Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
নিজের কোয়ার্টারে প্র্যাকটিসে ব্যস্ত ডাক্তারবাবু

আউটডোরে বসেই রোগীরা

গেটের মুখে ঢালাই রাস্তায় মেলা ধানের উপর দিয়ে হুস করে সাদা রঙের গাড়িটা গিয়ে থামল ডাক্তারবাবুর কোয়ার্টারের ঠিক সামনে। বাচ্চা কোলে গাড়ি থেকে নামলেন মধ্য তিরিশের এক গৃহবধূ। তারপর বাচ্চাটিকে চালকের কাছে রেখে তিনি সটান ঢুকে গেলেন ডাক্তারবাবুর কোয়ার্টারে। তার চলার সাবলীলতাই বলে দিচ্ছিল ওই কোয়ার্টারে আসা তার এই প্রথম নয়।

নিজের কোয়ার্টারে বসে ডাক্তারবাবু। তখন ওই চত্বরেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বহির্বিভাগে তাঁর অপেক্ষাতেই বসে রয়েছে রোগীরা (ডানদিকে)। ময়ূরেশ্বরের হটিনগর ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সোমনাথ মুস্তাফির তোলা ছবি।

নিজের কোয়ার্টারে বসে ডাক্তারবাবু। তখন ওই চত্বরেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বহির্বিভাগে তাঁর অপেক্ষাতেই বসে রয়েছে রোগীরা (ডানদিকে)। ময়ূরেশ্বরের হটিনগর ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সোমনাথ মুস্তাফির তোলা ছবি।

অর্ঘ্য ঘোষ
ময়ূরেশ্বর শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০১৫ ০১:৩৩
Share: Save:

গেটের মুখে ঢালাই রাস্তায় মেলা ধানের উপর দিয়ে হুস করে সাদা রঙের গাড়িটা গিয়ে থামল ডাক্তারবাবুর কোয়ার্টারের ঠিক সামনে। বাচ্চা কোলে গাড়ি থেকে নামলেন মধ্য তিরিশের এক গৃহবধূ। তারপর বাচ্চাটিকে চালকের কাছে রেখে তিনি সটান ঢুকে গেলেন ডাক্তারবাবুর কোয়ার্টারে। তার চলার সাবলীলতাই বলে দিচ্ছিল ওই কোয়ার্টারে আসা তার এই প্রথম নয়।
চালকের কাছেই খোঁজ নিয়ে জানা গেল, তাঁদের বাড়ি ময়ূরেশ্বর ১ নং ব্লকের পারচন্দ্রহাট গ্রামে। ৮০ টাকা ভিজিট দিয়ে নিয়মিত চিকিৎসা করাতে আসেন তাঁর মালকিন ওই গৃহবধূ। আমার এবং সহকর্মীর মোবাইল তখন সময় জানাচ্ছে ১০টা বেজে ১০ মিনিট উত্তীর্ণ হতে চলেছে।
সোমবার এমন দৃশ্য দেখা গেল হটিনগর ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। আউটডোরের সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে জনা তিরিশেক রোগী। টানা কয়েকদিনের নিম্নচাপ জনিত বৃষ্টির পর সোমবারের ভ্যাপসা গরম এবং রোদে রীতিমতো ভাজা ভাজা হচ্ছিলেন ওইসব রোগীরা। আর তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ডাক্তারবাবুর প্রতীক্ষায় রোগ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেনও। হাঁটুর ব্যাথ্যা নিয়ে বরুটিয়া থেকে এসেছিলেন বাসন্তী কোনাই। পেটের ব্যাথ্যার চিকিৎসা করাতে এসেছিলেন বিদ্যাধরীর সুখী কোনাই। তিনি জানান, ‘‘ব্যাথ্যার চোটে কাল সারা রাত ঘুমোতে পারিনি। ভেবেছিলাম সকাল সকাল ডাক্তারবাবুকে দেখিয়ে ওষুধ নিয়ে বাড়ি ফিরে যাব। রোদে গরমে ঘণ্টা খানেক ধরে কষ্ট পাচ্ছি তবু ডাক্তারবাবুর দেখা নেই।’’
দিন কয়েক ধরে নিয়মিত চিকিৎসা করাতে আসছেন, মহুটারের শিশু হাজরা, নারায়ণঘাটির বংশী মাড্ডিরা। তারা জানান, এখানে এটাই দস্তুর। কোয়ার্টারের রোগী দেখা হলে তবেই ডাক্তারবাবু আউটডোরে পা রাখেন।

সম্ভবত সংবাদমাধ্যমের উপস্থিতি টের পেয়ে আউটডোরে এলেন চিকিৎসক সৌম্যশঙ্খ দাস। সেও ১০ টা বেজে ১৫-তে। আউটডোরে সেই সময় হাজির রয়েছেন একমাত্র চতুর্থ শ্রেণির কর্মী বুলুরানি দাস। তখনও দেখা নেই ফার্মাশিষ্ট প্রদীপ মাইতি, নার্স ববিতা বাঙাল, সবিতা মিশ্র, শর্মিলা সোরেনদের। তাই চিকিৎসা শুরু হতে পেরিয়ে গেল আরও কিছুটা সময়। ডাক্তারবাবু ঢোকার কিছুক্ষণ পর এক হাতে জলের বোতল অন্য হাতে খবরের কাগজ নিয়ে এলেন ববিতা বাঙাল। তিনি অবশ্য জানালেন, ‘‘ইতিপূর্বেই একবার আউটডোরে এসে বিশেষ প্রয়োজনে কোয়ার্টারে গিয়েছিলেন ডাক্তারবাবু।’’

ততক্ষণে অপেক্ষা ঘেমে নেয়ে ওঠেছেন রোগী এবং তাঁদের পরিজনেরা। কারণ, আউটডোরের পাখার ব্যবস্থা থাকলেও ওই বারন্দায় তা নেই। বার বার কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেও পাখার ব্যবস্থা হয়নি বলে উপস্থিত মানুষের অভিযোগ। অথচ, এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ার সময় স্থানীয় জনমানসে আশা জাগিয়েছিল। ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি তাঁদের এলাকায় গড়ার জন্য জমি জোগাড় করে আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন ময়ূরেশ্বর গ্রাম এবং সন্নিহিত এলাকার বাসিন্দারা। কিন্তু তৎকালীন বাম নেতাদের ইচ্ছানুসারে কোটাসুরের হটিনগরে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে ওঠে। এমনকী ষাটপলশা ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে প্রাথমিকস্তরে নামিয়ে হটিনগরকে ব্লক স্তরে উন্নীত করারও চেষ্টা শুরু হয় বলে অভিযোগ। সেই মতো ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিকাঠামোও গড়া হয় হটিনগরে। কিন্তু আদালতের নির্দেশে হাত গুটিয়ে নিতে হয় প্রশাসনকে।

দেখভালের অভাবে ওইসব পরিকাঠামো এখন ভেঙে পড়তে বসেছে। সার সার কোয়ার্টারের বেশিরভাগই ইঁদুরের বাসা হয়ে উঠেছে। স্থানে স্থানে ভেঙে পড়েছে প্রাচীরও। আর সেই সুযোগে গবাদি পশু আর শুয়োর-কুকুরের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র হয়ে ওঠেছে স্বাস্থ্যকেন্দ্র। গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে শূন্য রয়েছে একটি চতুর্থ শ্রেণির পদও। চিকিৎসক সৌম্য শঙ্খবাবু অবশ্য জানিয়েছেন, ‘‘বিশেষ কারণের জন্য আউটডোরে পৌঁছোতে কিছুটা দেরি হয়ে যায়। বিকেল এবং সন্ধ্যার দিকে স্থানীয় বাসিন্দাদের অনুরোধে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করলেও আউটডোরের সময় কিছুতেই নয়। এ দিন অন্য দুই নার্স ছুটি নিয়েছিলেন। ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ডিউটি ছিল ফার্মাশিষ্টের। পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য ইতিমধ্যেই ব্লক রোগী কল্যাণ সমিতির দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।’’

ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক এনামুল হক বলেন, ‘‘সাধারণত সকাল ৯ টা থেকে ২ টো পর্যন্ত প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি খোলা থাকা নিয়ম। রোগী থাকলে অবশ্য বন্ধ হওয়ার সময়সীমা নির্দিষ্ট থাকে না। আউটডোরের সময়ে তো দূরের কথা, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কোয়ার্টারেও প্রাইভেট প্র্যাকটিস করা যায় না। সুনির্দ্দিষ্ট অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেব। আর শূন্যপদ পূরণের জন্য চেষ্টা চলছে।’’

ব্লক রোগী কল্যাণ সমিতির সম্পাদক তথা বিডিও সৈয়দ মাসুদুর রহমান বলেন, ‘‘শুধু হটিনগরই নয়, ব্লকের প্রতিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ধাপে ধাপে পরিকাঠামো উন্নয়নের প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয়তার নিরিখে কাজের তালিকাও নেওয়া হয়েছে। শীঘ্রই সেই অনুযায়ী কাজ শুরু হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE