Advertisement
E-Paper

পরিজনদের আস্থা কুড়িয়েই দালালরাজ

হাসপাতালে রোগী নিয়ে অ্যাম্বুল্যান্স ঢুকলেই এগিয়ে আসছে সাহায্যের হাত। রোগীর আত্মীয়ের বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তাঁদের সর্বস্বান্ত করছেন একদল দুষ্কৃতী। পাশাপাশি মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সক্রিয় দালাল চক্রও। খোঁজ নিয়ে দেখল আনন্দবাজার। (শেষ কিস্তি)চুরি তো রয়েছেই। তার সঙ্গে মেদিনীপুর মেডিক্যালে সক্রিয় দালাল চক্রও। সেই চক্রে পড়ে নি:স্ব হয়ে যাচ্ছেন অনেকেই। কিছু ক্ষেত্রে কিছু টাকার বিনিময়ে হয়তো নিখরচার পরিষেবা মিলছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে টাকা নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে দুষ্কৃতীরা। যত দিন যাচ্ছে এই চক্রটি ততই সক্রিয় হয়ে উঠছে। এদের রোগীদের প্রভাবিত করার কৌশলও অভিনব।

সুমন ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৪ ০১:৩৯

চুরি তো রয়েছেই। তার সঙ্গে মেদিনীপুর মেডিক্যালে সক্রিয় দালাল চক্রও। সেই চক্রে পড়ে নি:স্ব হয়ে যাচ্ছেন অনেকেই। কিছু ক্ষেত্রে কিছু টাকার বিনিময়ে হয়তো নিখরচার পরিষেবা মিলছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে টাকা নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে দুষ্কৃতীরা। যত দিন যাচ্ছে এই চক্রটি ততই সক্রিয় হয়ে উঠছে। এদের রোগীদের প্রভাবিত করার কৌশলও অভিনব। প্রথমেই রোগীকে কিছুটা সাহায্য করে রোগীর আত্মীয়দের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেন তাঁরা। তারপর ধীরে ধীরে ঝুলি থেকে একটি একটি করে বিড়াল বের হতে শুরু করে। আর তাতেই নি:স্ব হন রোগীর আত্মীয়েরা।

প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে নানা ধরনের সমস্যা নিয়ে মেডিক্যাল কলেজে হাজির হন রোগী। সঙ্গে থাকেন তাঁদের আত্মীয়েরা। কিন্তু মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল চত্বরে কোনদিকে কোন বিভাগ, কোথায় ওষুধ পাওয়া যায়, কোথায় পরীক্ষাগার-এসব খুঁজতে গিয়ে জেরবার হন সকলেই। তার সঙ্গে কোনও ঠকবাজের পাল্লায় পড়ে গিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার ভয়ও থাকে। এই সুযোগেই ধোপদুরস্ত কেউ গিয়ে হাজির হন। অনেকেই গিয়ে বলেন, “প্রেসক্রিপশন দিন। ওষুধ এনে দিচ্ছি। আপনারা রোগীর কাছে থাকুন। রোগীকে ছেড়ে গেলে সমস্যা।” বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করার জন্য তাঁরা টাকা না নিয়েই চলে যান। সম্পূর্ণ ওষুধ কিনে নিয়ে আসেন। সঙ্গে বিল। বিল দেখে টাকা দেন রোগীর আত্মীয়। না, কোনও কারচুপি হয়নি। এক্ষেত্রে ওই চক্রটির সঙ্গে ওষুধ দোকানের সম্পর্ক রয়েছে। ওই দোকান থেকে ওষুধ কিনলে ১২ শতাংশ ছাড় পাবে ওই চক্রের সদস্যরা। হাজার টাকার ওষুধে দু’পা হেঁটে ১২০ টাকা রোজগার! এ ভাবে দিনে ১০টি রোগী জোগাড় করতে পারলে ১২০০ টাকা আয়। এখানেই শেষ নয়, অনেক রোগীর রক্ত পরীক্ষা, এক্সরে, ইউএসজি করার দরকার হয়। নিখরচায় হাসপাতালে তা মিলতে পারে। আবার কিছু ক্ষেত্রে সামান্য টাকা লাগে। ঝক্কি এড়িয়ে আগে করিয়ে দেব বলেও পরীক্ষা পিছু ২০ টাকা থেকে ৫০ টাকা নিয়ে নেয় ওই চক্রের সদস্যরা। ফেরার সময় কম টাকায় অ্যাম্বুল্যান্স করে দেব বলেও ১৫০-২০০ টাকা রোজগার করে তাঁরা। ফলে এক জন রোগী পাওয়া গেলে ওষুধ কিনে দেওয়া, পরীক্ষা করানো থেকে বাড়ি ফেরার জন্য অ্যাম্বুল্যান্স-আয় হয় বালই। আবার গুরুতর অসুস্থ রোগী হলে তো কথাই নেই, একটানা ওষুধ চলবেই-ফলে রোজগারও চলবে।

এ ক্ষেত্রে অবশ্য রোগীর আত্মীয়দের তেমন কোনও ক্ষতি হয় না। কিছু অতিরিক্ত টাকা যায়। কিন্তু ক্ষেত্রে চুড়ান্ত সমস্যায় পড়তে হয়। হঠাত্‌ রোগীর জীবনদায়ী ওষুধ প্রয়োজন। চরম দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছেন রোগীর আত্মীয়েরা। রোগীর সঙ্গে শুরু থেকেই থাকা দালাল চক্রের সদস্যটি ওষুধ কেনার জন্য টাকা নিয়ে গেলেন। রোগীর আত্মীয়েরা পথ চেয়ে রয়েছেন, এই বুঝি ওষুধ নিয়ে এলো। কিন্তু আর তাঁর দেখা মেলে না। একদিকে রোগীকে সময়ে ওষুধ বা ইঞ্জেকশন দেওয়া গেল না, উল্টো দিকে টাকাও গেল। ফলে রোগী ও আত্মীয়দের হেনস্থার শেষ নেই। অনেক সময় দালাল চক্রের নির্দিষ্ট করা অ্যাম্বুল্যান্সে করেই রোগীকে নিয়ে যেতে বাধ্যও করা হয়। প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আসা রোগী বা তাঁর আত্মীয়েরা প্রতিবাদ করতে সাহসও দেখান না। যদি তাঁরা আরও কিছু ক্ষতি করে বসে, এই আশঙ্কায়। গোয়ালতোড়ের জিরাপাড়ার বাসিন্দা সনত্‌ মাহাতোর কথায়, “আমার গ্রামে যেতে বড় জোর দেড় হাজার টাকা থেকে ১৭০০ টাকা লাগার কথা। সেখানে অ্যাম্বুল্যান্সে যেতে ২১০০ টাকা লাগল।” এক অ্যাম্বুল্যান্স মালিকের কথায়, “দালালেরা ৩০০-৪০০ টাকা চায়। সেই টাকা আমরা তো রোগীর কাছ থেকেই তুলব, এ ছাড়া আমাদের আর উপায় কী। তাই কিছুটা ভাড়া বেশি নিতে হয়।”

এ সব দেখার জন্য রয়েছে হাসপাতালের নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষী, রয়েছে পুলিশ ফাঁড়িও। এমনকী রোগী সহায়তা কেন্দ্রও রয়েছে। যেখানে মাঝে-মধ্যে গিয়ে বসেন পুরসভার তৃণমূল কাউন্সিলর মৌ রায়ও। তবু দালাল চক্রের রমরমা বন্ধ করা যায়নি। পুলিশের বক্তব্য, “আমাদের কাছে সাহায্য চাইলে আমরা ঠিক পথ বাতলে দিতে পারি। অনেক সময় নিজেরাও উদ্যোগী হয়ে পথ বলে দিই। কিন্তু সব সময় তো সম্ভব হয় না। অনেক সময় দালালের পাল্লায় পড়েছে বুঝে রোগীর আত্মীয়দের সাবধান করেছি। দালালকে ধমকও দিয়েছি। তখন পাল্টা রোগীর আত্মীয়দের কাছ থেকে ধমক শুনেছি যে, একজন আমাকে সাহায্য করছেন, আপনি বাধা দিচ্ছেন। দালালেরা এমন ভাবে রোগীর আত্মীয়দের বুঝিয়ে দেয় যে তেমন কিছু করার থাকে না। আর কেউ না অভিযোগ করলে আমরা কী বা করতে পারি।” আর হাসপাতাল সুপার যুগল করের কথায়, “এটা ঠিক যে সর্বত্র কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়নি। তাছাড়াও কে রোগীর আত্মীয়, কে নয়, তা আমরা বুঝব কী করে। কেউ অভিযোগ করলে তখন না হয় ব্যবস্থা নেওয়া যায়।” আর নিরাপত্তারক্ষীদের কথা তো বলারই নয়। একবার কয়েকজনকে বাধা দিতে গিয়ে নিরাপত্তারক্ষীই মার খেয়ে আহত হয়েছিলেন। তাঁদের কথায়, “আমরা তো চেষ্টা করি। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি এমন যে, বেশি বাধা দিতে গেলে আমাদেরই মার খেতে হচ্ছে। তাই চুরি আর দালালচক্র বেড়েই চলেছে।” কাউন্সিলর মৌ রায়ের কথায়, “আমরা সর্বক্ষণ চেষ্টা করি যাতে কেউ এই চক্রের পাল্লায় না পড়েন। কিন্তু অনেক সময় তো রোগীরা সাহায্যের জন্য আমাদের কাছে আসেই না। সেক্ষেত্রে আমাদের কী করার রয়েছে।”

দালাল চক্রের হাত থেকে কি নিষ্কৃতি নেই? সদুত্তর নেই কারও কাছে।

suman ghosh medinipur medical college
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy