নীরা দিয়ে তৈরি মিষ্টি। ছবি: প্রকাশ পাল।
অবশেষে ‘নীরা’ ফিরে এল আমজনতার মাঝে! নয়া রূপে তার আত্মপ্রকাশ ঘটল হুগলির মফস্সল শহর রিষড়ায়। তবে, এ ‘নীরা’ সুনীলের নয়। নারকেলের। ‘নীরা’ এসেছে তিলক-বরফিতে, সঞ্জীবনীতে, কল্পতরুতে, কল্পরসায়। মিষ্টির হৃদয়ে তার বাস। অথচ, তাকে নিজেদের বাসস্থানেই নিয়ে যাচ্ছেন ডায়াবেটিস রোগীরা। সম্প্রতি উত্তর-পূর্ব ভারতে প্রথম নারকেলের ফুল থেকে রস উৎপাদন শুরু হয়েছে বলাগড়ে। এই রসেরই সরকারি নাম ‘নীরা’ বা ‘কল্পরস’। আর সেই রস থেকেই মিষ্টি বানিয়ে ডায়াবেটিস রোগীদের দোকানে টেনে নিয়ে এসেছে রিষড়ার নামী মিষ্টিপ্রস্তুতকারক— ফেলু মোদক।
দিন দশেক আগে প্রথম ওই রস থেকে মিষ্টি তৈরিতে উদ্যোগী হন ফেলু মোদকের অন্যতম কর্ণধার অমিতাভ দে। ‘‘দিন কয়েক গড়াতেই নীরার মিষ্টি কিনতে ডায়াবেটিস রোগীদের এমন ভিড় শুরু হয় যে তার জন্য আলাদা কাউন্টার করা হয়েছে’’— দাবি অমিতাভবাবুর।
‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব এগ্রিকালচারাল রিসার্চ’ (আইসিএআর)-এর অন্তর্গত কেরলের ‘সেন্ট্রাল প্ল্যান্টেশন ক্রপস্ রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ (সিপিসিআরআই)-এর বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরেই নারকেলের উপর গবেষণা চালিয়ে আসছেন। তাঁদের লক্ষ্য, নানা উপায়ে নারকেল গাছকে কাজে লাগানো। সিপিসিআরআইয়ের ডিরেক্টর পি চৌডাপ্পা এবং দুই বিজ্ঞানী কে বি হেব্বার এবং এইচ পি মহেশ্বরাপ্পার তত্ত্বাবধানে বলাগড়ে এক কৃষিজীবী পরিবারের বাগানে নারকেলের ফুল থেকে রস বার করার কাজ (পাইলট প্রজেক্ট) শুরু হয় সম্প্রতি। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দীপককুমার ঘোষ (হুগলির প্রাক্তন জেলা উদ্যান আধিকারিক) এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষকও রয়েছেন প্রকল্পে।
রিষড়ায় এসে ‘নীরা’র তৈরি মিষ্টির উদ্বোধনও করে গিয়েছেন আইসিএআরের ডিরেক্টর পি চৌডাপ্পা। তাঁর দাবি, ‘‘নারকেল ফুলের রসে ইনিউলিন নামে একটি ফাইবার থাকে, যা শর্করাকে রক্তে মিশতে বাধা দেয়। তাই এটি ডায়াবেটিস রোগীদের পক্ষে ভাল। দক্ষিণ ভারতে এই রসের বা চিনি থেকে তৈরি মিষ্টি ওই রোগীদের মধ্যে জনপ্রিয় এবং চিকিৎসকদের দ্বারা পরীক্ষিত।’’ কলকাতার বিশিষ্ট এন্ডোক্রিনোলজিস্ট সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ও বলেন, ‘‘কৃষি বিজ্ঞানীরা যে ইনিউলিন ফাইবারের কথা বলছেন, তা কিন্তু সুগারের রোগীদের পক্ষে ভাল। চিনি যেমন সরাসরি রক্তে মেশে, এই ফাইবার থাকলে তা হয় না।’’
কেরলে ‘নীরা’ থেকে চিনি তৈরির খবর ছিলই ফেলু মোদকের অমিতাভবাবুর কাছে। তাই বলাগড়ের বাকুলিয়ায় কয়েক মাস আগে সরকারি উদ্যোগে নারকেল চাষি দেবাশিস ঘোষের খামারে যখন ওই রস উৎপাদন শুরু হয়, তখন সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন অমিতাভবাবু। সেই সময় তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁরা ‘নীরা’কে ‘হেল্থ ড্রিঙ্ক’ হিসেবে বাজারে আনতে চান। কিন্তু তার আগেই ‘নীরা’ এল মিষ্টি-চেহারায়।
এই নীরা বা কল্পরসকে নিয়ে কৃষি বিজ্ঞানীদের এত আগ্রহ কেন?
কৃষি-বিজ্ঞানীরা জানান, মিষ্টি স্বাদযুক্ত এবং হালকা ক্রিম রঙের এই রস স্বাস্থ্যকর ও সুস্বাদু। এর মধ্যে নানা খনিজ পদার্থ, যেমন আয়রন ( ০.০৫৩ মিলিগ্রাম), জিঙ্ক (০.০২ মিলিগ্রাম), সোডিয়াম (৯০.৬), পটাসিয়াম (১৬৮.৪ মিলিগ্রাম) রয়েছে। রয়েছে ভিটামিন, পলিফেনল, কিছু ফ্যাটি অ্যাসিড, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং ভিটামিন। এর গুণগত মান আখের এবং ফলের রসের থেকে বেশি। এই পানীয়ে প্রতি ১০০ মিলিলিটারে শর্করা থাকে থাকে ১৫-১৮ গ্রাম। শরীরে চটজলদি শক্তি বৃদ্ধি করতে, শরীর ঠান্ডা রাখতে এবং হজমে খুব কাজে লাগে। এই সব কারণেই এই রসকে বাণিজ্যিক ভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা হচ্ছে। হিসাব করে দেখা গিয়েছে, একটি নারকেল গাছ থেকে সারা বছর ১০০ থেকে ১২০টি নারকেল পাওয়া যায়। যার মূল্য ১০০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে। অথচ, একটি নারকেল গাছ থেকে বছরে কম করে ২০০ থেকে ২৫০ লিটার মিষ্টি রস বের করা সম্ভব। যার বাজারদর কম করেও ৬০ টাকা লিটার। গাছ প্রতি ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা লাভ করতে পারেন চাষিরা।
চাষিদের কথা বলতে না পারলেও ফেলু মোদকের অমিতাভবাবু ‘নীরা’র ‘ম্যাজিক’ দেখছেন নিজের চোখেই। শুরুটা করেছিলেন সাত রকম মিষ্টি দিয়ে। এখন আরও দু’রকম বেড়েছে। তার মধ্যে দু’টি নীরা-রসের মিষ্টি। রসগোল্লা এবং মালাই রাবড়ি। অমিতাভবাবুর কথায়, ‘‘সে দিন তো বিয়ের তত্ত্বেও ওই মিষ্টির বরাত পেয়েছিলাম। বেয়াই-বেয়ানের নাকি ডায়াবেটিস। চমকে গিয়েছি।’’
চমকে গিয়েছেন সোমনাথ দাসও। দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিসে ভুগছেন রিষড়ার এই বাসিন্দা। মিষ্টি প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। কিন্তু ‘নীরা’ তাকে ফের মিষ্টি-মুখ করিয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘ওদের নীরার পেঁড়া, রাবড়িও খাচ্ছি। দারুণ স্বাদ। আমি নিজে কেমিস্ট। ওই মিষ্টি খাওয়ার সাত দিন পরে রক্ত পরীক্ষা করিয়েছি। একদম ঠিক আছে।’’ ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য সুখবর শুধু এটাই নয়। আরও নানা ভাবে নীরাকে উপস্থাপিত করার আশ্বাস দিয়েছে ফেলু মোদক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy