E-Paper

নিজে নিজে পড়ব

সন্তানের দরকারে পাশে থাকতে হবে, তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। কিন্তু নিজের পড়া নিজে তৈরি করার অভ্যেসও গড়ে তুলতে হবে সন্তানের মধ্যে

নবনীতা দত্ত

শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২৪ ০৫:২২

একটি শিশু যখন হাঁটতে শেখে, সে কারও হাত ধরে প্রথম পা ফেলে, এক পা-দু’পা করে এগোতে শেখে। কিন্তু একটা সময়ের পরে তাকে আস্তে আস্তে ছাড়তে হয়, যাতে নিজেই সে হাঁটতে শেখে। হয়তো প্রথমে পড়ে যাবে, কিন্তু আবার উঠে হাঁটতেও শিখবে। পড়ার ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনই। গোড়ার দিকে বর্ণ পরিচয়, বাক্যগঠন শেখাতে পাশে থাকবে অভিভাবক। কিন্তু সন্তান একটু বড় হলে পড়ার জগতেও তাকে একটু একটু করে একা ঠেলে দিতে হবে। সেল্ফ স্টাডি করা অত্যন্ত জরুরি। এতে সন্তান আত্মবিশ্বাসী ও স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে।

কখন থেকে একা পড়বে?

পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ বলছেন, “ক্লাস ওয়ান, টু পর্যন্ত বাচ্চাদের পড়ার সময়ে মা-বাবার সাহচর্য প্রয়োজন। কারণ তখন তারা বিভিন্ন ভাষার অক্ষর চিনতে, বাক্যগঠন করতে শিখছে। তাই সেই সাহায্যটা করতে হবে। কিন্তু ক্লাস থ্রি থেকে সন্তানকে নিজের পড়া নিজে তৈরি করার জন্য উৎসাহ দিতে হবে।” তা হলে একটা সময় পরে সে নিজের পড়ার দায়িত্ব নিতে শিখবে।

নিজে কেন পড়বে?

  • সন্তানের বুদ্ধির বিকাশের জন্য ওদের একা পড়তে দেওয়া খুব জরুরি। নিজে পড়ে নিজে বুঝলে, নিজেই সমস্যার সমাধান করতে পারলে যে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়, তা জীবনের সব ক্ষেত্রে সহায়ক। অন্য দিকে নিজের পড়া নিজে বুঝতে গেলে মনোযোগ দরকার। একটা বিষয় নিজে পড়তে পড়তে এগোলে তার সঙ্গে একটা ভালবাসার সম্পর্কও তৈরি হয়ে যায়। কেউ জোর করে সেই বিষয়টা পড়িয়ে দিলে সেই সম্পর্কটা তৈরি হয় না।
  • পায়েল মনে করালেন, “নতুন এডুকেশন পলিসি অনুযায়ী পড়াশোনা এখন অনেক প্রয়োগমূলক। প্রশ্নের ধরনও বদলাবে পরীক্ষায়। সেখানে বিষয়ভিত্তিক যুক্তিযুক্ত চিন্তাভাবনা জরুরি। নোটস মুখস্থ করে লিখে এলে আর চলবে না। যেটা পড়ুয়ারা পড়ছে, তার উপরে ভিত্তি করে লজিক্যাল রিজ়নিং, প্রয়োগমূলক প্রশ্নের ধারা তৈরি হচ্ছে।” ফলে নিজে পড়লে প্রশ্ন পড়ে বুঝে উত্তর দিতে পারবে সে।
  • যোধপুর পার্ক বয়েজ় স্কুলের প্রধান শিক্ষক অমিত সেন মজুমদার বললেন, “এখন পড়ুয়াদের মধ্যে একা পড়া ও বই পড়ার অভ্যেস চলে গিয়েছে। ভিডিয়ো লেকচার শোনে এখন ছাত্ররা। তার সঙ্গে কোচিংয়ে তৈরি নোটস পেয়ে যাচ্ছে। নোটস যদি শিক্ষকেরা মুখে বলেন, তা হলেও তারা লিখতে চায় না। নোটসের পিডিএফ চলে যাচ্ছে ফোনে। গল্পের বই পড়ার জায়গায় সিনেমা, মজার ভিডিয়ো দেখছে। পড়ার অভ্যেস গড়ে তুলতে হবে। নোটস মুখস্থ করে স্কুলে বা সিমেস্টারের পরীক্ষায় পাশ করে গেলেও পরবর্তী কালে কমপিটিটিভ পরীক্ষায় কিছু করে উঠতে পারবে না। কারণ সেখানে যে লজিক্যাল রিজ়নিং, অ্যানালিটিকাল প্রশ্ন আসে, তার উত্তর দিতে গেলে নিজেকে বই পড়ে বুঝতে হবে।” মস্তিষ্কের মেদ ঝরাতে মাথা খাটাতে হবে বলে মত তাঁর। নোটসের চেয়েও বইকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা বললেন পায়েলও। অনেক স্কুল থেকেই নোটস বা ওয়ার্কশিট দেওয়া হয়। কিন্তু তার সঙ্গে পাঠ্যবইও কিনে পড়তে হবে। “বই পড়ে জানার আগ্রহ তৈরি করা জরুরি। দুটো বইয়ে দুটো বেশি তথ্য সে পেয়ে যেতে পারে। একটু ভেবে দেখলে মনে পড়বে, আমরাও কিন্তু ছোটবেলায় যে বই পড়েছি, সেগুলো স্মৃতিতে রয়ে গিয়েছে। নোটস অনেক পড়েছি, কিন্তু সেগুলো স্মৃতিতে আবছা। তাই বইয়ের গুরুত্ব বুঝতে হবে।”
  • প্রায় একই মত ব্রাহ্মগার্লস স্কুলের টিচার-ইন চার্জ রুবি চক্রবর্তীর। তিনি বললেন, “সবার আগে পড়ুয়াদের স্কুলমুখী ও বইমুখী হতে হবে। এমন অনেক পড়ুয়াদের পাই, যাদের অভিভাবকেরা সারা দিন বাড়িতে থাকেন না। সেই সময়ে মেয়েটি হয়তো ফোন দেখেই কাটিয়ে দিল। পড়ার অভ্যেস গড়ে তোলার জন্য ভাল বই, গল্পের বই পড়তে হবে। আমরা আগে স্কুলে একটা চ্যাপ্টার হয়তো তিনটে বই কনসাল্ট করে পড়তাম। লাইব্রেরি থেকে বই তুলে নোটস তৈরি করতাম।” নিজে নিজে নোটস তৈরি করায় মস্তিষ্ক যেমন কার্যকর হয়, আত্মবিশ্বাসও বাড়ে। নিজে নোটস তৈরি করলে লেখার গতিও বাড়বে। ফলে সব দিক দিয়েই সুবিধে।
  • তবে এ বিষয়ে অন্য মত পাঠভবন স্কুলের টিচার ইন চার্জ ভারতী চট্টোপাধ্যায়ের। তিনি বললেন, “এখন যুগ বদলেছে। পড়ার ধরনও বদলেছে। প্রযুক্তিনির্ভর হয়েছে পড়ুয়ারা। কিন্তু তা সবসময়ে খারাপ নয়। আমি তো স্টুডেন্টদের দেখছি, ইউটিউব দেখে বা নেট থেকে নিজেরাই কোনও চ্যাপ্টার সম্পর্কে আরও বিশদে জেনে আসছে। এখন অধিকাংশ বাবা-মা ওয়ার্কিং, বাড়িতে সন্তানকে ধরে পড়াতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে তো সেই বাচ্চারা একাই পড়া তৈরি করছে। হয়তো গৃহশিক্ষকের গাইডেন্স রয়েছে।” তবে দিনের শেষে নিজের পড়াটা নিজে করার তাগিদটা সব পড়ুয়ার মধ্যে থাকা দরকার। পরীক্ষা থাকুক বা না থাকুক, ছুটি থাকলে, গৃহশিক্ষক না এলেও সকাল-সন্ধে পড়তে বসার অভ্যেসটা বজায় রাখতে হবে।
  • একা একা পড়াশোনার অভ্যেস তৈরি হলে স্কুলে শিক্ষক কী বলছেন, পড়ুয়ারা স্বাভাবিক ভাবে তাতেও মনোযোগ দেবে।
  • আর একটি দিকও চিন্তার বলে মনে করছেন রুবি, “অনেক সময়েই দেখি কোচিং ক্লাস করার জন্য অনেকে স্কুল কামাই করে। উপস্থিতি খুব কম। কিন্তু নিয়মিত স্কুল যেতেই হবে। স্কুলের পড়াশোনা একজন পড়ুয়া যদি ফলো করে আর নিজে পড়ে তা হলে রেজ়াল্ট খারাপ হওয়ার কথা নয়।” কিছু বুঝতে না পারলে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকার কাছে সাহায্য চাওয়া যায়।

কিছু উপায় কার্যকর

  • অনেক সময়ে দেখা যায়, অভিভাবকরা বই পড়ছেন আর সন্তান শুনছে। এতে কিন্তু মনোযোগ তৈরি হবে না। বরং ও নিজে যদি নিজের বই পড়ে, পড়া তৈরি করে, সে ক্ষেত্রে মনোযোগ বেশি থাকে। জোরে জোরে পড়তে হবে, যাতে নিজের পড়া নিজের কানে ঢোকে। ‘কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল’, কানের সঙ্গে মস্তিষ্কের যোগাযোগ তো বিজ্ঞানসম্মত। তাই পড়া ও শোনা দুটোই জরুরি। বরং পরীক্ষা নেওয়ার কাজটা অভিভাবকরা করতে পারেন। সপ্তাহের দুটো দিন, দুটো বিষয়ের চ্যাপ্টার ধরে পরীক্ষা নিলেন। সে নিজে কতটা বুঝেছে, কোথায় আটকাচ্ছে, সেটা তা হলে ধরতে পারবেন।
  • অন্য দিকে পুরো পড়ার নির্যাস সে নিতে পারছে কিনা তা বোঝার জন্য পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন খুব উপকারী বলে মনে করছেন পায়েল। ধরুন সন্তানকে তারামণ্ডল নিয়ে একটা পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজ়েন্টেশন তৈরি করতে বললেন। সে তখন প্রেজেন্টেশনের জন্য ছবি সংগ্রহ করবে। একাধিক জায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করবে। এবং সেই প্রেজ়েন্টেশন করার সময়ে তাকে যে বোঝাতে হচ্ছে, এতে কিন্তু সে পুরো বিষয়টা পড়ে, তথ্য সংগ্রহ করে তা থেকে নির্যাসটুকু বার করে নিতে শিখে যাচ্ছে।
  • আবার অমিত সেন মজুমদার বললেন, প্রকৃতির কাছে বাচ্চাদের নিয়ে গেলেও ওদের অনুধাবন শক্তি বাড়ে। নিজে নিজে গাছ চিনতে, বাগান করতে শিখলে একটা দায়িত্বও তৈরি হয়। “আমাদের স্কুলে বায়োডায়ভার্সিটি গার্ডেন আছে। সেখানে ছাত্রদের নিয়ে যাই। ওদের নামে ওরা গাছ রোপণ করতে পারে। সেই গাছ বড় করা ওদের দায়িত্ব। এতে ওদের পর্যবেক্ষণ শক্তি তৈরি হয়। একটা প্রাণের দায়িত্ব নিতে শেখে।” নিজেরাই খুঁজে বার করে কোন সারে সেই গাছের উপকার, কোনটা খারাপ। এ ভাবে চিন্তাশক্তিও বাড়বে।

সামনেই নতুন পাঠক্রম শুরু হবে। নতুন বছরে নিজের উপরে ভরসা রাখুক পড়ুয়ারা। রেজ়াল্টে তার প্রতিফলন দেখতে পাবে অবশ্যই।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Lifestyle

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy