Advertisement
E-Paper

একলা হয়ে পড়ছে না তো খুদে, ছোট্ট মনের খেয়াল রাখুন

বছর বারো বয়স। দু’জনে একই ক্লাসে পড়ে। মেয়েটিকে খুব ভাল লাগত সোহমের। কিন্তু বলার সাহস করে উঠতে পারছিল না। যদি সটান না বলে দেয়...। সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়। বন্ধুদের সামনে ‘না’ বলে দেয় মেয়েটি। মেনে নিতে পারেনি সোহম। স্কুলেরই পাঁচ তলার ছাদ থেকে ঝাঁপ দেয়।

সায়ন্তনী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০১৬ ০২:৩৮

বছর বারো বয়স। দু’জনে একই ক্লাসে পড়ে। মেয়েটিকে খুব ভাল লাগত সোহমের। কিন্তু বলার সাহস করে উঠতে পারছিল না। যদি সটান না বলে দেয়...। সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়। বন্ধুদের সামনে ‘না’ বলে দেয় মেয়েটি। মেনে নিতে পারেনি সোহম। স্কুলেরই পাঁচ তলার ছাদ থেকে ঝাঁপ দেয়।

রাহুলকে খুব ভাল লাগত সদ্য ষোলোয় পা দেওয়া রিয়ার। কিন্তু রিয়ারই প্রিয় বান্ধবী জাহ্নবীর প্রেমিক রাহুল। অতএব, বন্ধুর সঙ্গে রাহুলের সম্পর্কটা ভাঙতে কিছু একটা করতেই হবে, স্থির করে ফেলে রিয়া। বান্ধবীর নামে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ভুয়ো প্রোফাইল খুলে ফেলে। আর তার পর তার নামে একের পর এক আপত্তিকর পোস্ট করত থাকে। অজান্তেই জড়িয়ে পড়ে ‘সাইবার বুলিং’-এর মতো অপরাধে। আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল জাহ্নবী।

যে কোনও উপায়ে হোক, কিছু পেতে অন্যকে আঘাত করা বা স্রেফ আনন্দ পেতেই কাউকে সকলের সামনে ছোট করা বা কিছু না পেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া— মনের জটিল অসুখেরই নামান্তর। ছোটদের অনেকেই এই জটিল ‘রোগে’ আক্রান্ত। বাবা-মায়েরা তাদের সামান্য সর্দি-কাশি-জ্বরের খবর রাখলেও, মনের খবর টেরই পান না। বহু ক্ষেত্রে গুরুত্বও দেন না। সম্প্রতি এমন তথ্যই উঠে এসেছে ‘জার্নাল অব আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’-এর একটি সমীক্ষায়।

জীবনযাত্রার ধরন বদলানোয় এ দেশেও বিষয়টা যে ক্রমশ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে, তা মেনে নিচ্ছেন এখানকার মনোবিদরা। তাঁদের মতে, অধিকাংশ পরিবারেই একটি বা দু’টি সন্তান। সে যা চাইছে, চাকুরিজীবী বাবা-মা তা-ই দিচ্ছেন। চাইলেই পাওয়া যায়, এই ধারণাটা তৈরি হয়ে যাচ্ছে ছোটদের। তাই প্রত্যাখ্যান মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।

শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে অন্য সমস্যা। বাবা-মা যথেষ্ট সময় দিতে না পারায় একাকীত্বে ভুগছে সন্তান। কাউকে একটা আঁকড়ে ধরতে চাইছে। তা সে স্কুলের বন্ধুই হোক বা অন্য কোনও প্রিয়জন। আর সেখানেও ধাক্কা খেলে মেনে নিতে পারছে না। তৈরি হচ্ছে বেপরোয়া মনোভাব। মনোবিদরা বলছেন, এর সঙ্গে রয়েছে প্রতিযোগিতা। ‘বড়’ হওয়ার লড়াই। পাঁচ বছরে হাতেখড়ির প্রথা তো কবেই উঠে গিয়েছে। আড়াই-তিনেই ‘প্লে-স্কুল’। খেলার ছলে পড়াশোনা। জুটছে হোম-ওয়ার্কও। খুদে-হাতে আপেলটা আপেলের মতোই আঁকতে হবে। শুরু প্রকৃতির নিয়ম নিয়ে ছিনিমিনি। একটু বয়স বাড়তেই চাপ— ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-বিজ্ঞানী হতে হবে... বাকিদের ঠেলে এগিয়ে যেতে হবে। নাম কিনতে স্কুলও চাপিয়ে দিচ্ছে বইপত্রের বিশাল বোঝা। লড়াইয়ে ইন্ধন দিচ্ছে মা-বাবারাও। নিজে

যা পারিনি, তা-ই খুঁজে বেড়ানো সন্তানের মধ্যে।

কলকাতারই এক মনোবিদ জানালেন একটি ঘটনার কথা। বন্ধুর থেকে অঙ্কে কম নম্বর পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল একটি বাচ্চা মেয়ে। কাঁদতে কাঁদতে জ্বর এসে যায়। সে কিন্তু নম্বর কম পায়নি। শুধু বন্ধুর তুলনায় কম পেয়েছিল। মনের ডাক্তারদের ব্যাখ্যা, মা-বাবাদের প্রত্যাশাই এর জন্য দায়ী। প্রতিযোগিতা খারাপ নয়, কিন্তু সেটা হওয়া উচিত নিজের সঙ্গে। ‘‘আমি যদি দশ মিনিটে দু’টো অঙ্ক করতে পারি, তা হলে এ বার সেটা পাঁচ মিনিটে কষতে হবে। কিংবা এ বার ৮০ পেয়েছি, সামনের বার ১০০ পেতে হবে। কিন্তু লড়াইটা যখন অন্য কারও সঙ্গে হতে শুরু করে, তখনই বাচ্চারা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। আর তার জন্য অনেকাংশে দায়ী বাবা-মা। কারণ তাঁদেরই বলতে শোনা যায়, ও ৯৯ পেয়েছে। তুই ৯০ পেলি!’’— বলছেন ওই মনোবিদ। বাজার-দোকান-কিটি পার্টিতে অনেকেই বলবেন, ‘আমি ও সব বলি না’। কিন্তু অজান্তেই এমনটা বলে ফেলেন অনেক সময়। ফলে ছড়িয়ে পড়ছে গভীর অসুখ। কারও ক্ষেত্রে প্রভাব মারাত্মক, কারও কম।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্বের অধ্যাপিকা পৃথা মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘যা আমরা বাচ্চাদের দিচ্ছি, তা-ই কিন্তু ফেরত পাচ্ছি!’’ কী ভাবে? বাচ্চা হয়তো তার মাকে জানাল, তার মন খারাপ। সে কম নম্বর পেয়েছে। মা কিন্তু বাচ্চার দুঃখে দুঃখ পেলেন না। উল্টে তাকে বকতে শুরু করলেন। ভয় দেখালেন। হয়তো বা মারধরও করলেন। স্বাভাবিক ভাবেই তার একমাত্র ভরসার জায়গাটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। তৈরি হল দূরত্ব।

মনোবিদ জলি লাহার মতে, বাচ্চাদের মধ্যে এখন সহনশীলতাও কমে যাচ্ছে। মন জুড়ে বাসা বাঁধছে হতাশা। ‘‘এ ক্ষেত্রেও ত্রুটি মা-বাবার। একটা বাচ্চা কখনওই ‘সহনশীলতা’ নিয়ে জন্মায় না। সে বায়না করবে, কান্নাকাটি করবে, এটাই স্বাভাবিক। তার মধ্যে সহিষ্ণুতা তৈরি করতে হবে মা-বাবাকেই,’’ বলছেন তিনি।

কী ভাবে? সমাধানও বাতলে দিলেন তিনিই। ছোট্ট একটা উদাহরণ। বাচ্চা বায়না ধরল। কেউ কেউ মুখ থেকে খসাতে না খসাতে, তা দিয়ে দেন। ‘চাইলেই মিলবে’ এমনটাই ভাবতে শেখে শিশু। অনেকে বকাবকি-মারধর করেন। সেটাও ক্ষতিকর। কেউ কেউ আজ দেব-কাল দেব করে ভোলানোর চেষ্টা করেন। তাতে মা-বাবার প্রতি বাচ্চার বিশ্বাসভঙ্গ হয়। জলি লাহার মতে, শিশু-মন অনেক সময় অনেক জিনিস নিয়ে কল্পনার মায়াজাল বোনে। সেটা নিয়ে তার সঙ্গে তার মতো করে গল্প করলেই সমাধান হয়ে যায়। তাকে তা দিতেও হয় না।

একই বক্তব্য শিশু-মনোরোগ বিশেষজ্ঞ উশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়েরও। তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে সর্বত্র এত যে স্বাস্থ্য সচেতনতা... সবটাই তো শারীরিক সমস্যা নিয়ে। মন খারাপ, ডাক্তার দেখাবো, এমন চিন্তাধারা এখনও এ সমাজে নেই।’’

teenagers loneliness sayantoni bhattacharya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy