ভি কার্তিকেয়ন পান্ডিয়ান। —ফাইল চিত্র।
কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শেষ করে তিনি পঞ্জাব ক্যাডারের আইএএস হয়েছিলেন ২০০০ ব্যাচে। ময়ূরভঞ্জ ও গঞ্জামের মতো ওড়িশার দুই পিছিয়ে পড়া জেলার কালেক্টর (জেলাশাসক) থাকার সময়ে প্রান্তিক জনজাতিদের কল্যাণে কাজ করে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেন, নজরে পড়েন মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়কেরও। ২০১১-এ মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে ব্যক্তিগত সচিব পদে নিয়োগ করার পরে এক যুগ, বা বারোটা বছর ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয় (সিএমও)-এর শেষ কথা হয়ে উঠেছিলেন জন্মসূত্রে তামিল, বছর পঞ্চাশের এই আমলা। অবশেষে আইএএস-এর চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে গত কার্তিক পূর্ণিমায় জগন্নাথকে প্রণাম করে শাসক দল বিজু জনতা দলের সদস্যপদ নিলেন ভি কার্তিয়েকন পান্ডিয়ান, ওড়িশা এক ডাকে যাঁকে চিনছে কার্তিক পান্ডিয়ান নামে।
কর্পোরেট সংস্থার অফিসের আদলে গড়া দলের ঝাঁ-চকচকে সদর দফতর ‘শঙ্খ ভবন’-এ গত ২৭ নভেম্বর সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানে কার্তিক পান্ডিয়ানকে স্বাগত জানিয়েই তাঁকে পূর্ণমন্ত্রীর পদমর্যাদায় ‘ফাইভ টি’-র চেয়ারম্যান করে দেন মুখ্যমন্ত্রী নবীন।
কী এই ‘ফাইভ টি’?
এক কথায়, মস্তিষ্ক হিসাবে যা ওড়িশা সরকারের প্রতিটি দফতরকে চালনা করে। ২০৩৬-এ শতবর্ষে পা দিচ্ছে ওড়িশা। তার আগে প্রতিটি ক্ষেত্রে রাজ্যকে দেশের পয়লা সারিতে উন্নীত করার ‘মিশন’ নিয়ে নবীন তৈরি করেছেন এই ‘ফাইভ টি’। পাঁচটি ‘টি’ হল ট্রান্সপারেন্সি (স্বচ্ছতা), টেকনোলজি (প্রযুক্তি), টিমওয়র্ক (দল বেঁধে কাজ), টাইম (নিয়মানুবর্তিতা) এবং ট্রান্সফর্মেশন (পরিবর্তন)।
দায়িত্ব পেয়েই দৌড়চ্ছেন পান্ডিয়ান, যিনি আবার স্বীকৃত মাঝারি পাল্লার দৌড়বীরও। কাজের মধ্যেও ফুরসত খুঁজে ট্র্যাক-শু গলিয়ে ভুবনেশ্বর স্টেডিয়ামে বাঁই-বাঁই দৌড়ে নেন কিলোমিটার দশেক। পুরীর ‘শ্রীমন্দির পরিক্রমা’ প্রকল্পে পান্ডিয়ানের অধীনে কাজ করা ইঞ্জিনিয়ার উমাপতি পড়িদার কথায়, “উনি কাজ করেন সামনে দাঁড়িয়ে। বরফ-ঠান্ডা মাথা, কথা বলেন নিচু গ্রামে, সবাইকে মর্যাদা দিয়ে। সময় বেঁধে দিয়ে নির্দিষ্ট দিনে কাজ বুঝে নেন। যে কোনও সমস্যার ওষুধ যেন তাঁর পকেটে থাকে! অদ্ভুত মানুষ আমাদের স্যর।” পুরীতে যে সাড়ে তিন বছর কাজ হয়েছে, প্রতিটি শনিবার তিনি কাজের জায়গায় গিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা অফিস করেছেন। দ্রুত সমস্যা মিটিয়ে দিয়েছেন, কাজ থামতে দেননি— জানাচ্ছেন উমাপতি।
নিজে ক্রীড়াবিদ হওয়ায় ‘ফাইভ টি’-র অধীনে বিভিন্ন খেলার পরিকাঠামো তৈরির কাজটি আগেই শেষ করেছেন পান্ডিয়ান। ভারতের হকি দলের পুনর্জাগরণ ঘটেছে ওড়িশা সরকারের হাত ধরে। কটক এখন ভারতের হকি দলের স্থায়ী শিবির। আইএসএল-এ নজর কেড়েছে রাজ্যের নানা প্রান্তের জনজাতিদের থেকে বেছে নেওয়া খেলোয়াড়ে তৈরি ওড়িশার ফুটবল দলটি। কবাডি, কুস্তির মতো চিরায়ত খেলাগুলোও সরকারি আনুকূল্য পাচ্ছে।
খেলার পরে এখন চলছে ‘ফাইভ টি স্কুল’ প্রকল্প। রাজ্যের প্রত্যেকটি স্কুলকে কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তির সর্বাধুনিক গ্যাজেটে সাজিয়ে স্মার্ট স্কুল-এ উন্নীত করা হচ্ছে। পান্ডিয়ান জানিয়েছেন, ওড়িশায় নানা প্রকল্পে পড়ুয়াদের ৯৮ শতাংশই কোনও না কোনও বৃত্তি পায়, যা পড়াশুনায় আগ্রহ বাড়ায়। সেখানে ভারতের অন্য রাজ্যগুলিতে বৃত্তি পেয়ে থাকে মাত্র ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পড়ুয়া।
ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে ওড়িশায় সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা সম্পূর্ণ ভাবে নিখরচার। এমনকি, আউটডোর রেজিস্ট্রেশন, ওষুধ, এক্স-রে, এমআরআই, ডায়ালিসিস, কেমোথেরাপিও হয় বিনামূল্যে। ‘ফাইভ টি স্বাস্থ্য’ প্রকল্পে এক দিকে ব্লক স্তর থেকে মেডিক্যাল কলেজ পর্যন্ত হাসপাতালগুলিকে অত্যাধুনিক করে তোলা হচ্ছে, পাশাপাশি সাড়ে ৩ কোটি মানুষকে দেওয়া হয়েছে ‘বিজু স্বাস্থ্য কল্যাণ যোজনা’-র হেল্থ কার্ড। এই কার্ডে তালিকাভুক্ত শ’দুয়েক বেসরকারি হাসপাতাল থেকেও পরিবারের পুরুষ ও মহিলারা যথাক্রমে ৫ ও ৭ লক্ষ টাকা পর্যন্ত নিখরচায় চিকিৎসা করাতে পারবেন। এই প্রকল্পের নেতৃত্বেও সেই পান্ডিয়ান।
আইএএস-এ একই ব্যাচের সহপাঠী সুজাতা রাউতকে বিয়ে করেছেন পান্ডিয়ান। ওড়িশা ক্যাডারের আমলা সুজাতা আবার নবীন সরকারের জনপ্রিয়তার আর এক স্তম্ভ ‘মিশন শক্তি’-র প্রধান। মহিলা কল্যাণে সরকারের প্রকল্পগুলিকে সমন্বিত করে পরিচালনার দায়িত্বে এই ‘মিশন শক্তি’। আর্থিক অনগ্রসর মহিলাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠী গঠনে ওড়িশা অনেক এগিয়ে। রাজ্য জুড়ে ৬ লক্ষের বেশি এমন গোষ্ঠীতে নিযুক্ত ৭০ লক্ষের বেশি মহিলা। বিজেপির অভিযোগ, গত পাঁচ বার নবীনের দলের তিন চতুর্থাংশ আসন পেয়ে জেতার প্রধান কারিগর আদতে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিই।
নভেম্বরে বিজেডি-তে যোগ দেওয়ার আগেই বকলমে দলের দ্বিতীয় ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন কার্তিক পান্ডিয়ান। তা নিয়ে দলে যে খুব অসন্তোষ আছে, তা নয়।
আশ্চর্যজনক ভাবে পান্ডিয়ানে অসন্তোষ নেই বিরোধী মহলেও। কার্তিকের কথা ওঠায় প্রধান বিরোধী দলের বর্ষীয়ান নেতা সমীর মহান্তির কণ্ঠে ঝরে পড়ল সম্ভ্রম। বললেন, “খুবই যোগ্য আমলা ছিলেন। কাজের মানুষ। বিনয়ী, ভদ্র-সভ্য।” প্রদেশ কংগ্রেসের সহ সভাপতি সনৎ দাসেরও একই কথা, “কম কথার মানুষ। কাজ করেন বেশি, ঢাক বাজান কম। অবশ্যই বিজেডি-র সম্পদ হবেন পান্ডিয়ান।”
অনেকের ধারণা, দল ও সরকারের নেতৃত্বে কার্তিক পান্ডিয়ানই বৃদ্ধ নবীনবাবুর উত্তরাধিকারী। কার্তিককে দলে এনে, সরকারে মর্যাদা দিয়ে সকলকে সেই বার্তাই দিচ্ছেন নবীন। তবে বিজু জনতা দলের একাংশ মনে করেন, শেষ কথা বলার সময় আসেনি। দলের এক সম্পাদকের কথায়, “নবীনবাবু অনেককেই এমন মাথায় তোলেন। অক্লেশে নামিয়েও ফেলেন। জগন্নাথের মতো তাঁরও লীলা বোঝা ভার!”
তবে এ বারের বিধানসভা ভোটে বিজেডি-র মঙ্গলশঙ্খে ফুঁ দেবেন কার্তিক পান্ডিয়ানই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy