Advertisement
১০ মে ২০২৪
এসএসকেএম

কর্তৃপক্ষের আশ্বাসই সার, অবাধে চলছে দালালরাজ

দিন কয়েক আগেই স্বাস্থ্য দফতরের শীর্ষকর্তারা হাসপাতালে এসে বলেছিলেন, তাঁরা দালালরাজ রুখে দিয়েছেন। রুখে দিয়েছেন হাসপাতাল চত্বরে ফুলেফেঁপে ওঠা প্রতারণা চক্রও। তার পরে দু’সপ্তাহও গড়াল না, এসএসকেএমে এসে নিজেদের সঞ্চয় হারাল পশ্চিম মেদিনীপুরের এক হতদরিদ্র পরিবার।

সোমা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:৩১
Share: Save:

দিন কয়েক আগেই স্বাস্থ্য দফতরের শীর্ষকর্তারা হাসপাতালে এসে বলেছিলেন, তাঁরা দালালরাজ রুখে দিয়েছেন। রুখে দিয়েছেন হাসপাতাল চত্বরে ফুলেফেঁপে ওঠা প্রতারণা চক্রও। তার পরে দু’সপ্তাহও গড়াল না, এসএসকেএমে এসে নিজেদের সঞ্চয় হারাল পশ্চিম মেদিনীপুরের এক হতদরিদ্র পরিবার।

বুধবার সকালে এসএসকেএমের কার্ডিওথোরাসিক বিভাগের বাইরে এক ব্যক্তি দ্রুত অস্ত্রোপচার করিয়ে দেওয়ার টোপ দিয়ে ওই পরিবারের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা নিয়ে বেপাত্তা হয়েছে বলে অভিযোগ। ঘটনায় চরম অস্বস্তিতে পড়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালের অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র স্বীকার করে নিয়েছেন, দালাল এবং প্রতারকদের দৌরাত্ম্য এক চুলও কমানো যায়নি। প্রতি দিনই হাসপাতালে এসে ঠকে যাচ্ছেন কোনও না কোনও রোগী।

এই ধরনের উৎপাত সরকারি হাসপাতালে নতুন কোনও ঘটনা নয়। কখনও আউটডোরের টিকিট কেটে দেওয়ার নামে, কখনও ভিড়ে ঠাসা ওয়ার্ডে বেড পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি, কখনও আবার দ্রুত অস্ত্রোপচার করিয়ে দেওয়ার কথা বলে রোগী বা তাঁদের পরিজনদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে এই লোকেরা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের লক্ষ্য থাকে গ্রাম থেকে আসা মানুষ। শহরের বড় হাসপাতালে এসে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাওয়া মানুষদের পাশে এসে মিষ্টি কথা বলে সহজেই মন ভুলিয়ে দেয় এরা। তার পরেই টাকা আদায় করে চম্পট দেয়। এ ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনুমান।

পশ্চিম মেদিনীপুরের ডুমুরিয়ার বাসিন্দা নবীন পাত্র তাঁর একমাত্র সন্তানকে নিয়ে এ দিন সকালে এসেছিলেন এসএসকেএমে। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ থেকে তাঁদের কলকাতায় রেফার করা হয়েছে। নবীনবাবুর ছেলের খুব দ্রুত হার্টের একটি অস্ত্রোপচার প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন ডাক্তারেরা। এ দিন সকালে এসএসকেএমের কার্ডিওথোরাসিক বিভাগের আউটডোরে এসেছিলেন তাঁরা। তার পরেই এই বিপত্তি।

নবীনবাবু বলেন, “উপচে পড়া ভিড় দেখে থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম। সেই কোন সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। এতটা রাস্তা আসার ধকলে আমার ছেলেটা নেতিয়ে পড়ছিল। তাই ভাবছিলাম কোনও মতে যদি তাড়াতাড়ি দেখিয়ে ভর্তি করে নেওয়া যায়।” তাঁর অভিযোগ, এ রকম সময়েই এক জন মাঝবয়সী লোক এগিয়ে এসে তাঁদের সমস্যার কথা জানতে চায়। তার পরে ‘আমি সব ব্যবস্থা করে দেব’ বলে জানিয়ে তাদের কাছ থেকে ৫০০ টাকা নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে আরও দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে সেই লোকটি ফিরে আসে এবং জানায়, ওই দু’জনেই ডাক্তার। এসএসকেএমের পাশেই একটা হাসপাতালে তারা চলতি সপ্তাহেই অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করে দেবে। কিন্তু অগ্রিম বুকিংয়ের জন্য তখনই ২০ হাজার টাকা দিতে হবে।

নবীনবাবু বলেন, “লোকগুলো এমন ভাবে কথা বলছিল যে, মনে হয়েছিল সত্যিই ওরা ডাক্তার। রুগ্ণ ছেলেকে নিয়ে নাজেহাল হচ্ছি, তাই কোনও কিছু না ভেবেই টাকাটা দিয়েছিলাম। ওরা বলল, আধ ঘণ্টার মধ্যেই সব ব্যবস্থা হবে। কিন্তু চার ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরেও ওরা ফেরেনি।” ছেলের চিকিৎসার জন্য তিল তিল করে জমানো টাকা এ ভাবে জলে যাওয়ায় ভেঙে পড়েছেন ওই প্রৌঢ়। এত বড় একটা হাসপাতালে এমন অনিয়ম চলছে কী ভাবে, প্রশ্ন তোলেন ওই প্রৌঢ়। তাঁর বক্তব্য, এই অনিয়মের খবর কেউ রাখেন না, এমন হতে পারে না। তা হলে কেন কেউ এর প্রতিকারের ব্যবস্থা করেন না?

হাসপাতালের অধিকর্তা প্রদীপবাবু বলেন, ‘‘এই সব ঘটনা আমাদের মাথা হেঁট করে দিচ্ছে।” তাঁর আক্ষেপ, সরকারি হাসপাতালে নিখরচায় পরিষেবা বাড়ছে। কিন্তু তার মূল লাভটা সাধারণ মানুষ যত না পাচ্ছেন, তার চেয়ে বেশি পাচ্ছে এই দালাল এবং প্রতারকেরা। বহু মানুষই ঠকে যাওয়ার পরে সঠিক জায়গায় অভিযোগ না জানিয়ে কাঁদতে কাঁদতে নিজেদের বাড়ি ফিরে যান। ফলে মোট যত লোক ঠকেন, তার মধ্যে খুব কম সংখ্যকের কথাই সামনে আসে বলে জানিয়েছেন তিনি।

তিনি জানান, সাধারণ ওয়ার্ডে তো বটেই, এই চক্র আরও বেশি করে সক্রিয় আইটিইউ এবং ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটকে ঘিরে। তাঁর বক্তব্য, “কোনও কোনও ক্ষেত্রে রোগীর পরিবারের লোকেরা জেনেশুনেই এই চক্রের খপ্পরে পড়েন। কোনও বেসরকারি হাসপাতালে ভেন্টিলেশনে থাকা রোগীর জন্য হয়তো দিনে ১৫ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। বাড়ির লোকেরা সরকারি হাসপাতালে এনে খরচ কমাতে চাইছেন। দালালরা টোপ দিল, তারা ভেন্টিলেটরের বেড জোগাড় করে দেবে। কিন্তু তাদের প্রতি দিন পাঁচ হাজার টাকা করে দিতে হবে। রোগীর বাড়ির লোক দেখেন, অর্ধেকেরও কম খরচে হয়ে যাচ্ছে। তাই তাঁরাও রাজি হয়ে যান। এ ভাবেই ফুলেফেঁপে ওঠে এই অসাধু চক্র।” আবার কখনও কখনও টাকা নিয়ে কিছু না করে স্রেফ বেপাত্তা হয়ে যায়, এমন নজিরও অজস্র।

প্রশ্ন হল, কেন রোগীর বাড়ির লোকের অভিযোগ জানানোর উপরেই ভরসা করবেন তাঁরা? কেন নিজেরা উদ্যোগী হয়ে এই চক্র সমূলে উপড়ে ফেলতে উদ্যোগী হবেন না? হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এর উত্তরে সেই পুলিশের সঙ্গে যৌথ ভাবে নিয়মিত অভিযান চালানো এবং রোগীদের সচেতন করার গতে বাঁধা কথাই আরও এক বার বলেছেন। কিন্তু বাস্তবে সেই প্রয়াস কবে শুরু হবে, তা কেউ বলতে পারেননি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sskm soma mukhopadhyay tout-raj
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE