Advertisement
০৩ মে ২০২৪
বিরল সমস্যা

রক্ত পরীক্ষায় পজিটিভ এলেও রোগীর শরীর চাইছে নেগেটিভ

জীবনের পঞ্চান্নতম বছরে পৌঁছে কানাই পাল জানতে পারলেন, পরীক্ষা করলে প্রতি বারই তাঁর রক্তের গ্রুপ আসবে ‘বি পজিটিভ’। কিন্তু তাঁর কখনও রক্তের প্রয়োজন হলে ‘বি পজিটিভ’ রক্ত দেওয়া যাবে না। দিতে হবে ‘বি নেগেটিভ’ রক্ত। আপাত ভাবে শুনলে আজগুবি মনে হতে পারে। যাঁর যা রক্তের গ্রুপ, প্রয়োজনে সেই গ্রুপের রক্তই তাঁকে দেওয়া নিয়ম।

হাসপাতালে কানাই পাল।

হাসপাতালে কানাই পাল।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৪ ০২:২৮
Share: Save:

জীবনের পঞ্চান্নতম বছরে পৌঁছে কানাই পাল জানতে পারলেন, পরীক্ষা করলে প্রতি বারই তাঁর রক্তের গ্রুপ আসবে ‘বি পজিটিভ’। কিন্তু তাঁর কখনও রক্তের প্রয়োজন হলে ‘বি পজিটিভ’ রক্ত দেওয়া যাবে না। দিতে হবে ‘বি নেগেটিভ’ রক্ত।

আপাত ভাবে শুনলে আজগুবি মনে হতে পারে। যাঁর যা রক্তের গ্রুপ, প্রয়োজনে সেই গ্রুপের রক্তই তাঁকে দেওয়া নিয়ম। কিন্তু রক্ত বিশেষজ্ঞরাই জানাচ্ছেন, কানাইবাবুর মতো কারও কারও ক্ষেত্রে এই নিয়মের বিরল ব্যতিক্রম হতে পারে। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ১-৪ শতাংশ মানুষের ক্ষেত্রে এমন দেখা যায়। রক্ত পরীক্ষায় তাঁদের যে গ্রুপ পাওয়া যায়, আদতে সেই গ্রুপের রক্ত তাঁদের শরীরে বাইরে থেকে দিলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। তাঁদের রক্তের সঙ্গে মেলে অন্য গ্রুপের রক্ত। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে গত ১৫ অক্টোবর থেকে ভর্তি কানাই পালও সেই মানুষদের এক জন।

মেডিক্যালের চিকিৎসকেরাই জানিয়েছেন, বছর পাঁচেক আগে ‘ক্রনিক লিম্ফোসাইটিক লিউকেমিয়া’ নামে রক্তের ক্যানসারে আক্রান্ত হন নবদ্বীপের কানাইবাবু। এই ধরনের ক্যানসার খুব একটা জটিল বা মারণ নয়। ওষুধ খেলে এবং কেমোথেরাপি করালে রোগী দীর্ঘ দিন ভাল থাকতে পারেন। কানাইবাবুর ৬টি কেমো নেওয়া হয়ে গিয়েছিল। তাঁর শরীর এমনিতে ভালই ছিল কিন্তু কেমোর প্রভাবে রক্তাল্পতা দেখা দেয়। কানাইবাবু প্রথমে গুরুত্ব দেননি। শেষে রক্তাল্পতা থেকে শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ায় তাঁকে বাড়ির কাছে একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকেরা পরীক্ষা করে দেখেন, তাঁর রক্তের গ্রুপ ‘বি পজিটিভ’ এবং হিমোগ্লোবিন সাড়ে তিনে নেমে গিয়েছে। ফলে তাঁকে রক্ত দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

কানাইবাবুর কথায়, “এর আগে জীবনে কখনও আমার রক্তের দরকার পড়েনি। ফলে আমার রক্তের এমন বিচিত্র বৈশিষ্ট্য জানা ছিল না। ডাক্তারবাবুরা আমাকে ২ ইউনিট ‘বি পজিটিভ’ রক্ত দেন। তার পরেও আমার শরীরের উন্নতি হয়নি, বরং শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। হাত-পা কাঁপতে থাকে, বিছানা থেকে ওঠার ক্ষমতা চলে যায়। তখন আমাকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে রেফার করা হয়।” মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকেরা পরীক্ষা করে দেখেন, দু’ইউনিট রক্ত নেওয়ার পরে উল্টে কানাইবাবুর হিমোগ্লোবিন আরও কমে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, তাঁর শরীরে রক্ত তৈরি হওয়ার পরেও রক্তের কোষ ভাঙতে শুরু করেছে। তখন বিশেষ পদ্ধতিতে রক্ত পরীক্ষায় দেখা যায়, কানাইবাবুর রক্ত হচ্ছে সেই বিরল গ্রুপের, যার সঙ্গে একই গ্রুপের রক্ত মিলবে না। বরং দিলে হিতে বিপরীত হবে।

কেন এমন হয়? এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাই বা কী? মেডিক্যাল কলেজে যাঁর কাছে কানাইবাবুর চিকিৎসা চলছে সেই অরুণাংশু তালুকদারের কথায়, “অত্যন্ত কম সংখ্যক মানুষের এমন হয়। কানাইবাবুর রক্ত পরীক্ষা করলে ‘বি পজিটিভ’ দেখাবে কিন্তু আসলে তা আংশিক ভাবে ‘বি পজিটিভ’। পুরোপুরি পজিটিভ হওয়ার জন্য লোহিত রক্তকণিকার গায়ে যত সংখ্যক পজিটিভ রিসেপ্টার থাকার কথা, কানাইবাবুর তা নেই। তাই বাইরে থেকে ‘বি পজিটিভ’ রক্ত দিলে কানাইবাবুর রক্তের সঙ্গে মিলবে না। ‘বি নেগেটিভ’ রক্ত দিতে হবে।”

রক্তবিশেষজ্ঞ প্রসূন ভট্টাচার্যের ব্যাখ্যায়, কানাইবাবুর মতো অতি অল্প সংখ্যক মানুষের দেহে নিজের গ্রুপের রক্তের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। তখন সেই গ্রুপের রক্ত তাঁদের দেওয়া যায় না। সাধারণত পজিটিভ গ্রুপের ক্ষেত্রেই এটা দেখা যায়। তখন তাঁদের ওই গ্রুপের নেগেটিভ রক্ত দিতে হয়। প্রসূনবাবু আরও জানান, সাধারণত যাঁদের বহু বার রক্ত দেওয়া হয়েছে, তাঁদের এ রকম শারীরিক অবস্থা তৈরি হয়। কিন্তু কানাইবাবুর ক্ষেত্রে তা হয়নি। তিনি জীবনে এই প্রথম রক্ত নিলেন। ফলে তাঁর কেসটি আরও বিরল।

আর এক রক্তবিশেষজ্ঞ মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য বলেন, “রক্তে আরএইচ ফ্যাক্টর নামে একটি জিনিস থাকে। এর ভিতর থাকে ‘ডি ফ্যাক্টর।’ এই ডি ফ্যাক্টরের তারতম্যের জন্যই রক্তের গ্রুপ এক রকম দেখায় কিন্তু আদতে সেই মানুষটিকে অন্য গ্রুপের রক্ত দিতে হয়।” তিনি আরও বলেন, “কারও দেহে এই অবস্থা থাকলে যতক্ষণ না তাঁর বাইরে থেকে রক্ত নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া হচ্ছে ততক্ষণ বোঝার উপায় থাকে না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE