Advertisement
০৫ মে ২০২৪

শর্তের মুঠি শিথিল, প্রশ্নের মুখে বঙ্গজ স্যালাইনের মান

সরকারি হাসপাতালের জন্য স্যালাইন আসত ভিন্ রাজ্য থেকে। তাতে খরচ হতো বেশি। এখন রাজ্যেরই বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে স্যালাইন কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য দফতর। কিন্তু তার জন্য শর্তাবলি শিথিল করা হয়েছে। আর তাতে স্যালাইনের মানের সঙ্গে আপস করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে খাস স্বাস্থ্য ভবনের বিরুদ্ধেই।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০১৪ ০২:০৩
Share: Save:

সরকারি হাসপাতালের জন্য স্যালাইন আসত ভিন্ রাজ্য থেকে। তাতে খরচ হতো বেশি। এখন রাজ্যেরই বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে স্যালাইন কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য দফতর। কিন্তু তার জন্য শর্তাবলি শিথিল করা হয়েছে। আর তাতে স্যালাইনের মানের সঙ্গে আপস করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে খাস স্বাস্থ্য ভবনের বিরুদ্ধেই।

স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে অবশ্য মান নিয়ে আপসের অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছেন। রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোলের অধিকর্তা চিন্তামণি ঘোষেরও একই মত। তাঁর দাবি, শিলিগুড়ির সোনাপুরের একটি সংস্থা কিছু দিন হল স্যালাইন উৎপাদন শুরু করেছে। উৎপাদন শুরু করতে চলেছে বেহালা, রিষড়া, বারাসত ও হরিপালের চারটি সংস্থা। শিলিগুড়ির সংস্থায় তৈরি স্যালাইনের নমুনা দু’-দু’বার পরীক্ষা করে সন্তোষজনক ফল পেয়েছে কেন্দ্রীয় ড্রাগ কন্ট্রোল। এ বার রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোলও তা পরীক্ষা করবে।

কিন্তু শর্ত শিথিলের অভিযোগের জবাব মিলছে না। আপসের প্রশ্ন উঠেছে সরকারেরই বেঁধে দেওয়া দু’বছর আগের শর্তাবলি নিয়ে। বাম আমলে ডিস্ট্রিবিউটরদের মাধ্যমে স্যালাইন কিনত সরকার। কিন্তু তাতে দুর্নীতি হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলে নতুন সরকার ব্যবস্থাটাই তুলে দেয়। ঠিক হয়, হিমাচলপ্রদেশ, গোয়া, তামিলনাড়ু, মধ্যপ্রদেশ, কর্নাটকের মতো রাজ্য থেকে স্যালাইন কেনা হবে। তার জন্য কিছু শর্ত স্থির করে দেন স্বাস্থ্যকর্তারা। সেই সব শর্তের মধ্যে আছে:

• যে-সব সংস্থা স্যালাইন উৎপাদন করবে, তাদের অন্তত তিন বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।

• বাজারে ওই সংস্থার পণ্যের চাহিদা, জনপ্রিয়তা ও সুখ্যাতি থাকতে হবে।

• সর্বোপরি বছরে অন্তত ১০ কোটি টাকার ব্যবসা থাকা চাই।

রাজ্যের সংস্থা থেকে স্যালাইন কেনার ক্ষেত্রে কিন্তু তিনটি শর্তই বদলে দেওয়া হয়েছে। নতুন শর্তাবলিতে বলা হয়েছে:

• তিনের জায়গায় উৎপাদনকারী সংস্থার এক বছরের অভিজ্ঞতা থাকলেই চলবে।

• বাজারে ওই সংস্থার পণ্যের পরিচিতি (‘মার্কেট প্রেজেন্স’) থাকাও জরুরি নয়।

• ওই সংস্থা বছরে কত টাকার ব্যবসা করে, তা দেখারই দরকার নেই। বিতর্ক এই শর্ত-বদল নিয়েই।

শর্ত শিথিল করা হচ্ছে কেন?

রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোলের কর্তাদের একটি অংশ বলছে, এর পিছনে কাজ করেছে নবান্নের চাপ। রাজ্যে নতুন শিল্প আসছে না বলে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা হচ্ছে। তাতে কিছুটা প্রলেপ দিতেই রাজ্যের সংস্থার তৈরি স্যালাইন নেওয়ার সিদ্ধান্ত। এটা শুরু হলে স্যালাইনের বোতল এবং বিভিন্ন ‘ইনজেক্টেবল’ পদার্থ তৈরির কারখানা হতে পারে।

সেখানে কিছু লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে।

অন্য একটি অংশ প্রশ্ন তুলেছে, দরপত্রে শর্তাবলির কড়াকড়িটাই স্যালাইনের মানের রক্ষাকবচ। উৎপাদনে তিন বছরের অভিজ্ঞতা থাকা বা বাজারে সংশ্লিষ্ট সংস্থার স্যালাইনের চাহিদার শর্ত দেওয়া মানে পণ্যের গুণগত মান সুনিশ্চিত করা। রাজ্যের সংস্থার ক্ষেত্রে সেই বাধ্যবাধকতা তুলে দিলে স্যালাইনের মান ঠিক রাখা যাবে কী ভাবে?

অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন সরকারি চিকিৎসকদের সংগঠন হেল্থ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন সভাপতি সঞ্জীব মুখোপাধ্যায় ও সার্ভিস ডক্টর্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সজল বিশ্বাস। তাঁরা জানান, নব্বইয়ের দশকে রাজ্যেই একটি-দু’টি স্যালাইন কারখানা ছিল। কিন্তু তাদের স্যালাইন সরকারি হাসপাতালে ব্যবহার করে স্বাস্থ্য দফতর প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে। তখন খারাপ মানের স্যালাইন, ফাঙ্গাস-ধরা স্যালাইন সরবরাহের ভূরি ভূরি অভিযোগ উঠত। পরে সেই সব কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। সঞ্জীববাবু ও সজলবাবুর প্রশ্ন, “এ বারেও যে তা হবে না, সেই নিশ্চয়তা কোথায়?”

আবার অনেকের প্রশ্ন, নিছক কিছু লোককে পাইয়ে দেওয়ার জন্যই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি তো? জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মী পুণ্যব্রত গুণ বলেন, “স্যালাইন সরাসরি রোগীর রক্তে মেশে। তাই পরিচিতিহীন সংস্থা থেকে তা না-কিনে রাজ্যের নতুন সংস্থাগুলিকে সুনাম তৈরির জন্য কিছুটা সময় দেওয়া দরকার।” তাঁর প্রশ্ন, নিজেদের হাতে থাকা রুগ্ণ ওষুধ সংস্থা বা ব্লাডব্যাগ সংস্থার পরিকাঠামো ব্যবহার করে সরকারই স্যালাইন তৈরি করছে না কেন? কেন আনকোরা সংস্থার স্যালাইন কিনে মান জলাঞ্জলি দেওয়ার অস্বাস্থ্যকর সুযোগ রেখে দেওয়া হচ্ছে?

মানের সঙ্গে আপসের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে সরকারি কর্তাদের যুক্তি, নতুন সংস্থার ক্ষেত্রে প্রথম এক বছর রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোলের অফিসারেরা মাসে এক বার কারখানা পরিদর্শন করেন। উৎপাদিত পণ্যের মানের উপরে লাগাতার নজরদারি চালানো হয়। এ ক্ষেত্রেও তা-ই হবে। ওই সংস্থাগুলির তৈরি স্যালাইনের নমুনা মাঝেমধ্যেই পরীক্ষা করতে পাঠানো হবে ল্যাবরেটরিতে। কেউ বেচাল করলে বরাত বাতিল করে দেওয়া হবে। কিন্তু নজরদারি বা নমুনা পরীক্ষা করার মতো পরিকাঠামো আছে কি না, তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।

রাজ্যে যাঁরা স্যালাইন তৈরির কারখানা খুলতে চলেছেন, সেই সুভাষ মণ্ডল, সুযশ অগ্রবাল, মনোজ গুপ্তদের বক্তব্য, পণ্যের মান খারাপ করে অযথা ব্যবসার ক্ষতি করতে চান না কেউই। কোটি কোটি টাকা লগ্নি করে তাঁরা ব্যবসায় নামছেন। এর বেশিটাই ব্যয় করা হচ্ছে স্যালাইনের স্টেরিলিটি বজায় রাখার অত্যাধুনিক যন্ত্র কিনতে। উন্নত মানের স্যালাইন জোগান দেওয়াই তাঁদের লক্ষ্য বলে জানান সুভাষ-সুযশ-মনোজেরা।

আর স্বাস্থ্যকর্তাদের বক্তব্য, সরকারি হাসপাতালের জন্য বছরে প্রায় এক কোটি ২০ লক্ষ বোতল সাধারণ স্যালাইন, প্রায় এক কোটি বোতল রিঙ্গার ল্যাকটেট এবং ৪০ লক্ষ বোতল ইনজেক্টেবলস লাগে। এই খাতে বছরে খরচ হয় ৭০-৯০ কোটি টাকা। ভিন্ রাজ্যের স্যালাইন কিনতে গিয়ে বছরে শুধু পরিবহণ খাতেই ২৫ থেকে ৩৫ কোটি টাকা খরচ হয়ে যায়। রাজ্যের সংস্থায় উন্নত মানের স্যালাইন উৎপাদন হলে সেই খরচ বাঁচানো যাবে। অনেক ক্ষেত্রে সময়মতো স্যালাইন না-পৌঁছনোয় যে-সমস্যা দেখা দেয়, তা-ও হবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE