রূপান্তরিত নারীর পরিচয়পত্র দেখিয়ে পাসপোর্ট তৈরি হল কলকাতার বালিগঞ্জের বাসিন্দা রূপান্তরিত নারী অনুপ্রভা দাস মজুমদারের। সম্ভবত দেশে এটিই প্রথম এমন ঘটনা। এ দেশে আগে পাসপোর্ট তৈরির জন্য রূপান্তরকামী বা ‘ট্রান্সজেন্ডার’ পরিচয়পত্রকে মান্যতা দেওয়ার রেওয়াজ ছিল না। ফলে তৃতীয় লিঙ্গের কোনও ব্যক্তির পক্ষে পাসপোর্ট পাওয়া ছিল কঠিন। লিঙ্গ-অধিকার কর্মী অনুপ্রভার পাসপোর্ট আদায়ের লড়াইয়ের পথটিও সহজ ছিল না। গত দু’বছর ধরে চলেছে দৌড়োদৌড়ি। অবশেষে পাসপোর্ট হাতে পেয়েছেন অনুপ্রভা।
এর আগে কলকাতার পাসপোর্ট অফিসে একাধিক বার ঘুরেও কোনও কাজ হয়নি। তার পর কলকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হন। কোর্টের মধ্যস্থতায় একজন ভারতীয় নাগরিকের অন্যতম প্রধান পরিচয়পত্রটি হাতে পেয়ে বৃহস্পতিবার আনন্দবাজার ডট কমকে অনুপ্রভা বললেন, ‘‘এত দিনে স্বস্তি পেলাম। ক্লান্তিকর এক যাত্রার শেষ হল।’’
২০২৩ সাল থেকে রূপান্তরকামীদের জন্য পাসপোর্ট আদায়ের অধিকারের লড়াই লড়ছিলেন অনুপ্রভা। অবশেষে গত ১৮ জুন কলকাতা হাইকোর্ট নির্দেশ দেয়, এ বার থেকে পাসপোর্ট তৈরির ক্ষেত্রে রূপান্তরকামী পরিচয়পত্রকেও মান্যতা দিতে হবে। বছর ৩২-এর অনুপ্রভা বলেন, ‘‘কলকাতা হাইকোর্টের এই রায় রূপান্তরকামী সম্প্রদায়ের কাছে একটা বড় জয়। তবে পরিচয়পত্র আদায় করতে যে আমাদের আদালতের শরণাপন্ন হতে হল, সেটা আসলে দুর্ভাগ্যের।’’
শুধু পাসপোর্ট তৈরির সময়ই নয়, এর আগে আধার কার্ড তৈরির সময়েও একই ভাবে হতাশ হতে হয়েছিল অনুপ্রভাকে। তিনি বলেন, ‘‘২০২১ সালে ‘ট্রান্সজেন্ডার রাইট্স প্রোটেকশন অ্যাক্ট’-এ স্পষ্ট বলা হয় যে, রূপান্তরকামী পরিচয়পত্র দেখিয়ে একজন রূপান্তরকামী তাঁর যাবতীয় আইনি নথিপত্রের জন্য আবেদন করতে পারবেন। তবুও আধার কার্ড তৈরির সময়ে আমাকে বাধা পেতে হয়েছিল। সেখানেও আমাকে বলা হয়, আধার তৈরির জন্য রূপান্তরকামী পরিচয়পত্র মানা হবে না। তবে সেই সংক্রান্ত যাবতীয় আইনি নথি পাঠানোর পর আধার কর্তৃপক্ষ আমার সঙ্গে সহায়তা করেন। আমার আবেদনে তাঁরা নিজেদের সিস্টেমটি আপডেট করেন এবং আমি আমার আধার কার্ড হাতে পাই। আইন আছে, তবু সরকারি দফতরগুলিতে সেই আইন সংক্রান্ত কোনও সার্কুলার জারি হয় না, সেই জন্যই শুরু হয় যাবতীয় সমস্যা।’’
২০২৩ সালে কর্মসূত্রে অনুপ্রভার কাছে বিদেশে যাওয়ার জন্য একটি আমন্ত্রণ আসে। আর সেই জন্যই তিনি পাসপোর্টের আবেদন করেন। অনুপ্রভা বলেন, ‘‘আমাকে বলা হয় পাসপোর্ট তৈরি করতে হলে নাম বদলের এফিডেভিট, গেজেট নোটিফিকেশন জমা দিতে হবে। এর পাশাপাশি, তিন ধরনের সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপনও দিতে হবে। এফিডেভিটের জন্য উকিলকে টাকা দাও, কেন্দ্রীয় গেজেট নোটিফিকেশনের জন্য দিল্লি যাও, এর পাশাপাশি বিজ্ঞাপন দাও— সব মিলিয়ে অনেক টাকা খরচের ব্যাপার। একজন সাধারণ নাগরিক যখন নিজের ইচ্ছেতে নামবদল করেন, সে ক্ষেত্রে তাদের এই খরচটি বহন করতে হয়। তবে রূপান্তরিতদের ক্ষেত্রে কেন এমনটা হবে? এটা তো আমাদের ন্যায্য অধিকার। প্রতিটি সরকারি দফতর যদি এ ক্ষেত্রে নিজের নিজের নিয়ম বানায়, তা হলে তো মুশকিল। তবে এই রায়ের পর আর আমার রূপান্তরকামী ভাই-বোনেদের এমন সমস্যা হবে না, এইটুকু আশা এখন করতেই পারি। এই রায়ের কপি এখন তাঁদের অনেক মুশকিলই আসান করবে।’’
সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রায় ১০ বছর ধরে কাজ করছেন অনুপ্রভা। রূপান্তরকামীদের পরিচয় সংক্রান্ত নথির তৈরির কাজে সাহায্য করেন তিনি। এর পাশাপাশি তাঁর মূল কাজ রূপান্তরকামীদের স্বাস্থ্য নিয়ে। অনুপ্রভা বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ-সহ সারা ভারতে এখনও রূপান্তরকামীদের স্বাস্থ্য সমস্যাগুলিকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। পশ্চিমবঙ্গে কোনও হাসপাতালে রূপান্তরকামীদের জন্য আলাদা ওয়ার্ডের ব্যবস্থাটুকুও নেই। রূপান্তরিত এবং রূপান্তরকামীদের স্বাস্থ্য নিয়ে আরও বেশি সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজন আছে। আমার কাজ সেই নিয়েই। রূপান্তরকামীদের জন্য একটি ট্রান্স ক্লিনিক তৈরি করাই এখন আমার লক্ষ্য।’’ ২০১৯ সালে অচিন্ত্য দাস মজুমদার থেকে অনুপ্রভা হওয়ার যাত্রা শুরু করেন তিনি। তার পর নানা রকম ক্লিনিক্যাল, সামাজিক আর আইনি ধাপ পেরোনো। তিনি বলেন, ‘‘শারীরিক পরিবর্তনের সময়ে আমি অনুভব করি, রূপান্তরকামীদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ে এখনও আমাদের দেশ অনেকটা পিছিয়ে।’’
জীবনের বড় লড়াইগুলিতে পরিবারকে পাশে পাননি অনুপ্রভা। রূপান্তরিত হওয়ার লড়াই থেকে রূপান্তরকামীদের পরিচয় আদায়ের লড়াইয়ে, মূল কান্ডারি হয়ে ওঠার যাত্রায় পাশে ছিলেন শুধু এক জন, অনুপ্রভার স্বামী বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায়।