Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
শুধু শরীর নয়, করোনার গ্রাসে দমবন্ধ মনও
Children

অজান্তে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের অংশীদার ছোটরাও 

হাসিখুশি মেয়ে কেমন যেন থম মেরে বসে থাকছে এক জায়গায়। খাওয়ারও বিশেষ ইচ্ছে নেই।

দেবাশিস ঘড়াই
শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০২০ ০০:৩৯
Share: Save:

প্রশ্নটা প্রথম বার শুনে থমকে গিয়েছিলেন বেলেঘাটার বাসিন্দা পারমিতা ভট্টাচার্য।

কিন্তু সাত বছরের মেয়ে পিকু যখন আবার জিজ্ঞেস করল, “মা আমরা কি মরে যাব?” তখন হাল্কা ভাবে নিতে পারলেন না পারমিতা। কিছু দিন ধরেই দেখছিলেন, হাসিখুশি মেয়ে কেমন যেন থম মেরে বসে থাকছে এক জায়গায়। খাওয়ারও বিশেষ ইচ্ছে নেই। টেলিভিশনে, সংবাদপত্রে শুনছিলেন, পড়ছিলেন লকডাউন ও তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ বাচ্চাদের মনেও কী রকম প্রভাব ফেলেছে, যাকে একদমই হাল্কা ভাবে দেখা উচিত নয়। তাই এক বন্ধুর কাছ থেকে মনোবিদের নম্বর জোগাড় করে ফোন করেছিলেন।

শ্যামবাজারের বাসিন্দা সুবিমল মিত্রের দশ বছরের ছেলে টুকাইয়ের প্রশ্ন ছিল, “লকডাউন কবে শেষ হবে?” পারমিতার মতোই এর উত্তর দিতে পারেননি সুবিমলও। কারণ, উত্তরটা যে তাঁরও জানা নেই। যেমনটা জানেন না প্রিয়াঙ্কা চৌধুরী। তাই আট বছরের মেয়ে রিম্পা যখন জিজ্ঞেস করে, “বাবা কাজে বেরোচ্ছে না। তা হলে কি আমরা গরিব হয়ে যাব মা?” তখন কথা খুঁজে পান না তিনিও। শুধু বুঝতে পারেন বাড়িতে ক্রমাগত চাকরির অনিশ্চয়তা নিয়ে আলোচনা মন দিয়ে শুনেছে আট বছরের মেয়েও। সেই উদ্বেগই ছায়া ফেলেছে তার প্রশ্নে।

পিকু, টুকাই, রিম্পাদের উদ্বেগ বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। মনোবিদ-গবেষকেরা জানাচ্ছেন, বাচ্চা এবং কমবয়সিদের প্রশ্নের অভিমুখ বদলে দিয়েছে কোভিড-১৯। ‘কবে আবার খেলতে বেরোব’, ‘কবে স্কুলে যাব’ থেকে শুরু করে ‘বাবা কাজে যাচ্ছে না, তা হলে কি আমরা গরিব হয়ে যাব?’― অনিশ্চিত ভবিষ্যতের এমন চিন্তা গভীর ছাপ ফেলেছে ছোটদের মনে।

মানসিক চিকিৎসার উৎকর্ষকেন্দ্র ‘ইনস্টিটিউট অব সাইকায়াট্রি’-র অধিকর্তা প্রদীপ সাহা জানাচ্ছেন, দৌড়ঝাঁপ করা, বন্ধুদের সঙ্গে খেলা, স্কুলে যাওয়া, একসঙ্গে ক্লাস করা― ছোটদের সব রকম ‘সাইকোমোটর অ্যাক্টিভিটি’ সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কারণে আচমকা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বাইরের হুল্লোড়ের জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে বাড়ির মধ্যে আটকে পড়েছে তাদের মন। প্রদীপবাবুর কথায়, ‘‘শুধু তা-ই নয়, চাকরি, ভবিষ্যৎ নিয়ে বাড়ির বড়দের অবসাদ, দুশ্চিন্তার শরিক (শেয়ারড ডিপ্রেশন) হচ্ছে তারাও।’’

বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েরা অবসাদের শিকার হয়ই। কিন্তু বাচ্চাদের অবসাদ হয় কি না, অতীতে তা নিয়ে সংশয় ছিল। তবে দীর্ঘ গবেষণায় এটা পরিষ্কার, বাচ্চারাও অবসাদের শিকার হয়। যার সূত্রপাত হতে পারে ছ’-সাত বছর বয়স থেকেই। সে কারণে অনেক গবেষণার পরে আমেরিকার ‘ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ (এফডিএ) আট ও তার বেশি এবং ১২ ও তার বেশি বছর বয়সিদের অবসাদ কাটানোর জন্য ওষুধের অনুমোদনও দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষকের কথায়, ‘‘সারা বিশ্বেই এফডিএ-র মান্যতা রয়েছে। তাই তারা ওই ওষুধের অনুমোদন দিয়েছে। যদিও তারা স্পষ্ট বলেছে, সতর্কতার সঙ্গেই তা নিতে হবে।’’

গবেষকদের একাংশের বক্তব্য, সংখ্যাগরিষ্ঠ বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েদের কাছে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তবু স্বচ্ছ ধারণা রয়েছে। কিন্তু অনেক বাচ্চার কাছেই পুরো ব্যাপারাটা এখনও ধোঁয়াশা। যা তাদের বাহ্যিক আচরণে প্রভাব ফেলছে। পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ জানাচ্ছেন, ২-৮ বছর বয়সি বাচ্চারা এই ক’দিনে অসম্ভব জেদি, খিটখিটে হয়ে গিয়েছে। বাবা-মাকে তারা আঘাত করছে, জিনিস ছুড়ছে। আবার ৯-১৭ বছর বয়সি ছেলেমেয়েদের মেজাজ পাল্টাচ্ছে দ্রুত। পায়েলের কথায়, ‘‘একা ঘরে বন্দি হয়ে দিনের অধিকাংশ সময়েই ওরা স্মার্টফোনে ডুবে থাকে। অভিভাবকদের সঙ্গে তর্ক করার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছে ওদের।’’ বিহেভিয়োরাল সায়েন্টিস্ট সঞ্জীব বসুর কথায়, ‘‘বাইরের হইহুল্লোড়ের জগৎ ছোট হয়ে ঘরের মধ্যে চলে আসার প্রভাব পড়ছে ছোটদের আচরণে।’’ ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টস’-এর সাম্মানিক জেনারেল সেক্রেটারি মনোজ কে বজাজ বলছেন, ‘‘ছোটদের মনে কোনও কৌতূহল জন্মালে তার উত্তর তারা বাবা-মায়ের থেকে পায়। এখন তো অভিভাবকেরা নিজেই জানেন না কী হবে আগামী দিনে। ফলে অজান্তে অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের অংশীদার হচ্ছে ছোটরাও!’’

(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।

• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE