Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

শারীরিক ‘খুঁত’ নিয়ে ব্যঙ্গ: অবসাদে স্কুলে যাওয়া, খাওয়াদাওয়া বন্ধ

মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার করকাঁটাপাড়া থেকে গত ৩০ ডিসেম্বর সকালে শিয়ালদহের আর আহমেদ ডেন্টাল হাসপাতালের আউটডোরে পৌঁছেছিল আসমত আরা আর তার মা শুভানুর বিবি। চিকিৎসকদের সামনে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন শুভানুর—‘‘যে করে হোক আমার মেয়েটার দাঁত ঠিক করে দাও ডাক্তারবাবু। আমরা দিনমজুরি করি। মেয়েটার আমার পড়ালেখায় মাথা ভাল। সেই মেয়ে আর ইস্কুল যেতে পারছে না গো।’’

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৬ ১৯:৩৩
Share: Save:

মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার করকাঁটাপাড়া থেকে গত ৩০ ডিসেম্বর সকালে শিয়ালদহের আর আহমেদ ডেন্টাল হাসপাতালের আউটডোরে পৌঁছেছিল আসমত আরা আর তার মা শুভানুর বিবি। চিকিৎসকদের সামনে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন শুভানুর—‘‘যে করে হোক আমার মেয়েটার দাঁত ঠিক করে দাও ডাক্তারবাবু। আমরা দিনমজুরি করি। মেয়েটার আমার পড়ালেখায় মাথা ভাল। সেই মেয়ে আর ইস্কুল যেতে পারছে না গো।’’

উপরের পাটির দাঁত উঁচু হয়ে ঠোঁটের বাইরে বেরিয়ে এসেছে আসমতের। কিন্তু এ রকম তো কতই হয়। সেটা এমন কী সমস্যা যার জন্য স্কুলে যাওয়া যাবে না?

কুলিন্দা গার্লস স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী জানায়, স্কুলে সহপাঠীরা তার দাঁত নিয়ে সবসময় ব্যঙ্গ করে। ‘‘ওরা ক্লাসে ঢোকার পর থেকে বলতে শুরু করে, ‘তোর দাঁত তো নয় যেন মাটি কাটার মেশিন! স্কুলে নয়, তুই মাঠে গিয়ে দাঁত দিয়ে মাটি তোল।’ বলে, ‘ওই যে রাক্ষসী এসেছে।’ ওরা হাসতে থাকে, খোঁচাতে থাকে। আমার খুব কষ্ট হয়। পালিয়ে আসি।’’ গত তিন মাস ধরে আসমত স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে বলে জানিয়েছিলেন তার মা শুভানুর বিবি।

চেহারা নিয়ে যে কোনও আর্থ সামাজিক ক্ষেত্রেই একটু-আধটু রসিকতা চলে। মোটা, রোগা, বেঁটে, লম্বা, কালো, বোঁচা, চোখ ট্যারা, মাথায় টাক—এ রকম অনেক কিছুর জন্যই মানুষ মজমস্করার লক্ষ্য হতে পারে। এখন বিষয়টা হল, তিনি বিষয়টাকে কী ভাবে নেবেন বা দেখবেন। সবার মনের গঠন একরকম হয় না। চিকিৎসক বিশেষ করে মনোচিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা বলছে, সাধারণত কৈশোর বা যৌবনের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো ছেলেমেয়েদের অনেকেই শারিরীক ত্রুটির ব্যাপারে অত্যন্ত স্পর্শকাতর হয়। কিছু ক্ষেত্রে সেটা মনোরোগের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। আত্মবিশ্বাসহীনতা, হীনমন্যতায় ভুগতে থাকে তারা। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি, বিয়ে-র মতো অনুষ্ঠানে সামাজিক মেলামেশা থেকে শুরু করে লেখাপড়া, খোলাধুলো—অনেককিছু থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে থাকে।

মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যালের ব্যাখ্যা ‘‘এখনও আমাদের চারপাশে ‘সুন্দর মুখের জয়’ প্রবাদ সত্যি। চেহারা সুন্দর যাদের তাদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা এত বেশি থাকে যে যারা অতটা সুন্দর নয় তাদের অনেকেই হতাশায় ভুগতে শুরু করে।’’ তিনি উদাহরণ দিচ্ছিলেন, কী ভাবে এক অতি সুন্দরী মায়ের সঙ্গে তার মেয়ের তুলনা টেনে পরিচিতরা বার বার প্রকাশ্যে আক্ষেপ করতেন, ‘‘মেয়েটা অত সুন্দর হল না!’’ একটা সময় মেয়ে সামাজিক অনুষ্ঠানে যাওয়া বন্ধ করেছিল। মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক অসম্ভব খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

‘ইনস্টিটিউট অফ সায়কিয়াট্রি’-র মনোবিদ প্রশান্ত রায় জানাচ্ছেন, ‘‘নবম শ্রেণির এক ছাত্রী আমার কাছে এসেছিল। মেয়েটি সুন্দরী। কিন্তু তার ওজন কিছুটা বেড়ে গিয়েছিল। তার ধারণা হয়, এ বার আর কেউ তাকে সুন্দর বলবে না। তার থেকে সে ‘অ্যানারক্সিয়া নার্ভোসা’-র ভুগতে শুরু করে। যা খেত তাই বমি করে বার করে দিত। মনোবিদ মোহিত রণদীপের মতে, ‘বডি ডিসমরফোবিয়া’ বা ‘বডি ডিসমরফিক ডিসর্ডার’ হল জটিল মনোরোগ। এই রোগে রোগী ভাবতে শুরু করে তার কোনও অঙ্গ ঠিকঠাক নয়, কেউ তাকে পছন্দ করে না। এবং এর থেকে তার মারাত্মক অবসাদ ও ট্রমা হয়।’’

এইরকম পরিস্থিতিতে পড়া থেকে কিশোর-কিশোরীদের বাঁচাতে তাদের অন্য কোনও ভাল কাজ বা গুণের জন্য প্রশংসা করাটা খুব জরুরি বলে মনে করেন মনোবিদ ও মনোচিকিৎসকেরা। ছোটবেলা থেকে তাদের বোঝানো উচিত, চেহারাটা একটা মানুষের সব নয়, চেহারা মানুষের নিজের হাতে নয়। সে নিজেকে কী ভাবে যোগ্য করে তুলছে সেটা জরুরি।

পাঠভবনের প্রধানশিক্ষিকা সান্ত্বনা রায় জানালেন, চেহারা নিয়ে কাউকে ক্লাসে ব্যঙ্গের মুখে পড়তে হচ্ছে কিনা সবসময় খেয়াল রাখা হয়। সে রকম কিছু দেখলে বকাবকি না করে গোটা ক্লাসকে একসঙ্গে বসিয়ে খোলাখুলি বিষয়টা নিয়ে আলোচনা হয়। তাতে তারা ভাল ফল পান। ক্যালকাটা গার্লস স্কুলের প্রধানশিক্ষিকা বাসন্তী বিশ্বাস যেমন বলেন, ‘‘আমাদের চ্যাপেলে ছাত্রীদের মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়া হয়। কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল তা বোঝানো হয়। ভুলভাল ভাবে ডায়েট করে রোগী হওয়ার চেষ্টা বা চেহারা নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগা কতটা অযৌক্তিক সেটাও আমরা বলি।’’ গ্রুপ কাউন্সেলিং এবং একান্ত কাউন্সেলিংয়ে চেহারা নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের অবসাদের মতো বিষয়গুলি গুরুত্ব দিয়ে দেখার কথা জানান হেরিটেজ স্কুলের প্রিন্সিপাল সীমা সাপ্রু-ও।

উঁচু দাঁত নিয়েও রোনাল্ডিনহো-র দাপট, বেঁটে হয়েও সচিন তেন্ডুলকরের যাদু, কালো হয়েও কাজল-বিপাশাদের সাফল্যের মতো অসংখ্য উদাহরণ ছোটদের মনে গেঁথে দিতে পারলে হাতেনাতে ফল মিলবে বলে মনে করছেন শিক্ষক ও মনোবিদেরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

ugly kids School bullying lifestyle
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE