Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
বিপন্ন সুরক্ষা

উপকারীর ছদ্মবেশে চুরি চক্র মেডিক্যালে

হাসপাতালে রোগী নিয়ে অ্যাম্বুল্যান্স ঢুকলেই এগিয়ে আসছে সাহায্যের হাত। রোগীর আত্মীয়ের বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তাঁদের সর্বস্বান্ত করছেন একদল দুষ্কৃতী। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সক্রিয় দালাল চক্রও। খোঁজ নিয়ে দেখল আনন্দবাজার। আজ প্রথম কিস্তি।রোগী যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। তাঁকে নিয়ে অ্যাম্বুল্যান্স থামল মেদিনীপুর মেডিক্যালের জরুরি বিভাগের সামনে। রোগীর পরিজনেরা কী করবেন, কোন দিকে যাবেন, এ সব ভাবছেন। স্ট্রেচার নিয়ে হঠাৎ হাজির একদল লোক। রোগীকে পাঁজাকোলা করে ধরে তাঁরাই স্ট্রেচারে তুললেন। জরুরি বিভাগে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে ওয়ার্ডেও পৌঁছে দিলেন!

সুমন ঘোষ
মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০১৪ ০৩:০৩
Share: Save:

রোগী যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। তাঁকে নিয়ে অ্যাম্বুল্যান্স থামল মেদিনীপুর মেডিক্যালের জরুরি বিভাগের সামনে। রোগীর পরিজনেরা কী করবেন, কোন দিকে যাবেন, এ সব ভাবছেন। স্ট্রেচার নিয়ে হঠাৎ হাজির একদল লোক। রোগীকে পাঁজাকোলা করে ধরে তাঁরাই স্ট্রেচারে তুললেন। জরুরি বিভাগে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে ওয়ার্ডেও পৌঁছে দিলেন! রোগীকে নিয়ে তখন ব্যস্ত আত্মীয়েরা। এ বার ওষুধ, ইঞ্জেকশন কিনতে হবে। পকেটে হাত দিয়েই অবাক। মানিব্যাগটা কোথায়? কোথাও কি পড়ে গেল। তখনও তাঁরা বুঝতে পারেননি, সামনে আরও বিপদ রয়েছে। এ বার বাড়িতে ফোন করে কাউকে টাকা নিয়ে আসতে বলতে হবে। মোবাইল বের করতে গিয়ে আবার ধাক্কা। সেটিও নেই। সমস্যার কথা কাকে বলবেন। অল্প পরিচিত হলেও ওই সাহায্যকারীদের বলা উচিত। কিন্তু কোথায় তাঁরা!

সাহায্যকারীদের দেখা মিলবে কী করে? তারাই তো উপকারী বন্ধু সেজে এই কাজ করেছে। এমনই কৌশলে রোজই চুরি, ছিনতাই হচ্ছে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে। রোগীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় আত্মীয় সেজে ওয়ার্ডেও ঢুকে পড়ছে দুষ্কৃতীরা। তাদের লক্ষ্য গুরুতর অসুস্থ রোগী। সেই রোগীর আত্মীয়েরা চরম দুশ্চিন্তায় থাকায় অন্য দিকে নজর থাকে কম। সেই সুযোগেই রোগী ও আত্মীয়দের ব্যাগ বা পকেট থেকে টাকা, মোবাইল নিয়ে পালাচ্ছে দুষ্কৃতীরা।

বিভিন্ন ওয়ার্ডে রোগীর আত্মীয়দের সঙ্গে মিশে থাকায় ওই সব দুষ্কৃতীদের চেনাও মুশকিল। অচেনা কেউ পাশে বসে থাকলেও সন্দেহ করার কিছু নেই। মনে হবে, হয়তো তিনি পাশের শয্যায় থাকা রোগীর আত্মীয়। আবার পাশের শয্যার রোগীও উল্টোটা ভেবে নিশ্চিন্তে থাকবেন। এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে দুষ্কৃতীরা।

এছাড়াও আরও একটি চুরির কৌশল রয়েছে। সেটি মূলত রাতে ঘটে। যে সমস্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন, তাঁদের অনেকেরই আর্থিক অবস্থা খারাপ। তাই রোগীর বাড়ি দূরে হলে তাঁর আত্মীয়রা সব ক্ষেত্রে হোটেলে থাকেন না। আবার হাসপাতালেও থাকার জায়গার সঙ্কট। হাসপাতালে শয়ে শয়ে রোগী। প্রত্যেক রোগীর সঙ্গে ন্যূনতম এক জন থাকেন, কিছু ক্ষেত্রে একাধিক ব্যক্তিও থাকেন। অথচ রোগীর আত্মীয়দের বসার জন্য দু’টি ছোট ঘর। তাঁরা কোথায় থাকবেন। তাই দিনে চলাচলের জন্য যে শেড রয়েছে, সন্ধের পর থেকেই গামছা পেতে, ব্যাগ রেখে সেই জায়গা ঘেরা শুরু। রাত হলে সেখানেই চাদর পেতে বা মেঝেতে খবরের কাগজ পেতে শুয়ে পড়া। কিন্তু সেখানেও ওঁৎ পেতে রয়েছে দুষ্কৃতীর দল। রোগীর আত্মীয় সেজে তারাও সেখানে শুয়ে যায়। ঘাপটি মেরে চুপ করে পড়ে থাকে। আবার কখনও ঘুমিয়ে পড়েছেন বোঝাতে অনেক সময় নাকও ডাকেন। কিছুক্ষণ পর প্রকৃত রোগীর আত্মীয়রা ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে পারলেই টাকা, মোবাইল, ঘড়ি নিয়ে চম্পট।

খড়্গপুর লোকাল থানা এলাকার সাঁকোয়া গ্রামের নকুল মাইতির কথায়, “পাড়ার একটি ছেলের মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় পা ভেঙে যায়। পড়িমরি করে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। সকালে রোগীর পরিস্থিতি দেখেই বাড়ি ফিরব ঠিক করেছি। আমরা তিন জন এসেছিলাম। রাতে হাসপাতালেই গামছা পেতে শুয়েছিলাম। আমাদের কাছেই এক জন এসে শোয়। আমরা কিছুক্ষণ গল্প করছিলাম। কিন্তু তাকে দেখলাম শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। পরে আমরাও ঘুমিয়ে পড়ি। হঠাৎ পাশ ফিরতে গিয়ে দেখি যে ব্যাগে মাথা দিয়ে শুয়েছিলাম ব্যাগটি নেই। তাতেই টাকা, ঘড়ি, মোবাইল রেখেছিলাম। যাতে কেউ না নিয়ে পালাতে পারে তাই মাথা দিয়ে শুয়েছিলাম। পরে দেখি, সেই লোকটাও নেই!”

চুরির কথা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কানেও তা পৌঁচেছে। হাসপাতালে থাকা পুলিশ ফাঁড়িও সবই জানে। তা সত্ত্বেও নিরুত্তর প্রশাসন। হাসপাতাল সুপার যুগল কর বলেন, “হাসপাতালে অনেকে তাঁদের অসুস্থ আত্মীয়দের দেখতে আসেন। তাঁদের মধ্যে প্রকৃতই কার আত্মীয় হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন, তা বোঝা মুশকিল। তাছাড়া পর্যাপ্ত সংখ্যায় নিরাপত্তারক্ষী না থাকায় আমাদের সমস্যা হয়।”

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

suman ghosh medical college theft
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE