেন দু’ভাবে।

শাবানার কথায়, ‘‘অসুখ হয়েছে বলে একটা প্রাণকে নষ্ট করতে মন চায়নি। শেষ পর্যন্ত লড়তে চেয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, যদি সফল হই তা হলে অন্য অনেকেই এটা দেখে এগোতে সাহস পাবে।’’ আর শাবানার ডাক্তারদের বক্তব্য, ‘‘ক্যানসার মানেই জীবনের শেষ, এই ধারণাটা থেকে বেরোনোর সময় এসেছে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান আমাদের সেই সাহসটা জুগিয়েছে।’’

soma mukhopadhyay cancer patient breast cancer breast cancer patient breast cancer fight abp health news
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy