তোয়ার পেটব্যথা শুরু হয়েছিল আচমকাই। ফুচকা খেয়ে হজমের গোলমাল ভেবে প্রথমে পাত্তা দেননি ওর মা-বাবা। কিন্তু সেই ব্যথা যখন বাড়তে লাগল আর যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যেতে লাগল বছর বারোর মেয়েটি, তখন চিন্তায় পড়লেন তাঁরা। ডাক্তারের কাছে গিয়ে নানা পরীক্ষার পরে জানা গেল, অ্যাপেন্ডিসাইটিস-এ ভুগছে তোয়া। অবস্থা এমন, অপারেশন না করলে চলবে না।
কী এই অ্যাপেন্ডিক্স?
আমাদের খাদ্যনালিতে ক্ষুদ্রান্ত্র আর বৃহদন্ত্রের মাঝের যে জাংশন, সেখানে ছোট্ট পাউচের মতো একটা জিনিস থাকে। এটাই অ্যাপেন্ডিক্স। শরীরের ডান দিকে তলপেটে থাকা এই পাউচের মতো অ্যাপেন্ডিক্সে অনেক ভাল ব্যাকটিরিয়া থাকে। এর জন্যই বাইরের ব্যাকটিরিয়া যখন-তখন আমাদের শরীরে হামলা করতে পারে না। বাইরে থেকে খাবার যখন আমাদের শরীরে ঢোকে, তার সঙ্গে অনেক খারাপ ব্যাকটিরিয়াও ঢোকে। তখন এই ভাল ব্যাকটিরিয়া খারাপ ব্যাকটিরিয়ার সঙ্গে লড়াই করে আমাদের শরীর সুস্থ রাখে। অ্যাপেন্ডিক্সের মূল কাজই এটা। তৃণভোজী প্রাণীদের, বিশেষত গরুর অ্যাপেন্ডিক্স তুলনায় বেশ বড়।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ যত শাকপাতা খাওয়া কমিয়েছে, মাংস খাওয়ার পরিমাণ বাড়িয়েছে, ততই অ্যাপেন্ডিক্সের প্রয়োজনীয়তাও কমেছে। সেটি এখন আমাদের শরীরে লুপ্তপ্রায় অঙ্গের মতো ছোট। যদি শরীরে অ্যাপেন্ডিক্স না-ও থাকে, ক্ষতি হয় না। তবে থাকলে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকটাই বাড়ে।
অ্যাপেন্ডিসাইটিস কী
চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার বললেন, ‘‘অনেক সময়ে কোনও খাবারের টুকরো ঢুকে বা অন্য কোনও কারণে ওই পাউচের মতো অংশটির মুখ যদি আটকে যায়, তা হলে সেখানে সংক্রমণ ঘটে। জায়গাটা ফুলে ওঠে, ব্যথা হয়। ডাক্তারি পরিভাষায়, এটাই অ্যাপেন্ডিসাইটিস। অনেক সময়ে কনস্টিপেশন থেকেও এই রোগ হতে পারে। সাধারণত ১০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে অ্যাপেন্ডিসাইটিস বেশি দেখা যায়। এর পরে বয়স যত বাড়বে, অ্যাপেন্ডিক্স আরও ছোট হয়ে শুকিয়ে যাবে।’’
রোগলক্ষণ
অ্যাপেন্ডিসাইটিস হলে পেটে ব্যথা থাকবেই। তবে, শরীরের ডান দিকে অ্যাপেন্ডিক্স থাকলেও ব্যথার সূত্রপাত কিন্তু ওই দিক থেকে না-ও হতে পারে। শুরু হয় সাধারণত নাভির চার পাশে। ক্রমশ সেই ব্যথা ছড়াতে থাকে ডান দিকে। এর সঙ্গে জ্বর, বমি বা লুজ় মোশনও হতে পারে। সঙ্গে থাকতে পারে কুঁচকির উপরের অংশে কলিক পেন।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, সকলের অ্যাপেন্ডিক্স এক জায়গায় থাকে না। অনেক সময়ে ক্ষুদ্রান্ত্র, বৃহদন্ত্রের জাংশনের নীচের দিকে তা ঝুলতে পারে, কখনও খাদ্যনালির পিছনে থাকে, এ ক্ষেত্রে ব্যথা কম হয়। আবার কারও ক্ষেত্রে অনেকটা উপরে উঠে অ্যাপেন্ডিক্স লিভারের নীচেও চলে আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে ব্যথা লিভারের ঠিক নীচে হতে পারে।
চিকিৎসা
অ্যাপেন্ডিসাইটিসের চিকিৎসার দু’টি ভাগ— ওষুধ এবং অপারেশন। ডা. তালুকদার বললেন, ‘‘প্রথমে চিকিৎসকেরা অ্যান্টিবায়োটিক দেন। এতে যদি তাড়াতাড়ি ইনফেকশন কমে যায়, তা হলে অপারেশনের দিকে যাওয়া হয় না। যদি দেখা যায়, অ্যান্টিবায়োটিকে তেমন উপকার হচ্ছে না, তখন এটিকে কেটে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে এই সিদ্ধান্ত নির্ভর করবে, রোগীকে কোন অবস্থায় চিকিৎসকের কাছে আনা হয়েছে, তার উপরে। যদি দেখা যায়, সংক্রমণের অংশে পুঁজ হয়ে গিয়েছে বা অনেকটা জায়গা জুড়ে সংক্রমণ ছড়িয়ে গিয়েছে, তখন আর ওষুধ দেওয়ার উপায় থাকে না। অপারেশনই একমাত্র পথ।’’
এ রোগ বোঝা সহজ নয়
অ্যাপেন্ডিসাইটিস হয়েছে কি না, বোঝার সরাসরি কোনও উপায় নেই। ডা. তালুকদার জানালেন, অ্যাপেন্ডিক্স যে জায়গায় থাকে, ঠিক সেখানে আরও তিন-চারটি কারণে ব্যথা হতে পারে। সেই কারণগুলি বাদ গেলে তবে অ্যাপেন্ডিক্সের কথা ভাবা হয়। মেয়েদের ওভারিও ওখানেই থাকে। ওভারিতে সিস্ট বা ইনফেকশন হলে বা এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির কারণেও ব্যথা হতে পারে। সুতরাং বিবাহিত মেয়েদের ক্ষেত্রে পেটের ডান দিকে ব্যথা হলে চিকিৎসকেরা প্রথমেই জেনে নেন, তাঁর পিরিয়ডস ঠিকমতো হচ্ছে কি না। পিরিয়ড মিস করলে দেখে নেওয়া হয়, মেয়েটি এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির শিকার কি না। পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোমের (পিসিওএস) ক্ষেত্রেও পিরিয়ডসের সমস্যা হয় ও পিরিয়ডসের আগে বা পরে ঠিক অ্যাপেন্ডিসাইটিসের মতোই ব্যথা হতে পারে।
আবার ঠিক এর পিছনেই থাকে আমাদের ইউরেটার। ইউরেটারে কোনও রেনাল স্টোন হলেও ওইখানে ব্যথা হবে। তাই প্রথমেই চিকিৎসকরা এক্স-রে করে নিশ্চিত হতে চান, ইউরেটারে স্টোন আছে কি না। অ্যাপেন্ডিক্সের অবস্থান সাধারণত যেখানে থাকে, সেই ক্ষুদ্রান্ত্র ও বৃহদন্ত্রের জাংশনটিকে ডাক্তারি পরিভাষায় বলে ‘সিকাম’। এখানে ইনফেকশন হলেও অ্যাপেন্ডিসাইটিস বলে ভুল হতে পারে। টাইফয়েড বা আমাশয়ে ওই জায়গায় ইনফেকশন হয়। ফলে অন্য সম্ভাবনাগুলো দেখে নিয়ে তবেই চিকিৎসকেরা অ্যাপেন্ডিসাইটিস নিয়ে মত দেন। কারণ, এমন কোনও নির্দিষ্ট টেস্ট নেই, যাতে অ্যাপেন্ডিসাইটিসের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়। তাই পেট ব্যথা হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
রোগ হলে চিকিৎসা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু লাইফস্টাইলে বদল এনেও অ্যাপেন্ডিসাইটিস আটকানো সম্ভব। নিয়মিত খাদ্যতালিকায় শাকপাতা ও আনাজপাতি রাখতে হবে। এতে অ্যাপেন্ডিক্সের ভাল ব্যাকটিরিয়াগুলো কাজ করতে পারবে। পর্যাপ্ত জল খেতে হবে, কোষ্ঠকাঠিন্যের সম্ভাবনা কমবে। চট করে সংক্রমণও হবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy