পার্কিনসন্স নিয়ে আলোচনাসভায়।—নিজস্ব চিত্র
প্রতিদিনের ছোট ছোট যুদ্ধকে জয় করা। আর তা করতে করতেই পার্কিনসন্সের মতো রোগের বিরুদ্ধে কী ভাবে যোদ্ধায় পরিণত করা যায় আক্রান্তদের, সেটাই ছিল আলোচনাসভার লক্ষ্য। তবে শুধু বয়স্করাই নন, এই রোগের শিকার হচ্ছে কমবয়সিরাও— মঙ্গলবার সন্ধ্যার ওই অনুষ্ঠানে উঠে এল সেই প্রসঙ্গ।
এ দিন পার্কিনসন্স রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে গোলপার্কের রামকৃষ্ণ মিশনের সভাগৃহে একটি আলোচনাসভার আয়োজন করেছিল এ শহরের এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সেখানে মল্লিকবাজারের এক স্নায়ুচিকিৎসা হাসপাতালের নিউরোলজি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক হৃষীকেশ কুমার জানাচ্ছেন, এখন এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন সকলেই। তাঁর কথায়, ‘‘এখন কমবয়সিদের মধ্যেও পার্কিনসন্সে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ষাটের পরে এই রোগের শিকার এমন রোগীর সংখ্যা ৮০ শতাংশ। বাকি ২০ শতাংশের মধ্যে সব বয়সের রোগীরা রয়েছেন।” কিন্তু কেন তরুণ বয়সেই থাবা বসাচ্ছে পার্কিনসন্স? হৃষীকেশবাবু জানান, এ বিষয়ে কোনও একটি নির্দিষ্ট কারণকে চিহ্নিত করা এখনই সম্ভব নয়। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘দূষণের মাত্রাবৃদ্ধি, খাবারে টক্সিনের উপস্থিতি, জিনঘটিত কারণে কমবয়সিরা অনেক সময়ে পার্কিনসন্সের মতো রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।’’
এ দিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে ছিলেন বহু প্রবীণ-প্রবীণা, যাঁরা এই রোগে আক্রান্ত। কেউ আবার এসেছিলেন পরিবারে এই রোগে আক্রান্ত কোনও সদস্যের কথা ভেবে। কেউ এ ধরনের রোগীদের পরিষেবা দেওয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে। তাঁদের সামনে এই রোগের উপসর্গ নিয়ে আলোচনা করেন চিকিৎসকেরা। আঙুল-হাত-চিবুক হালকা কাঁপতে শুরু করা, অতীতের তুলনায় হাতের লেখার অক্ষর ছোট হয়ে আসা, হাঁটাচলায় অসুবিধা, শরীরের নমনীয়তা আগের তুলনায় কমে আসা— শরীরে পার্কিনসন্স বাসা বাঁধার এগুলিই প্রাথমিক লক্ষণ বলে জানান তাঁরা। স্নায়ুরোগ চিকিৎসক হৃষিকেশবাবু বলেন, “পার্কিনসন্স উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। সে জন্য সময়ে চিকিৎসা শুরু হওয়া জরুরি। ওষুধের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের থেরাপির ব্যবহারে রোগীরা উপকৃত হন।”
কী রকম থেরাপি? আয়োজক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটি রোগীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নানা ধরনের থেরাপি দেওয়ার কাজ করে। সেই সূত্রে পাওয়া অভিজ্ঞতা থেকে ওই সংস্থার সঙ্গে যুক্ত এক ফিজিওথেরাপিস্ট শুনিয়েছেন এক বৃদ্ধের গল্প। হাঁটাচলার অসুবিধা হওয়ায় দীর্ঘদিন ঘরবন্দি হয়ে ছিলেন তিনি। এক বিকালে ছাদে উঠতে পেরে অপলক চেয়ে ছিলেন আকাশের দিকে। চোখেমুখে দীর্ঘদিন পরে মুক্তির আনন্দ। রোগীদের কাউন্সেলিংয়ের সঙ্গে যুক্ত সংস্থার এক প্রতিনিধি জানান, এ ধরনের রোগীদের ক্ষেত্রে অনেক সময়ে অবসাদ ঘিরে ধরে। তখন তাঁরা কারও সঙ্গে কথা বলতে চান না। গুটিয়ে ফেলেন নিজেদের। চিকিৎসক রানা মুখোপাধ্যায় বলেন, “এক জন রোগী আর বেশিদিন বাঁচবেন না, এই ভেবে দশ বছর বাড়ির রং করাননি।” তাঁর মতে, চায়ের কাপ ফের নিজের হাতে ধরা, ফের চেকে সই, জামার বোতাম লাগাতে পারা— এগুলি অনেকটাই তফাৎ গড়ে দেয় রোগীদের মধ্যে। চিকিৎসকদের পরিভাষায় একেই বলে অকুপেশনাল থেরাপি।
আর বিষাদের মেঘ কাটিয়ে ডান্সথেরাপি কী ভাবে মুখে হাসি ফোটাতে পারে পার্কিনসন্স রোগীদের, এ দিন হাতেকলমে সেই অভিজ্ঞতারও সাক্ষী থাকলেন শ্রোতারা। প্রশিক্ষকের কথামতো চোখ বন্ধ করে হাতের মুদ্রায় সমুদ্রের ঢেউ তুললেন উপস্থিত প্রবীণ-প্রবীণারা। চোখ খুললেন যখন, মুখে লেগে যুদ্ধজয়ের হাসি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy