Advertisement
১০ মে ২০২৪

রেফার-রোগে ভোগান্তি চরমে

লছিমনের ধাক্কায় আহত হন রানিনগরের বাসিন্দা পারুলা বিবি। দুর্ঘটনার পরেই ওই মহিলাকে ভর্তি করানো হয় রানিনগর ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। কিন্তু ওই রাতেই চিকিৎসক তাঁকে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ‘রেফার’ করে দেন। অস্বচ্ছল ওই পরিবারটি মঙ্গলবার সকালে ধারদেনা করে গাড়ি করে নিয়ে এসে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির বন্দোবস্ত করেন।

‘রেফার’ রোগীকে অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছেন আত্মীয়রা। —নিজস্ব চিত্র।

‘রেফার’ রোগীকে অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছেন আত্মীয়রা। —নিজস্ব চিত্র।

শুভাশিস সৈয়দ ও সুজাউদ্দিন
বহরমপুর ও ডোমকল শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:৫৫
Share: Save:

লছিমনের ধাক্কায় আহত হন রানিনগরের বাসিন্দা পারুলা বিবি। দুর্ঘটনার পরেই ওই মহিলাকে ভর্তি করানো হয় রানিনগর ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। কিন্তু ওই রাতেই চিকিৎসক তাঁকে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ‘রেফার’ করে দেন। অস্বচ্ছল ওই পরিবারটি মঙ্গলবার সকালে ধারদেনা করে গাড়ি করে নিয়ে এসে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির বন্দোবস্ত করেন। ওই মহিলার বাবা তুফানি শেখ বলেন, “হাসপাতালে ভর্তি করানোর পরে বিনা চিকিৎসায় দীর্ঘক্ষণ পড়েছিল মেয়ে। রাতের দিকে চিকিৎসক এসে কোনও রকমে রোগীকে দেখলেন কি দেখলেন না, বহরমপুরের হাসপাতালে রেফার করে দেন।”

অন্যদিকে ডোমকলের নবিপুরের সাকিনা খাতুন গলায় দড়ির ফাঁস দিয়ে ও জলঙ্গির কাজিপাড়ার রাফিজা বিবি কীটনাশক খেয়ে আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁদেরও উদ্ধার করে নিয়ে এসে ভর্তি করা হয় রানিনগর ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। কিন্তু ভর্তির কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তাঁদের মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ‘রেফার’ করে দেওয়া হয়। ওই দুই পরিবারের তরফে নাসিরুদ্দিন শেখ, কামাল হোসেনরা জানান, হাসপাতালের চিকিৎসকদের প্রবণতা হলো বহরমপুরের হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া। যে রোগীর চিকিৎসা স্থানীয় হাসপাতালে হতে পারে, তাকেও পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে রোগীর বাড়ির আর্থিক দিকটুকুও সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করে দেখা হয় না।

একই ভাবে গত সপ্তাহে ডোমকলের আবদুর রাজ্জাক, সেলিনা বিবি, মঞ্জুরা খাতুনকে ডোমকল মহকুমা হাসপাতাল থেকে ‘রেফার’ করে দেওয়া হয় ওই মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ফলে ‘রেফারেল’ রোগীর চাপ বাড়ছে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও। তাতে সুষ্ঠ চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও।

এমনিতেই ২০১২ সালে বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চালু হওয়ার পরেই সেখানে যেমন রোগী ভর্তির চাপ বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশাও। এখন প্রয়োজনের তুলনায় বাড়তি রোগী ভর্তি করে প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হলে সমালোচনার মুখে পড়তে হবে বলেও আশঙ্কা কর্তৃপক্ষের।

কর্তৃপক্ষ সীমিত পরিকাঠামোর মধ্যে দাঁড়িয়ে সুষ্ঠ চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার পক্ষে। অথচ জেলার বিভিন্ন গ্রামীণ হাসপাতাল, প্রাথমিক ও ব্লক-প্রাথমিক হাসপাতাল, মহকুমা হাসপাতাল থেকে পাঠানো রোগীর চাপ সামাল দিতে দিশেহারা অবস্থা।

সমস্যা খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য গত বছর অক্টোবরে জেলা মুখ্যস্বাস্থ্য আধিকারিকের কাছে চিঠি পাঠায় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্যভবনের বিভিন্ন আধিকারিক ও জেলাশাসককেও চিঠি দেওয়া হয়।কিন্তু এত কিছু করেও অবস্থার কোনও পরিবর্তন ঘটানো যায়নি বলে অভিযোগ। ফলে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ফের গত ২৪ ডিসেম্বর ওই সংক্রান্ত চিঠি পাঠায়। ওই চিঠিতে উল্লেখ রয়েছেগত ২১-২৩ ডিসেম্বর তিন দিনে রোগী রেফার করা হয়েছে যথাক্রমে ৯৫, ১১৯ ও ১০৯ জন। ফলে ২০০ বেডের মাতৃসদনে রোগী ও সদ্যোজাতদের সঠিক চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রেও খামতি থাকছে। এ প্রসঙ্গে মুর্শিদাবাদের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সুমিত গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “কিছু ক্ষেত্রে হয়তো দায়িত্ব এড়াতেই বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে রোগী রেফার করে দেওয়া হচ্ছে। কোনও কোনও রোগীর ক্ষেত্রে হয়তো কী ধরণের চিকিৎসা দেওয়া উচিত, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারার কারণেও রেফার হচ্ছে। তবে গোটা বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

জেলার বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে ওই রোগী পাঠানোর বিষয়টি নিয়ে গত নভেম্বরে ‘রোগী কল্যাণ সমিতির’ বৈঠকেও আলোচনা হয়েছে। মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে পাঠানো রেফারেল কার্ডে অনেক সময়ে রোগী পাঠানোর কারণও উল্লেখ থাকে না। ফলে কিছু না লিখেই রোগী পাঠানো হয়। কোনও ক্ষেত্রে লেখা হয়রোগীর বাড়ির চাপে। ওই সব দেখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ধারণা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের চিকিৎসকরা ওই রোগীদের দায়িত্ব নিতে চাননি বলেই ইচ্ছাকৃত ভাবে বহরমপুরে পাঠিয়ে দেন।

মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজের এক চিকিৎসকের কথায়, “রোগীদের রেফারেল কার্ডে কারণ হিসেবে এমন কোনও জটিল রোগের কথার উল্লেখ নেই। যে কারণ দেখানো হয়েছে সেই চিকিৎসা পরিকাঠামো সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলিতে রয়েছে। রোগীর শারীরিক অবস্থা নিয়ে এমন কোনও কথা বলা হয়েছে, যাতে ভয় পেয়ে বাড়ির লোকজন রোগী বহরমপুরের হাসপাতালে পাঠানোর জন্য হয়তো বলেছে। সব মিলিয়ে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের চিকিৎসকরা ওই রোগীদের দায়িত্ব নিতে চাননি বলেই মনে হয়েছে।” ওই রকম ১১ জন রোগীর তথ্য চিঠিতে তুলে দেওয়া হয়েছে, যাদের সাধারণ রোগী বলে চিহ্নিত করেছে মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ। মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সুপার তথা সহ-অধ্যক্ষ মণিময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংক্ষিপ্ত জবাব, “সাধারণ রোগীদের স্বার্থে জেলার বিভিন্ন প্রান্তের হাসপাতাল থেকে রেফারেল রোগীর চাপ কমলে সুষ্ঠু পরিষেবা দেওয়া সম্ভব হবে।”

ডোমকল মহকুমা হাসপাতালের সুপার প্রবীর মাণ্ডি বলেন, “রোগীর শারীরিক অবস্থা একটু জটিল হলে এক শ্রেণির চিকিৎসক ঝুঁকি নিতে চান না, এটা খুব সত্যি কথা। তবে সামান্য কারণে যে ভাবে রোগীর বাড়ির লোকজন চড়াও হন, তাতে চিকিৎসকরা আতঙ্কিত। সকলেরই তো প্রাণের ভয় রয়েছে।” ওই হাসপাতালের চিকিৎসক বরুণ বিশ্বাস বলেন, “যতটা সম্ভব রেফার করে দিতে পারলে নিরাপদে থাকা যায়, এই ভাবনাও কাজ করে। ঝুঁকি নিলে সব সময়েই বিপদ থাকে। ওই বিপদ এড়াতেই রোগী রেফার করার প্রবণতা কাজ করে। তবে তা সব সময় নয়।” এ দিকে, রোগীর বাড়ির লোকজনের কথায়, এখন হাসপাতালে নিয়ে আসার পর থেকেই ওই রোগীকে দ্রুত রেফার করে দেওয়ার একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে হাসপাতাল জুড়ে। ফলে চিকিৎসক দেখার আগেই স্বাস্থ্যকর্মীরা বলতে থাকেন, ‘রেফারেল কেস’, হাসপাতাল চত্বরে বেসরকারি গাড়ির চালকরাও প্রস্তুত ওই ‘রেফারেল কেস’ নিয়ে যাওয়ার জন্য। সব মিলিয়ে ‘রেফারেল’ ভূত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় রোগীর আত্মীয়দের মধ্যে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

refer shubhashis sayed sujauddin
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE