Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Mental Health

খবর দেখবেন কি দেখবেন না? কী বলেন মনোবিদেরা

সমষ্টির খবর কম শুনে ব্যক্তিকেন্দ্রীক ভাল থাকা কি আদৌ সামাজিক ব্যবস্থার মাঝে সম্ভব? এ শহরের মন-বিশেষজ্ঞেরা নানা মতে বিভক্ত। নানা আঙ্গিকে পথ দেখাচ্ছেন তাঁরা।

অনেকের বক্তব্য, অতিমারির খবরের মধ্যে ডুবে থাকলে উদ্বেগ বাড়ছে। আবার অন্যরা বলছেন, সমষ্টির খোঁজ না রেখে ভাল থাকা যায় না।

অনেকের বক্তব্য, অতিমারির খবরের মধ্যে ডুবে থাকলে উদ্বেগ বাড়ছে। আবার অন্যরা বলছেন, সমষ্টির খোঁজ না রেখে ভাল থাকা যায় না। ফাইল চিত্র

সুচন্দ্রা ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০২১ ১৯:৪০
Share: Save:

কেউ বলছেন ভাল থাকতে হলে খারাপ খবরে কান দিতে হবে না। কেউ বলছেন ভাবনার গতি না আটকানোই ভাল। কারণ অস্থির সময়ে তাতে চাপ পড়ে মনের উপরে। কিন্তু খবর জানা বা শোনা কি আদৌ এই সময়ে মানুষের হাতের মধ্যে রয়েছে? তা না শোনার চেষ্টা কি আরও বেশি চাপ ফেলবে মনের উপরে? যদি খবর উড়ে আসে, তখন কি তার সঙ্গে সতর্কতার বার্তা জোড়া থাকতে হবে? না হলে যে সব ধরনের খবর থেকেই মুখ ফিরিয়ে নিতে হবে। সমষ্টির খবর কম শুনে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভাল থাকা কি আদৌ সামাজিক ব্যবস্থার মাঝে সম্ভব? এ শহরের মন-বিশেষজ্ঞেরা নানা মতে বিভক্ত। নানা আঙ্গিকে পথ দেখাচ্ছেন মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকা সেই ভাল-মন্দের দ্বন্দ্ব সমাধানে। কেমন সে পথ?

অনেকেই বলছেন অতিমারির খবর দেখলে, শুনলে তাঁরা বেশি অসুস্থ বোধ করছেন। তা নিয়ে যে বিতর্কের জায়গা তৈরি হচ্ছে, খেয়াল করেছেন মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফলে চিন্তা ভাবনা হচ্ছে খবরের মধ্যে থাকা কতটা ভাল, তা নিয়ে। মাঝে মাঝে কি কম জানলে স্বস্তি মেলে? তিনি মনে করেন, ‘‘এ ক্ষেত্রে খবরের সঙ্গে তো ট্রিগার অ্যালার্ট দেওয়ার পরিসর থাকে না। সে ক্ষেত্রে আমার যদি বিচলিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে, নিজেকেই সতর্ক হতে হবে। সাবধানতা নিতে হবে। কে কোন খবর দেখে কেমন বোধ করবেন, তা তাঁর ব্যক্তি ইতিহাস, সামাজিক পরিসর ও মানসিক গঠনের উপরে নির্ভর করে। যদি বিশেষ কোনও খবর দেখে ব্যক্তিগত শোক নতুন করে ফিরে আসে বা উদ্বেগ বাড়ে, তবে তা থেকে সাময়িক ভাবে নিজেকে সরিয়ে নেব। কিন্তু তার মানে এ কথা বলা যায় না যে, সে সব খবর প্রচার বন্ধ হয়ে যাওয়া উচিত। কারণ, তা হলে তো জানা যাবে না আদৌ চারপাশে কী ঘটছে। নিজের সুরক্ষার জন্য বাড়তি কী কী করণীয়, সে সব সমাধানসূত্রগুলিও সে ক্ষেত্রে চোখে পড়বে না। সমষ্টির জন্য নিজেকে অর্থপূর্ণ করে তোলার বা কাজ করার দিকটি উন্মোচিত হবে না যদি খবর শোনা থেকে নিজেকে আমরা সম্পূর্ণ বিরত রাখি।’’

সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে গেলে চারপাশ সম্পর্কে সর্বক্ষণ জানতে হবে। তাতে কি অস্থির হয়ে উঠতে পারে মন? নিজের মনকে যত্ন রাখাও আপাতত সামাজিক কর্তব্য বলেই মনে করেন মনোরোগ চিকিৎসক রাজশ্রী রায়। বাড়িতে থেকে এবং মনকে ক’টা দিন গুছিয়ে ঘরমুখী করে রাখলে ক্ষতি কী? ঘরে ধৈর্য ধরে বসে বাইরের সঙ্কট কাটার জন্য অপেক্ষা করার পক্ষে চিকিৎসক। রাজশ্রী বলছেন, ‘‘বহির জগতের সঙ্গে যোগাযোগ থাক না বই, সিনেমার মাধ্যমে। অন্য সময়ে বাড়িতে অনেক কিছু করার সুযোগ হয় না। যেমন বাগানের যত্ন নেওয়া। সে সব এখন করা যাক।’’ তাঁর বক্তব্য, মানসিক স্বাস্থ্যের উপরে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে অতিমারি। অত্যধিক আতঙ্ক ও মানসিক চাপই এর কারণ। নতুন ভাবে সেই চাপ আরও বাড়তে দিয়ে লাভ হবে কি, প্রশ্ন রাজশ্রীর।

খানিকটা এক ভাবে পথ দেখাচ্ছেন আর এক বিশেষজ্ঞও। ঘরে থাকার সময়ে অতিরিক্ত বাইরের কথা ভেবে অস্থির হওয়ার পক্ষে নন মনোরোগ চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায়। তাঁর মতে, মনের উপরে যদি অতিমারির খবর বেশি প্রভাব ফেলে, তবে বেশি ক্ষণ টিভি দেখার প্রয়োজন নেই। পরিবারের সকলে মিলে যখন খেলতে বা গল্প করতে বসা হচ্ছে, সে সময়ে অতিমারিতে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে আলোচনা করলে মনের উপরে চাপ পড়বে। তাতে কেউ ভাল থাকবেন না। সর্বক্ষণ অতিমারি সংক্রান্ত খারাপ খবরের মধ্যে ডুবে থাকলে উদ্বেগের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে বলে মত তাঁর। তিনি বলেন, ‘‘যে খবর শুনে আমার মন ও শরীর অতিরিক্ত খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তার ফলে নিজে ভাল থাকছি না। রোজের কাজে মন দিতে পারছি না। সে খবর শুনব কি না, তা ভাবা দরকার।’’ যে খবর শুনে তার প্রেক্ষিতে কিছু করা নিজের হাতের মধ্যে নেই, তা বারবার শুনে উদ্বেগ বাড়ানোরও কোনও মানে হয় না বলে পরামর্শ তাঁর।

ইতিমধ্যেই আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে মনের উপরে ভাইরাসের প্রভাব নিয়ে। ভাইরাসের তাণ্ডব থেমে গেলেও, নাকি মনোরোগের মহামারি দেখা দেবে। বলা হচ্ছে, যে উদ্বেগ ভাইরাস বয়ে এনেছে, তা রেখেই যাবে। বিভিন্ন দেশে গবেষণাও শুরু হয়ে গিয়েছে। ফলে নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করতে হবে। সম্প্রতি ইন্ডিয়ান সাইকিয়াট্রিক সোসাইটির তরফে খবর আদানপ্রদান নিয়ে সচেতন করা হয়েছে। কারণ মনোবিদদের একাংশের মত, খারাপ খবর চর্চার কুপ্রভাবে চাপ বাড়ছে মনের উপরে। তবে মনোসমাজকর্মী রত্নাবলী রায়ের একটা পাল্টা প্রশ্ন আছে। খারাপ খবর এড়িয়ে চলার চাপ এ সময়ে বেশি অস্থির করে দিচ্ছে না তো মনকে? তাঁর বক্তব্য, ‘‘মনস্তাত্ত্বিক চর্চায় সব দায়িত্ব ব্যক্তিকে নিতে বলা হয়। নিজে ভাল থাকা, অন্যকে ভাল রাখা— সবই দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিন্তু সমষ্টি কী ভাবে ব্যক্তিকে ভাল রাখে, এ নিয়ে বেশি চর্চা হয় না। অথচ মানসিক স্বাস্থ্যরক্ষার ক্ষেত্রে সমষ্টির জন্য করা এবং ভাবা খুব জরুরি।’’ কিন্তু যদি সমষ্টির খবরই না রাখা হয়, তবে কি তা আদৌ সম্ভব? রত্নাবলীর বক্তব্য, সমাজের একটা প্রত্যক্ষ সংযোগ রয়েছে খারাপ থাকা ও মানসিক অসুখের সঙ্গে। ফলে সমাজের বাকি খবরের থেকে ব্যক্তিকে দূরে রাখতে চাইলে, তাঁকে একটা বুদ্বুদের মধ্যে আটকে ফেলতে হবে। আর সেই বুদ্বুদ যখন ফেটে যাবে, তখন তাঁর উপরে আকাশ ভেঙে পড়বে। তিনি বলেন, ‘‘আমরা তো কেউ একাকী থাকি না। যার মধ্যে রয়েছি, সে সম্পর্কে সচেতন না হয়ে লাভ কী?’’

ব্যক্তির উপরে বিশেষ কোনও খবর এড়িয়ে চলার চাপ উল্টো প্রভাব ফেলতে পারে কি? রত্নাবলীর বক্তব্য, ‘‘কোনও ধরনের সেনসরশিপেই আসলে লাভ হয় না।’’ যখন খবরে কান না দেওয়ার মতো পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, তখন সেই ব্যক্তির ভাবনাচিন্তা বেঁধে দেওয়া হচ্ছে না তো? তাঁর বিবেচনাবোধ নিয়েও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে না কি?

তবে কি এমন বলা যায় যে, শুধু অসুস্থতা নয়, মানসিক ভাবে সুস্থ থাকার উপায়ের ধারাও নির্ধারণ করছে অতিমারি? বলা যায় কি অন্দরে মুখ রেখে বাহিরকে না দেখা আর বাহিরকে সামলানোর চেষ্টার মাধ্যমে অন্দরকে শান্ত রাখার দ্বন্দ্বেই আদতে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে অধিকাংশের মন? ব্যক্তি বনাম সমষ্টির বিভাজনের মুখে এ ভাবেই সমাজকে তবে দাঁড় করাল অদৃশ্য এক ভাইরাস!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE