Advertisement
E-Paper

স্নায়ুর চিকিৎসায় পিছিয়ে নেই কলকাতা

মস্তিষ্কে পেসমেকার বসানো হোক কিংবা মাথা থেকে টিউমার কেটে বার করা, এখন সবই হচ্ছে এ শহরে। আধুনিক যন্ত্রের সৌজন্যে বাগে আনা সম্ভব হচ্ছে মোয়ামোয়ার মতো জটিল রোগকেও। লিখছেন পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় মস্তিষ্কে পেসমেকার বসানো হোক কিংবা মাথা থেকে টিউমার কেটে বার করা, এখন সবই হচ্ছে এ শহরে। আধুনিক যন্ত্রের সৌজন্যে বাগে আনা সম্ভব হচ্ছে মোয়ামোয়ার মতো জটিল রোগকেও।

শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০১৯ ২২:০৬

রোগী দিব্যি সজাগ, চোখ বন্ধ করে পছন্দের গান শুনছেন আর চিকিৎসকেরা তাঁর মস্তিষ্কে লোকাল অ্যানাস্থেশিয়া করে অস্ত্রোপচার চালিয়ে যাচ্ছেন!

শুনতে গল্পকথা, কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞান এখন এতটাই এগিয়ে গিয়েছে। স্নায়ুর জটিল সমস্যার অত্যাধুনিক পরিষেবা এখন কলকাতা শহরের একাধিক হাসপাতালে মিলছে। যদিও চিকিৎসকদের একাংশের মতে, দক্ষিণ ভারতের একাধিক রাজ্য এবং মুম্বই বা দিল্লির তুলনায় স্নায়ুর চিকিৎসায় এখনও কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গ অনেকটা পিছিয়ে। তবে গত কয়েক বছরে এ ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে কলকাতা। ডিপ ব্রেন স্টিমুলেশন, নিউরো নেভিগেশন প্রসেস, ব্রেন পেসমেকার, স্টিরিওট্যাকটিক ব্রেন বায়োপসি, রোবোটিক থেরাপি, ভার্চুয়াল রিহ্যাব, এন্ডোস্কোপি অব ব্রেনের মতো অসংখ্য নতুন পদ্ধতিতে কলকাতায় এখন স্নায়ুজনিত সমস্যার চিকিৎসা হচ্ছে। চিকিৎসকদের মতে, এটা পাঁচ বছর আগেও ভাবা যেত না।

প্রবীণ স্নায়ু শল্য-চিকিৎসক গৌরীকুমার প্রুস্তি জানাচ্ছিলেন, পার্কিনসনস বা অ্যাবনর্ম্যাল মুভমেন্ট-এর অনেক কেসেই এখন কলকাতায় ব্রেন পেসমেকার বসানো হচ্ছে। মাথার খুলির হাড় ও তার উপরের চামড়ার মাঝামাঝি ফাঁকে পেসমেকার বসানো হয়। এটি মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট জায়গার কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করে এবং রোগীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অস্বাভাবিক নড়াচড়া নিয়ন্ত্রিত হয়। এই অস্ত্রোপচার করা হয় রোগীকে সজাগ রেখে। শুধু খুলিতে লোকাল অ্যানাস্থেশিয়া দেওয়া হয়। রোগী কোনও যন্ত্রণা অনুভব করেন না।

নিউরো নেভিগেশন যন্ত্রের মাধ্যমে মাথায় ঠিক কোন জায়গায় টিউমার হয়েছে তা চিহ্নিত করে সেই অংশটুকু কেটে টিউমার বার করা যায় বা বায়োপসির মাধ্যমে টিস্যু তোলা যায়। খুলি পুরো খুলতে হয় না। তাতে মস্তিষ্কের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কাও অনেক কমে। চিকিৎসকেরা এখন অস্ত্রোপচারের সময়ে নিউরো মনিটরিংয়ের সাহায্য নেন। এর মাধ্যমে মস্তিষ্কের কোন অংশে ছুরি চালানো যাবে, কোথায় কাটলে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, তার আন্দাজ আগে থেকে পাওয়া যায় এবং চিকিৎসকও আগেভাগে সতর্ক হতে পারেন। গৌরীকুমার জানালেন, মস্তিষ্কে এখন বাইপাস সার্জারিও করা হয়। তাতে মস্তিষ্কে রক্তসঞ্চালন স্বাভাবিক করে মোয়ামোয়ার মতো জটিল রোগও অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে। এ ছাড়াও হচ্ছে এন্ডোস্কোপিক ক্লট রিমুভাল। অর্থাৎ, নাক দিয়ে এন্ডোস্কোপ ঢুকিয়ে, মাথার খুলিতে ছোট ফুটো করে তার মধ্যে দিয়ে মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাতে ঠিক কোন জায়গায় অস্ত্রোপচার দরকার বোঝা যাচ্ছে। ঠিক সেইটুকু অংশ কাটা হচ্ছে। ‘ভেন্ট্রিকুলোস্ট্রোমি’ হচ্ছে আকছার, অর্থাৎ মাথায় জল জমে মাথা বড় হয়ে গেলে সেই জল একটা ফুটো করে বের করে দেওয়া যাচ্ছে।

স্নায়ু শল্য-চিকিৎসক সত্যনারায়ণ সিংহ জানালেন, মস্তিষ্কের জটিল অস্ত্রোপচারের সময়ে এখন কলকাতায় অনেক ক্ষেত্রে ‘ইন্ট্রা অপারেটিভ ইলেক্ট্রো কোর্টিকোগ্রাফি’-র সাহায্য নেওয়া হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে মস্তিষ্কের উপরিভাগে ইইজি লিড রেখে ঠিক কোন জায়গায় সমস্যা রয়েছে, তা দেখা হয়। আমূল পরিবর্তন এসেছে মৃগী রোগের চিকিৎসায়। স্নায়ু চিকিৎসক আশিস দত্ত জানালেন, ওষুধ খেলেও যে মৃগী ভাল হয় না তাকে ‘রিফ্যাক্টরি এপিলেপ্সি’ বলা হয়। যাঁদের এই ধরনের মৃগী থাকে, তাঁদের হাসপাতালে পাঁচ-ছ’দিন ভর্তি করে রেখে টানা ইইজি করা হয়। একে ‘লং টার্ম ভিডিয়ো টেলিমেট্রি ইইজি’ বলা হয়। মস্তিষ্কের কোন জায়গায় এই রোগ সৃষ্টি হচ্ছে এবং সেখানে অস্ত্রোপচার সম্ভব কি না, তা যন্ত্রের মাধ্যমে দেখে নেওয়া হয়। যদি দেখা যায়, অস্ত্রোপচার সম্ভব, তা হলে করা হয়। এই ভাবে জটিল মৃগীতে ভোগা অনেক রোগী সুস্থ হচ্ছেন। তবে সকলের ক্ষেত্রে এই অস্ত্রোপচার সম্ভব নয়।

স্ট্রোক থ্রম্বোলিসিস বা স্ট্রোকের ফলে মাথায় রক্ত জমাট বেঁধে রোগীর প্রাণ সংশয় হতে পারে বা অঙ্গসমূহ বিকল হতে পারে। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, বিশেষ পদ্ধতিতে এই জমাট রক্ত ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে গলিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া কয়েক বছর আগেও কলকাতায় খুব কম সংখ্যায় হত, এখন তা মুড়িমুড়কির মতো হচ্ছে। স্নায়ু চিকিৎসক কিশলয় করণ জানাচ্ছিলেন, অনেক সময়ে রোগীর এনসেফ্যালোপ্যাথি হয়। মস্তিষ্ক ভাল করে কাজ করতে পারে না। কিন্তু সেই রোগীর স্ট্রোক হয়নি, মস্তিষ্কের কাজ না করার কোনও কারণও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। রক্তের বিশেষ কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে এখন এই ধরনের এনসেফ্যালোপ্যাথির কারণ জানা যাচ্ছে। ফলে তার সঠিক চিকিৎসাও সম্ভব হচ্ছে। মস্তিষ্কের বায়োপসির জন্য আগে পুরো খুলি খুলতে হত। এখন স্টিরিওট্যাকটিক ব্রেন বায়োপসি হচ্ছে। এর জন্য মস্তিষ্কের ছোট একটি অংশ কাটলেই চলে।

মস্তিষ্কের চিকিৎসায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে পুনর্বাসন বা রিহ্যাব প্রক্রিয়ার। ভাল চিকিৎসা পাওয়া সত্ত্বেও যথাযথ রিহ্যাবের অভাবে অনেক রোগী স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন না। কলকাতার বেশ কিছু হাসপাতালে এখন অতি উন্নতমানের রিহ্যাব প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে। স্নায়ু চিকিৎসক তথা রিহ্যাব বিশেষজ্ঞ সুপর্ণ গঙ্গোপাধ্যায় জানান, স্ট্রোকের পরে অনেকের খাবার গিলতে অসুবিধা হয়। খাবারের কণা ফুসফুসে চলে যাচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য এখন ‘ফ্লেক্সিবল ফাইবার-অপটিক ইভ্যালুয়েশন অব সোয়ালোইং’ পরীক্ষা হয়। স্পাইনাল কর্ডে আঘাতের পরে অনেকের দেহের নীচের অংশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়। মল-মূত্র ত্যাগের উপরে নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এই অবস্থায় এখন ‘ইউরোডায়নামিক্স সেট আপ’-এর মাধ্যমে ব্ল্যাডারের কার্যকলাপ পরীক্ষা করা হচ্ছে। সেরিব্রাল পলসি আক্রান্ত শিশুদের জন্য শুরু হয়েছে পেডিয়াট্রিক রিহ্যাব ইউনিট।

এ ছাড়া, স্প্যাস্টিসিটি বা শরীরের কোনও অংশ চালনায় অসুবিধা থাকলে ‘ইএনজি বায়ো-ফিডব্যাক’ নামে নতুন পদ্ধতি কিছু জায়গায় অনুসরণ করা হচ্ছে। এতে মাংসপেশির উপরে রোগীর ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ ফিরে আসছে। রোগীর শরীরে ভারসাম্যের সমস্যার চিকিৎসায় কলকাতার কিছু চিকিৎসক ‘ভার্চুয়্যাল রিহ্যাব’ নামে নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি শুরু করেছেন। সব মিলিয়ে স্নায়ু চিকিৎসার পরিকাঠামোয় ক্রমশ সাবালক হয়ে ওঠা কলকাতাকে আর এলেবেলের দলে ফেলে রাখা যায় না বলেই মত চিকিৎসকদের।

Health Neurological Treatment Kolkata
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy