Advertisement
E-Paper

এ বসন্ত জীবনে মৃত্যু দিয়ে গেল

‘‘আমায় আদর করতে চাও না তুমি? সত্যি বলবে।’’ ফাগুয়ার স্মৃতি রোমন্থনে স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়।বেশ জোরে হাওয়া দিয়েছে। দখিন হাওয়া। একটু ছোঁওয়াতেই গা শিরশিরিয়ে উঠল যেন। চোখের পাতায় সেই সে দিনের বসন্ত উৎসব। পথের ধুলোয়। মাটি আর সবুজ ঘাসে। নাহ! শান্তিনিকেতন নয়।

শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১৬:১৩
ছবি: এএফপি।

ছবি: এএফপি।

বেশ জোরে হাওয়া দিয়েছে। দখিন হাওয়া। একটু ছোঁওয়াতেই গা শিরশিরিয়ে উঠল যেন। চোখের পাতায় সেই সে দিনের বসন্ত উৎসব। পথের ধুলোয়। মাটি আর সবুজ ঘাসে। নাহ! শান্তিনিকেতন নয়। তখন কি আর দোল মানেই শান্তিনিকেতনের মোচ্ছব নাকি? কাঙাল ডালে এক বিরহী কোকিল ছিল, সে বিরহেই কেমন মধুর ডাক ডাকতে পারতো। আজও ডাকে। তার সুরেই শহরে বসন্ত নামে। কিন্তু তার বিরহকে আমরা চিনতে পারি না আর। আমরা হোয়াটস্অ্যাপের প্রাণী। ফরওয়ার্ড মেসেজে আমাদের বসন্ত। পলাশ। হলদে শাড়ি, মাথায় আবিরের টিপ পরা মেয়ে, কোকিল— সবাই আসে। ভোর ভাঙা দোলে পাশের কোয়ার্টারের সুমনার দাদার বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় থাকি না। সুমনার দাদা সুমন। কী সহজেই না তখন সব নাম হয়ে যেত। লম্বা, কালো ফ্রেমের গম্ভীর চশমা। মিলিটারিতে ছিল। বাড়ির রোজগেরে ছেলে ব্যাগ ভরে বিস্কুট থেকে মাখন। মায়ের বসন্ত মালতী ক্রিম। সুমনার লিপস্টিক। সব নিয়ে আসতো। ওরা নাকি অনেক কম দামে পেত। আমি সুমনদার ওই ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম বড় বড় চোখ করে। আমার জন্য যদি কখনও কিছু...নাহ্।

এ কী আর আজকের সময়! ভ্যালেন্টাইন ডে-তে হীরে। বিয়ের তারিখে গাড়ি। আর প্রেম করার সময় বন্ধুর ফাঁকা বাড়ি! সুমনদা ইচ্ছে করেই আনতো না। শুধু দোলের আগের রাতে যখন পাড়ায় সকলে নেড়া পোড়াতে ব্যস্ত আমায় চিলেকোঠায় ডেকে নিত! প্রত্যেক বার ভাবতাম যাব না। বলতামও সে কথা। কিন্তু প্রত্যেক বারই যেতাম। কী হত আমাদের? সুমনদা ‘মেঘদূত’ পড়ে শোনাতো আমায়। শুধু ওই সন্ধে-রাত। পড়তেই থাকতো।

এক বার আমার চোখে চোখ রেখে বলেছিল, ‘‘বল তো, নির্বাসনে যাওয়ার পর যক্ষকে মেঘ যখন বলল, তোমার প্রিয়াকে চিনব কেমন করে? তখন যক্ষ কী বলেছিল?’’ আমি কিছুই বলতে পারতাম না! আমি তো তখন আমার যক্ষকে চিনতে চাই। বুঝতে চাই। ছুঁতে চাই। আমায় চুপ দেখে নাকে আলতো টোকা মেরে বলত, ‘‘যক্ষ বলেছিল, আমার প্রিয়ার ঊরুতে আমার নখের দাগ আজও আছে,’’...ধপ করে গাছ থেকে শিমুল পড়ত। মাটির কাছে যেন শিমুল নিজেকে নিবেদন করত। আর সেই দখিন হাওয়া আমাদের মধ্যে খেলে বেড়াত। ওর গা থেকে আমার গায়ে। আমরা তো এঁটো হয়ে যেতাম! যেতামই তো! আমার খোলা চুল ঠোঁটে আটকে যেত। সুমনদা আমার এই রিক্ততা মন দিয়ে, চোখ ভরে দেখত। কিন্তু কিচ্ছুটি করত না। উল্টে বলত, ‘‘রাত হয়ে আসছে, যা এ বার।’’

আরও পড়ুন: বাংলার হোলির ইতিহাসে মিশে আছে সম্প্রীতির রং

এই তো সন্ধে নামল। বুকের পরে, দুখের পরে। তা হলে চলে যেতে বলা কেন? বুকটা মোচড় দিয়ে উঠতো। ওই অত অল্প বয়সে জেনে গিয়েছিলাম মনের সাড়া না পাওয়ার জ্বালা। ভেতরটায় কষ্ট হত। কাউকে না বলা কষ্ট! চুল খুলে শাড়ি পড়ে, আবির টিপ পড়েই তো ওর সামনে দাঁড়াতাম। পা ছড়িয়ে, হাঁটু জড়ো করে, কখনও বা ইচ্ছে করে বুকের আঁচল নামিয়ে দিতাম। চিলেকোঠা সাক্ষী আছে। দেখুক সুমনদা আমার শরীরটাও কেমন ওর জন্য অপেক্ষা করে আছে। নাহ! এতে লজ্জা করেনি। নিজের কাছে নিজেকে প্রকাশ করছি তো! কিন্তু সুমনদা...দোলের শোভাযাত্রায় সকলের সামনে আমায় পিচকিরিতে রং ছুড়বে। বেলা গড়ালে গায়ে, গালে আবির মাখাবে। কিন্তু এক বারও কাছে ডাকবে না। আমার হাত ধরবে না। আমি কোনও দিন ওর কাঁধে মাথা রেখে গান গাইতে পারব না।

আরও পড়ুন: হোলিতে ভিজলেও খারাপ হবে না এই স্মার্টফোনগুলি!

বলেছিলাম কুল কুড়োতে গিয়ে। ‘‘আমায় দেখতে ইচ্ছে করে না তোমার?’’ একশো দিনের নীরবতার পর আমার পীড়াপীড়িতে জবাব আসে, ‘‘না’’। আমিও নির্লজ্জ। নাছোড়বান্দা। ‘‘আমায় আদর করতে চাও না তুমি? সত্যি বলবে।’’ জবাব আসে, ‘‘আসলে, এ ভাবে ভাবিনি কখনও।’’ পৃথিবী এত নিষ্ঠুর! তবে কি বসন্তও? সব ঝরিয়ে, সব মরিয়েই যেন শান্তি! তবে ‘মেঘদূত’ পড়ানো কেন? নিজে বিয়ে করল না। কিন্তু আমার বিয়েতে হইহই করে পরিবেশনের দায়িত্ব নিয়ে নিল। বসন্তকালে ‘মেঘদূত’ শুনেছি ওর জন্য। নিজের বিয়েতে বেনারসী পড়ার নামে দরজা বন্ধ করে একা কেঁদেছি। ফুলশয্যার ভোরেও চোখে লেখেছিল জল। আমার নিয়মকে বরাবর বেনিয়মের রাস্তায় নিয়ে গিয়ে ফেলেছিল সুমনদা। বিয়ের পর একটা কথাই বলেছিলাম ওকে। দোলে কিন্তু আমি বাপের বাড়ি যাব। অন্য কোথাও কোনও দিন না। প্রথম যে বার এলাম, সুমনদা সেই প্রথম দোলে বাড়ি এল না। ওর পেতলের পিচকিরিটা চিলেকোঠার ঘরে অসহায় চোখে আমার দিকে তাকিয়েছিল। রাগ হল খুব। আর আসব না দোলে। হঠাৎ দেখি সুমনার হাত থেকে মালপোয়ার থালাটা পড়ে গেল! কী হল সুমনার? দূর থেকে কারা যেন পিচকিরির লাল রঙে আমায় রাঙিয়ে দিল! দোলের লাল রং? নাকি সুমনদার শরীর থেকে গুলি ঠিকরে বেরিয়ে আসা রক্ত! যুদ্ধ লেগেছে। সুমনদা নিজেকে সঁপে দিয়েছে— মৃত্যু রঙে। যার রং লাল।

বসন্ত জীবনে মৃত্যু দিয়ে গেল।

Festival holi Color dol
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy