Advertisement
০৭ ডিসেম্বর ২০২৪
ডাক্তার চেয়ে জুটল লাঠি, অভিযুক্ত তৃণমূল

খাদ্যে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত ৯০

চিকিৎসা চেয়ে জুটল লাঠির ঘা! অনন্ত এমনটাই অভিযোগ উঠেছে লাভপুরের ঠিবা গ্রামে। শুক্রবার রাতে গ্রামের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ঘটনায় অভিযোগ উঠেছে এলাকারই কিছু তৃণমূল কর্মী-সমর্থকের বিরুদ্ধে। তবে, এখনও পর্যন্ত কোথাও কোনও লিখিত অভিযোগ হয়নি। মারধরের ঘটনা অস্বীকার করেছে তৃণমূল নেতৃত্বও।

বাঁশ দিয়ে ঝুলিয়ে সেলাইন দেওয়া হয়েছিল আক্রান্তদের।—নিজস্ব চিত্র।

বাঁশ দিয়ে ঝুলিয়ে সেলাইন দেওয়া হয়েছিল আক্রান্তদের।—নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
লাভপুর শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৫ ০২:৪২
Share: Save:

চিকিৎসা চেয়ে জুটল লাঠির ঘা!

অনন্ত এমনটাই অভিযোগ উঠেছে লাভপুরের ঠিবা গ্রামে। শুক্রবার রাতে গ্রামের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ঘটনায় অভিযোগ উঠেছে এলাকারই কিছু তৃণমূল কর্মী-সমর্থকের বিরুদ্ধে। তবে, এখনও পর্যন্ত কোথাও কোনও লিখিত অভিযোগ হয়নি। মারধরের ঘটনা অস্বীকার করেছে তৃণমূল নেতৃত্বও।

জেলা স্বাস্থ্য দফতর ও স্থানীয় সূত্রের খবর, শুক্রবার দুপুরে ওই গ্রামে একটি অন্নপ্রাশনের ভোজ খেয়ে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৯০ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। অথচ এলাকার একমাত্র স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোনও চিকিৎসক ছিলেন না বলে অভিযোগ। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক তত ক্ষণে আউটডোর সেরে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। বিকেল থেকে আক্রান্তের সংখ্যা শতাধিক ছাড়িয়ে যায়। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে গোটা গ্রামে। রোগীদের নিয়ে ছোটাছুটি পড়ে যায় পরিবারের লোকেদের। যাদের সামর্থ্য আছে, তাঁরা নিজেদের উদ্যোগে আক্রান্তদের কয়েক জনকে লাভপুর এবং বোলপুর মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু, আক্রান্তের সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকায় রাতের দিকে স্বাস্থ্যকর্তাদের সঙ্গে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছন সংশ্লিষ্ট লাভপুর পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি শোভন চৌধুরী এবং জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ নুরুল হোদা। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চত্বরেই আক্রান্তদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। সেই সময় তাঁদের ঘিরে ধরে স্থায়ী চিকিৎসকের দাবিতে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন বাসিন্দাদের একাংশ। নেতাদের উদ্দেশে সরকারের নানা ব্যর্থতার উল্লেখ করে টিকাটিপ্পনিও দেন কেউ কেউ। বেগতিক পরিস্থিতি দেখে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পুলিশ ডাকা হয়। বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, পুলিশের লাঠি কেড়ে বিক্ষোভকারীদের বেধড়ক মারধর করে শাসকদলের কিছু কর্মী-সমর্থক।

শনিবার গ্রামবাসীরা জানান, গত তিন মাস ধরে প্রশাসনের সকল স্তরে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জন্য এক জন স্থায়ী চিকিৎসক চেয়ে দরবার করেও কোনও লাভ হয়নি। এক সময় ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগী ভর্তি নেওয়া হতো। প্রসব, ডায়েরিয়া, বিষ খাওয়া-সহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা মিলত ২৪ ঘণ্টাই। মাস তিনেক আগে পর্যন্তও টানা ৯ বছর ধরে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রর আবাসনে থেকে পরিষেবা দিয়েছেন চিকিৎসক গৌরী মণ্ডল। কিন্তু, তিনি বদলি হওয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছে অব্যবস্থা। গ্রামবাসীর অভিযোগ, বর্তমানে চিকিৎসক পলাশ রায় সপ্তাহে ৫ দিন সকাল ১০ টা থেকে দুপুর ১২ পর্যন্ত ডিউটি সেরে চলে যান। এ নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে পলাশবাবুর যুক্তি, ‘‘স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বর্তমান পরিকাঠামোয় এর বেশি পরিষেবা দেওয়া সম্ভব নয়।’’ এ দিকে, দফতর সূত্রেই জানা গিয়েছে, ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ২ জন চিকিৎসক, ২ জন নার্স, ১ জন ফার্মাসিস্ট, ২ জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মী এবং এক জন সুইপার। অথচ বাস্তবে রয়েছে মাত্র ১ জন চিকিৎসক, ১ জন নার্স এবং ২ জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মী।

যদিও গ্রামবাসীদের বক্তব্য, স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব আগেও ছিল। এই পরিকাঠামোতেই আগে ভাল পরিষেবা মিলেছে। কেন্দ্রে বিদ্যুৎ, জলের ব্যবস্থা-সহ বাসযোগ্য একটি কোয়ার্টার রয়েছে। অথচ বর্তমান চিকিৎসককে কেন্দ্রে পুরো সময়ের জন্য পাওয়া যায় না। স্বাভাবিক ভাবেই শুক্রবারের ঘটনার প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল ফেরানোর দাবিতে ক্ষোভ চরমে উঠেছে। যার আঁচ এ দিন ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে পেয়েছেন ডেপুটি সিএমওএইচ (২) স্বপন ওঝা। বেশ কিছু ক্ষণ স্বপনবাবুকে তালাবন্ধ করে রেখে দেন বিক্ষোভকারীরা। স্বপনবাবু বলেন, ‘‘পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসেছিলাম। বের হতে গিয়ে দেখি তালাবন্ধ। শুনছি স্থায়ী চিকিৎসকের দাবিতেই এমনটা করা হয়েছে। বিষয়টি আমার এক্তিয়ারভুক্ত নয় বোঝাতে ওঁরা তালা খুলে দেন।’’

এ দিকে, স্থানীয় বাসিন্দা গৌতম চট্টরাজ, উৎপল দাস, অসীম মণ্ডলরা জানান, গ্রামবাসীদের এই ক্ষোভ অত্যন্ত ন্যায্য। কারণ এলাকার ৩০-৪০ টি গ্রামই শুধু নয়, লাগোয়া মুর্শিদাবাদের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষ এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির উপরেই নির্ভরশীল। তার উপর লাঙলহাটা বিল এবং কূয়ে নদী সংলগ্ন এই এলাকা এমনিতেই বন্যাপ্রবণ। প্রতি বছর পেটের রোগ লেগেই থাকে। অথচ কাছাকাছি স্বাস্থ্যকেন্দ্র বলতে রয়েছে ১০-১৫ কিলোমিটার দূরে লাভপুর কিংবা কীর্ণাহারে। অনেক সময় ওই সব স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছতেই রোগী আরও সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়েন। গ্রামীণ স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার এমন বেহাল দশার পাশাপাশি রাতের ঘটনায় আরও ক্ষোভ বাড়িয়েছে ঠিবার। শুক্রবারের ঘটনায় রামকুমার গঙ্গোপাধ্যায় নামে এক বাসিন্দাকে আটক করেছে পুলিশ। পুলিশের দাবি, সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে ওই ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। রামকুমারবাবু অবশ্য ওই অভিযোগ অস্বীকার করে পাল্টা বলছেন, ‘‘বারবার স্থায়ী চিকিৎসকের দাবি জানিয়েও কাজ হয়নি। হাতের কাছে স্বাস্থ্য কর্তাদের পেয়ে একই দাবি তুলেছিলাম। কিন্তু, আশ্বাস তো দূরের কথা, উল্টে শাসকদলের কিছু লোক পুলিশের লাঠি নিয়ে মারধরের পরে আমাকে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন।’’

ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন বিজেপি-র জেলা আহ্বায়ক অর্জুন সাহা। শনিবার তিনি বলেন, ‘‘রাজ্য সরকারের ব্যর্থতা ঢাকতে শাসকদলের ছেলেরা পুলিশের লাঠি নিয়ে মানুষের কণ্ঠরোধ করছে। এর চাইতে লজ্জার আর কি থাকতে পারে!’’ যদিও মারধরের অভিযোগ মানতে নারাজ শোভনবাবু। তাঁর দাবি, ‘‘আমাদের দলের কেউ কাউকে লাঠিপেটা করেনি। মুষ্টিমেয় কয়েক জন যুবক ওই সময় চিকিৎসার কাজে বাধা সৃষ্টি করছিলেন বলেই এক জনকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।’’ তাঁর বক্তব্য, স্থায়ী চিকিৎসকের বিষয়ে গ্রামবাসীরা আলাদা করে দাবি জানাতে পারতেন। কিন্তু, সঙ্কটের পরিস্থিতিতে কাজে বাধা দেওয়াটা ঠিক নয়।

অন্য দিকে, সংশ্লিষ্ট লাভপুর ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক বুদ্ধদেব মুর্ম জানান, খাদ্যে বিষক্রিয়ার কারণে ওই গ্রামে প্রায় ৯০ জন পেটের রোগজনিত নানা উপসর্গে আক্রান্ত হন। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। তাঁর অভিযোগ, ‘‘স্থায়ী ডাক্তারের দাবিতে শুক্রবার ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কাজে যাওয়া স্বাস্থ্যকর্মীদের নিগ্রহের চেষ্টা করেন কিছু গ্রামবাসী।’’ তবে, মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক হিমাদ্রী আরি বলেন, ‘‘বহু দিন ধরেই জেলার বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসকের অভাব রয়েছে। প্রয়োজনীয় নিয়োগ হচ্ছে না। অভাব রয়েছে স্বাস্থ্যকর্মীরও। বিষয়টি রাজ্যস্তরে জানানো হয়েছে।’’ ঠিবা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ক্ষেত্রে বাসিন্দারা লিখিত অভিযোগ জানালে তদন্ত করে পদক্ষেপ করার আশ্বাস তিনি দিয়েছেন। একই আশ্বাস দিয়েছেন রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ও।

অন্য বিষয়গুলি:

food poison trinamool doctor tmc police murshidabad
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy