পেটে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে সন্ধিপুরের প্রতিমা ভুঁইয়া ছুটে এসেছিলেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। তবে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক কোথায়। ১০ শয্যার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভরসা কেবল ফার্মাসিস্ট! তিনিই যন্ত্রণা কমার একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে তাঁকে গ্রামীণ হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। গড়বেতা গ্রামীণ হাসপাতালেও অবস্থাটা একই। ৬০ শয্যার হাসপাতালে থিকথিক করছে রোগী। অথচ চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র তিন জন। তাই সেখানেও সমস্যা মিটল না। অতঃপর সোজা মেদিনীপুর। আর সরকারি হাসপাতালের উপর আস্থা রাখতে না পেরে শহরের এক বেসরকারি নার্সিংহোমে ভর্তি হলেন প্রতিমাদেবী।
প্রতিমাদেবীর কথায়, “কষ্ট হলেও বাধ্য হয়েই গড়বেতায় ছুটলাম। সেখানেও চিকিত্সকরা জানিয়ে দিলেন, মেদিনীপুর চলে যান। বাধ্য হয়ে ওই পরিস্থিতিতেই আসতে হয়েছিল। গ্রামীণ এলাকায় তো যেখানে সেখানে চিকিত্সক মেলে না।’’
গ্রামীণ এলাকায় মানুষের কাছে চিকিত্সা পরিষেবা পৌঁছে দিতেই তৈরি হয়েছিল প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে, উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র। এমনকি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে অন্তর্বিভাগ চালু হয়েছিল। সেখানে রোগী ভর্তি করার জন্য শয্যাও রয়েছে। কিন্তু চিকিত্সক না থাকায় পরিষেবা মেলে না। গ্রামীণ এলাকায় উন্নত চিকিত্সা পরিষেবা পৌঁছে দিতেই ডেবরা, শালবনি, গোপীবল্লভপুর, নয়াগ্রামের মতো গ্রামীণ এলাকায় সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রশ্ন উঠছে, শুধু হাসপাতাল তৈরি করেই কী আদৌ সমস্যার সমাধান হবে। পর্যাপ্ত চিকিৎসক না থাকলে পরিষেবা দেবে কে? এই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা।
বর্তমানে পশ্চিম মেদিনীপুর (ঝাড়গ্রাম মহকুমা বাদ দিয়ে) স্বাস্থ্য জেলায় চিকিত্সকের অবস্থাটা ঠিক কেমন?
পশ্চিম মেদিনীপুর স্বাস্থ্য জেলার মধ্যে মোট ২১টি ব্লক বা গ্রামীণ হাসপাতাল রয়েছে। আর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে ৫৭টি। যেখানে সব মিলিয়ে ২০৬ জন চিকিত্সক থাকার কথা। কিন্তু রয়েছেন মাত্র ১১৮ জন। ৮৮টি চিকিত্সকের পদ শূন্য! অর্থাত্ অর্ধেক পদই শূন্য বলা যায়। হাসপাতাল পিছু চিকিত্সক রয়েছেন গড়ে দেড় জন। পশ্চিম মেদিনীপুর স্বাস্থ্য জেলার এই সকল হাসপাতাল মিলিয়ে মোট ১ হাজার ৯৩টি শয্যা রয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত চিকিৎসক না থাকায় সুষ্ঠু পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
শুধু তাই নয়, বর্তমান ১১৮ জন চিকিৎসকের মধ্যে কয়েকদিনের মধ্যেই চার জন চিকিত্সক উচ্চশিক্ষার জন্য চলে যাবেন। আরও চার জন চিকিত্সক ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট-এর প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন। ফলে তাঁদেরও মহকুমা হাসপাতালে বদলির নির্দেশ এসে গিয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যে তাঁরাও চলে যাবেন। তখন কী হবে? জেলা স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তার কথায়, ‘‘আমরা বুঝতে পারছি এই চিকিত্সক সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে মানুষকে পরিষেবা দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদেরই বা কী করার রয়েছে।’’ এ ব্যাপারে জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরীশচন্দ্র বেরার সংক্ষিপ্ত জবাব, “বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।’’
শুধু চিকিৎসক নয়, নেই এর তালিকায় রয়েছে আরও গুরুত্বপূর্ণ পদও। পশ্চিম মেদিনীপুর স্বাস্থ্য জেলার ২১টি ব্লক বা গ্রামীণ হাসপাতালের মধ্যে ৭টিতে বিএমওএইচ নেই! এই হাসপাতালগুলিতে ১৬টি প্রসূতি বিশেষজ্ঞ, ১৫টি শিশু বিশেষজ্ঞ ও ৮টি অ্যানাস্থেটিস্টের পদও শূন্য পড়ে রয়েছে। অর্থাৎ প্রসূতির কোনও শারীরিক জটিলতা দেখা দিলে বা সদ্যোজাতের কোনও রোগ হলে গ্রামীণ হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে সমস্যায় পড়বেন রোগী ও তাঁর পরিজনেরা।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, পশ্চিম মেদিনীপুর স্বাস্থ্য জেলার ১৮টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই চিকিৎসক নেই। সেখানে ভরসা নার্স বা ফার্মাসিস্ট। অথচ, সেই সব স্বাস্থ্য কেন্দ্রেও কোথাও ১০টি, আবার কোথাও ৬টি শয্যা রয়েছে। তবে রোগী রাখা দূর অস্ত। সামান্য সর্দি, কাশি ছাড়া অন্য কোনও রোগের চিকিত্সা সেখানে মেলে না বললেই চলে। আবার কয়েকটি ক্ষেত্রে ব্লক হাসপাতাল থেকে সপ্তাহে এক দিন বা দু’দিন করে চিকিৎসকদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠানো হয়।
কেশপুর গ্রামীণ হাসপাতালে চিকিৎসক থাকার কথা ছ’জন। রয়েছেন মাত্র এক জন। কেশপুরের বাসিন্দা শেখ রবিউলের কথায়, “হাসপাতালে কী করতে যাব? একটু সমস্যা দেখলেই বলে দেবে মেদিনীপুরে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চলে যান। তাই ওখানে আর যাই না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy