Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
প্রত্যেক বছর এই পৃথিবীর বুকে বেড়ে চলেছে মানুষের কার্বন ফুটপ্রিন্ট। ভাল নেই পৃথিবী। রোগ-ব্যধি গ্রাস করছে পৃথিবী, তথা মানুষকে। এখনও পদক্ষেপ না করলে বিপদ আরও বাড়বে
CO2

প্রাণ চাই... চাই মুক্ত বায়ু

পৃথিবীর বুকে রোজ আমাদের কার্বন ফুটপ্রিন্ট বেড়েই চলেছে। আমাদের প্রত্যেক পদক্ষেপের উপরে নির্ভর করছে কার্বন ফুটপ্রিন্ট বাড়বে না কমবে।

নবনীতা দত্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ মে ২০২২ ০৭:১২
Share: Save:

একটা সাদা দেওয়াল বা সবুজ মোরামে ঢাকা রাস্তায় যদি কেউ কালো পিচ ঢেলে দিয়ে যায়, কেমন লাগবে? ঠিক সেই কাজটা করে চলেছি আমরা। পৃথিবীর বুকে রোজ আমাদের কার্বন ফুটপ্রিন্ট বেড়েই চলেছে। আমাদের প্রত্যেক পদক্ষেপের উপরে নির্ভর করছে কার্বন ফুটপ্রিন্ট বাড়বে না কমবে।

কার্বন ফুটপ্রিন্ট কেন বাড়ছে?

কোনও একক ব্যক্তি বা সংস্থা বা পণ্য উৎপাদনের কারণে সৃষ্ট মোট গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণকে প্রকাশ করা হয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড সমতুল্য এককে। একেই কার্বন পদচিহ্ন বা কার্বন ফুটপ্রিন্ট হিসেবে গণ্য করা হয়। জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে, খাদ্য, শিল্পজাত পণ্য উৎপাদন, সড়ক নির্মাণ, গৃহনির্মাণ, পরিবহণে রোজই কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও মিথেনের মতো কার্বনবাহী গ্যাসসহ অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয়। ফলে প্রকৃতির বুকে যে ভাবে কার্বন লোড বাড়ছে, তাতে বিশ্ব উষ্ণায়ন বাড়ছে, আখেরে ক্ষতি হচ্ছে সমগ্র ইকোসিস্টেমের। প্রত্যেকের দৈনন্দিন কাজের ফলে কার্বন ফুটপ্রিন্ট কতটা বাড়ছে, তা হিসেবও করা যায়। তার জন্য মাসের ইলেকট্রিক বিল, মাসে কত মাইল গাড়ি চলেছে, কত বার যানবাহনে চলাচল করেছেন তার সবই ধরা হয়।

পরিবেশবিদ সুভাষ দত্ত বলছেন, ‘‘সকাল থেকে রাতে ঘুমোনোর মধ্যেও আমরা কার্বন ফুটপ্রিন্ট বাড়িয়ে চলেছি। অনেক ছাত্রছাত্রী রাত জেগে দুটো-তিনটে অবধি পড়ে। এতেও কার্বন ফুটপ্রিন্ট বাড়াচ্ছি। রাত অবধি জেগে থাকা মানে ততক্ষণ আলো জ্বলছে। তার চেয়ে রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে ভোরবেলা দিনের আলোয় কাজ সারলে বা পড়াশোনা করলে বিদ্যুৎ অপচয় রোধ করা যায়। যে কোনও জ্বালানির থেকেই কার্বন ফুটপ্রিন্ট বাড়ছে। একই কথা প্রযোজ্য এসির ব্যবহারে। এসির ব্যবহার বাড়ার কারণে পরিবেশ আরও গরম হচ্ছে।’’ তার চেয়ে বাড়িতে ইনসুলেশনের ব্যবস্থা করা যায়। বাড়ির ছাদে হলো ব্রিক দিয়ে রুফ ট্রিটমেন্ট করা যায়। এতে গরম কম হয়। তার উপরে বাগান থাকলে তো কথাই নেই। যানবাহনের ধোঁয়া থেকে বাতাসে মিশছে কার্বন। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দু’ভাবেই পরিবেশে কার্বন ফুটপ্রিন্ট বাড়ছে। অনেক কারণ সম্পর্কে আমরা অবগত নই বা জানলেও সচেতন পদক্ষেপ করছি না।

সুভাষ দত্তর কথায়, ‘‘দেশজ আনাজপাতির তুলনায় এখন অনেকেই বিদেশি আনাজ, ফল খেতে বেশি পছন্দ করেন, যা আসে বিমানে। বিমানের জ্বালানি থেকেও তো কার্বন এমিশন হচ্ছে। তার চেয়ে দেশজ খাবারে ভরসা রাখা যায়। প্রত্যেক স্থান অনুযায়ী প্রকৃতি তো খাবারের জোগান দিয়েছে। রাতে পার্কে বা খেলার আয়োজন করে বড় পাওয়ারের আলো জ্বালিয়েও একই সমস্যা তৈির হচ্ছে।’’ এর পরে রয়েছে প্রযুক্তি জগৎ ও শিল্পজগতের জন্য কার্বন এমিশন।

উপায় অনেক

*প্রথমেই জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। আমাদের দেশে সূর্যালোকের অভাব নেই। বাড়িতে সোলার প্যানেল বসিয়ে নিতে পারলে সমস্যা কমবে। উইন্ড ও সোলার পাওয়ার কার্বন এমিশন করে না। সেই পাওয়ার প্লান্টের নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কেবল যেটুকু কার্বন এমিশন হয়। তাই বড় পরিসরে উইন্ড ও সোলার পাওয়ারে ভরসা রাখা যায়।
*কেনাকাটা করার সময়ে কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে বেরোন। এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী শান্তনু ভৌমিক বললেন, ‘‘প্লাস্টিক উৎপাদনের সময়ে কার্বন নির্গত হয়। কিন্তু প্লাস্টিক রিসাইকল করে নতুন জিনিস তৈরি করার সময়ে নির্গত কার্বনের পরিমাণ কম। প্লাস্টিক তৈরির সময়ে ১০০ শতাংশ কার্বন নির্গত হলে রিসাইকলের সময়ে তা মাত্র ৩০ শতাংশ।’’ তাই রিসাইকলড প্লাস্টিকের জিনিস ব্যবহার করলেও কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমবে।
*বাড়িতে অনেক সময়েই এসি বা গিজ়ারের মেন সুইচ অন থাকে। চার্জ দেওয়া হয়ে গেলেও চার্জার ঝুলতে থাকে প্লাগ পয়েন্টে। এই সব দিকে সচেতনতা জরুরি। প্রত্যেকটা ইলেকট্রনিক জিনিস ব্যবহারের পরে বন্ধ করুন। বিদ্যুৎ অপচয় বন্ধ করতে এলইডি বাল্ব লাগাতে পারেন বাড়িতে।

যাতায়াতে

এখন বাজারে ই-বাইক সহজপ্রাপ্য। শহরের মধ্যে যাতায়াতে ভরসা রাখতে পারেন ই-বাইকে। কাছাকাছি যাতায়াতের জন্য সাইকেল রাখুন। গাড়ি চালানোর সময়েও বারবার অ্যাকসেলেটর বা ব্রেক দেওয়ার অভ্যেসে রাশ টানতে হবে। এতেও জ্বালানি বাঁচে। কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমবে পৃথিবীর বুকে। মাস-ট্রান্সপোর্টেশনেও সমস্যা কমবে অনেকটা। তাই যথাসম্ভব পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যাতায়াত করলেই ভাল। বিদেশে লো-ইমপ্যাক্ট ইলেকট্রিক ও হাইব্রিড ট্রেনে যাতায়াত বাড়ছে। বিমানপথে যাতায়াতের আগেও সচেতন হন। লং ডিসট্যান্সের চেয়ে শর্ট রুটের বিমানে গ্রিন হাউস গ্যাস এমিশন বেশি হয়। তাই লেজ়ার-ফ্লায়িং কমানোর জন্য আবেদন জানাচ্ছেন ক্লাইমেট অ্যাক্টিভিস্টরা। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রেটা থুনবার্গ, দেশের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছতে ভরসা রাখেন ট্রেনে। দূরদেশে পৌঁছতে বিমানের বদলে জলপথে যাতায়াতের নজির তৈরি করেছেন গ্রেটা।

অরণ্য-আচ্ছাদন

কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মতো বিষাক্ত গ্যাস শোষণ করে অক্সিজেনের মতো প্রাণবায়ুতে পৃথিবী ভরিয়ে দিতে পারে একমাত্র গাছ। তাই প্রত্যেক মাসে বা সব-অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে বৃক্ষরোপণের পরিকল্পনা রাখুন। শুধু গাছ পুঁতলেই হবে না। অনেকে হয়তো একশো-দেড়শো গাছ লাগাচ্ছেন। কিন্তু তার মধ্যে বেঁচে থাকছে দশ-বারোটা। তাই যে ক’টা গাছ লাগাচ্ছেন, বড় না হওয়া পর্যন্ত তার দায়িত্বও নিতে হবে। অরণ্য সংরক্ষণের পদক্ষেপও জরুরি।

ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট

কার্বন ফুটপ্রিন্টের পাশাপাশি সচেতন হতে হবে ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট সম্পর্কে। হাইপার-কানেক্টেড এই জীবনে ডিজিটাল লাইফ একটা সমান্তরাল জগৎ তৈরি করেছে। এই ডিজিটাল জগতের এনার্জি কনজ়াম্পশন কার্বন ফুটপ্রিন্ট বাড়িয়ে চলেছে ভয়ঙ্কর ভাবে। একটি বিদেশি জার্নালের স্টাডি অনুযায়ী, প্রত্যেক বছর ডিজিটাল সেক্টরের এনার্জি কনজ়াম্পশন বাড়ছে ৯ শতাংশ হারে। ট্যাব, স্মার্টফোন, ল্যাপটপ-সহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক জিনিস চার্জ দিতে ব্যয় হচ্ছে বিদ্যুৎ। তার উপরে স্মার্টফোনের আপডেটেড ভার্শনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে প্রতি দু’বছরে বদলাতে হচ্ছে ফোন। এই ফোন উৎপাদনেও কার্বন ফুটপ্রিন্ট বাড়ছে। ফোন ও ইলেকট্রনিক জিনিসের হার্ডওয়্যার তৈরি করতে কিছু দুষ্প্রাপ্য ধাতু ও আর্থ এলিমেন্ট ব্যবহার করা হয়, ফলে সে দিক দিয়েও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যয় হচ্ছে। এর পরে রয়েছে ডেটা ট্রাফিক। রোজ প্রত্যেক ফোনেই ঢুকছে একাধিক মেল, ভিডিয়ো। এগুলোর স্টোরেজের জন্যও ক্রমশ গিগাবাইটস বাড়ছে। এই ডিজিটাল ফুটপ্রিন্টও এ বার নিয়ন্ত্রণ করার পালা। নিয়মিত ট্র্যাশ ক্লিয়ার করুন। তথ্য যাচাই ও সংগ্রহ করতে সার্চ-ইঞ্জিনে ভরসা কমিয়ে বই পড়ার অভ্যেসও গড়ে তোলা যায়।

নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে, সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে দ্রুত পদক্ষেপ জরুরি। দৈনন্দিন জীবনে অভ্যেস বদলের সঙ্গে-সঙ্গে সমষ্টিগত পদক্ষেপও করতে হবে। পরিবেশবান্ধব জীবনের কোনও বিকল্প নেই। না হলে বিলুপ্তি অনিবার্য। টেকনোলজির ব্যবহারে আমরা যত দ্রুত এগোচ্ছি, তত দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছি সমাপ্তিরেখার দিকে। তাই কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমিয়ে যে পদচিহ্ন দিকনির্দেশ করে আলোর দিকে, সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করাই এখন একমাত্র উপায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

CO2 Environment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE