ডেঙ্গি ধরা পড়েছে তিন দিন আগে। প্লেটলেট এক ধাক্কায় নেমে হয়েছে ১০ হাজার। ডাক্তাররা বলছেন, দ্রুত প্লেটলেট দিতে হবে। কিন্তু কোথাও পাননি বেলেঘাটার দীপন সরকারের পরিবারের লোকেরা। দু’দিন ধরে নমুনা নিয়ে এক ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে অন্য ব্যাঙ্কে ছুটতে গিয়ে নমুনা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু প্লেটলেট জোটেনি।
একই অবস্থা কামারহাটির মিনু দাসেরও। টানা দু’দিনের নিরন্তর চেষ্টায় তাঁর পরিবারের লোকেরা এক ইউনিট প্লেটলেট পেয়েছেন। কিন্তু দরকার আরও দুটি। কোথা থেকে, কী ভাবে জোগাড় করবেন তা ভেবে না পেয়ে দিশেহারা অবস্থা তাঁদের।
মহালয়া থেকেই পুজোর উদ্বোধন শুরু হয়ে গিয়েছে রাজ্যে। আর স্বাস্থ্যের মতো জরুরি পরিষেবার ক্ষেত্রেও কার্যত ছুটি শুরু হয়ে গিয়েছে অনেক আগে থেকেই। সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কের হাল তো খারাপ ছিলই, এমনকী বেসরকারি ব্যাঙ্কেও একই হাল। বিভিন্ন গ্রুপের রক্ত, বিশেষত প্লেটলেটের আকাল শুরু হয়েছে। ডেঙ্গির প্রকোপ বাড়তে থাকায় প্লেটলেটের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। তা না থাকায় সমস্যায় পড়ছেন অনেকেই। একে তো রক্তদান শিবিরের সংখ্যা কমতে কমতে তলানিতে ঠেকেছে। তার ওপরে যে টুকু সংগ্রহ হচ্ছে, তার ক্ষেত্রেও উপাদান বিভাজনে নানা ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। ডোনার নিয়ে গিয়েও প্লেটলেট জোগাড় করতে পারছেন না অনেকে। খোঁজ নিতে গেলে জানা যাচ্ছে রক্ত থেকে উপাদান পৃথক করার কাজ মাঝেমধ্যেই থমকে থাকছে অনেকগুলি ব্যাঙ্কেই।
প্লেটলেট সংগ্রহ করতে হলে রক্ত সংগ্রহের চার ঘন্টার মধ্যে উপাদান পৃথকীকরণ করে প্লেটলেট আলাদা করে তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হয়। অভিযোগ, পুজোর মরশুমে সেই ‘ঝক্কি’ পোহাতে চাইছেন না অনেকেই।
স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা জানান, কিছু ক্ষেত্রে রক্ত নেওয়ার পর তা থেকে রক্তের তিনটি উপাদান পৃথক করা হয়। প্যাকড সেল, ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা এবং প্লেটলেট। একে বলে ট্রিপল ব্যাগ সিস্টেম। আর কিছু ক্ষেত্রে শুধু প্যাকড সেল ও প্লাজমা পৃথক করা হয়। একে বলে ডবল ব্যাগ সিস্টেম। বেশিরভাগ ব্লাড ব্যাঙ্কই এখন ডবল ব্যাগের দিকে ঝুঁকছে। চলতি মাসে ১৭ তারিখ পর্যন্ত কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ব্লাড ব্যাঙ্কে ১৯টি ক্যাম্পে ১৪২০ জন রক্ত দিয়েছেন। এর মধ্যে ট্রিপল ব্যাগ মাত্র ৪৬০টি। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের ব্যাঙ্কে ১৭টি ক্যাম্পে ১০২৫জন রক্ত দিয়েছেন। এর মধ্যে ট্রিপল ব্যাগ মাত্র ২৮৭টি। আরজিকর মেডিক্যাল কলেজে ১৭টি ক্যাম্প হয়েছে। রক্ত দিয়েছেন ১১০১ জন। তার মধ্যে ট্রিপল ব্যাগ ২৮১টি । তাঁর কথায়, ‘‘এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে প্লেটলেট তৈরির ব্যাপারে আগ্রহ কতটা কম। যদিও প্লাজমা তৈরি হচ্ছে জোর কদমেই।’’
প্লাজমার ক্ষেত্রে উৎসাহ কেন? স্বাস্থ্য দফতরের ওই কর্তার কথায়, ‘‘একটি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে অতিরিক্ত প্লাজমা বিক্রির ব্যাপারে সরকারের চুক্তির পরেই এ ব্যাপারে উৎসাহ বেড়ে গিয়েছে। প্লাজমা তৈরি করছে বহু ব্লাড ব্যাঙ্ক। কিন্তু প্লেটলেটের ক্ষেত্রে কোনও উৎসাহই নেই। সরকারি তরফে কোনও নজরদারিই নেই।’’ বিষয়টি মেনে নিয়েছেন বিভিন্ন সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কের কর্তারা।
সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কের অধিকর্তা কুমারেশ হালদার বলেন, ‘‘প্লেটলেটের চাহিদা খুব বেশি। অন্য অনেক ব্যাঙ্ক থেকে প্লেটলেট না পেয়ে এখানে ভিড় জমাচ্ছেন অনেকে। চাহিদা আরও বাড়লে আমরা কী ভাবে সামাল দেব জানি না।’’
রক্তদান আন্দোলনের কর্মী দীপঙ্কর মিত্র বলেন, ‘‘পরিসংখ্যান দিয়ে অনেকেই হয়তো প্রমাণ করে দেবেন যে রক্তের জোগান ঠিকঠাক রয়েছে। কিন্তু আদতে ছবিটা খানিকটা আলাদা। রক্ত কিছুটা পাওয়া যাচ্ছে। রক্তের উপাদান বিভাজন থমকে থাকায় মানুষের বিপন্নতা কমছে না। সরকারি তরফে নজরদারিও নেই। সব মিলিয়ে মানুষের ভোগান্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে। বার বার দাবি করা সত্ত্বেও রক্ত পৃথকীকরণের ক্ষেত্রে যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছে না স্বাস্থ্য দফতর।’’
কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজের ব্লাড ব্যাঙ্কের কর্তা জানান, নিয়ম অনুযায়ী রক্ত সংগ্রহের পরে তা স্টোরেজের আগেই উপাদান পৃথক করতে হয়। কিন্তু বহু সময়েই সেটা হচ্ছে না। কম্পিউটারে পৃথকীকরণের হিসেব থাকছে, কিন্তু আদতে তা হচ্ছে অনেক পরে। তিনটি উপাদান পৃথকের পরিবর্তে বহু সময়েই দুটি উপাদান পৃথক হচ্ছে। এই ফাঁকিবাজির জেরে নাভিশ্বাস উঠছে সঙ্কটজনক রোগীদের।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy