সরকারি হাসপাতাল থেকে ‘পেয়িং বেড’ তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে স্বাস্থ্য দফতর। এই ‘অভিনব’ সিদ্ধান্তের পিছনে মূলত অর্থনৈতিক কারণই রয়েছে, এমনটাই জানাচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্তারা। তাঁদের বক্তব্য, জেলা হাসপাতাল থেকে শুরু করে মেডিক্যাল কলেজ সর্বত্রই ‘ফ্রি বেড’-এর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালের আয় এমনিতেই অনেক কমে গিয়েছে। তাই সামান্য কিছু পেয়িং বেড না রেখে সব শয্যাকেই ধাপে ধাপে ‘ফ্রি’ করে দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। এতে কেন্দ্রের নানা প্রকল্পের খাত থেকে সরকারি কোষাগারে যা টাকা আসবে, তা বর্তমান আয়ের চেয়ে বেশি।
স্বাস্থ্যকর্তাদের বক্তব্য, এক দিকে হাসপাতালে ফ্রি শয্যা জোগাড়ের জন্য বহু ক্ষেত্রেই দালালের খপ্পরে পড়ছেন রোগীরা। শয্যা পাইয়ে দেওয়ার নাম করে দালালেরা টাকা আদায় করছে। ফলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি একটা পর্যায় পর্যন্ত থেকেই যাচ্ছে। অন্য দিকে, জন-প্রতিনিধিরা যথেচ্ছ ফ্রি সার্টিফিকেট বিলোচ্ছেন। ফলে ফ্রি বেডের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে যে জায়গায় পৌঁছেছে, তাতে সরকারি হাসপাতাল থেকে আয়ের পরিমাণ প্রায় তলানিতে। স্বাস্থ্যকর্তারা মনে করছেন, এর চেয়ে ভর্তির প্রক্রিয়াটা পুরোপুরি নিখরচায় হলে এক দিকে যেমন সাধারণ মানুষ উপকৃত হবেন, সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে, তেমনই কেন্দ্রের নানা প্রকল্পের সুবাদে ভাঁড়ারে টাকাও জমা হবে।
কিছু দিন আগেই প্রাথমিক স্তরে সব রোগীকে নিখরচায় ওষুধ দেওয়া এবং নিখরচায় যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা করার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল সরকারের তরফে। রাজ্যের স্বাস্থ্য মানচিত্রে নতুন একটা অধ্যায়ের সংযোজন হয়েছিল সে দিন। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, সেই সময়েই পেয়িং বেড তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা শুরু হয়। কিন্তু এই ধরনের কোনও সিদ্ধান্ত রাতারাতি হয় না। সেই কারণেই একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। সেই কমিটিই সমস্ত হাসপাতালের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে কোথায় কত পেয়িং এবং ফ্রি বেড রয়েছে, তার তালিকা তৈরির কাজ শুরু করে। সেই কাজ অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে।
স্বাস্থ্য-সচিব মলয় দে জানিয়েছেন, প্রথম ধাপে তাঁরা পেয়িং বেড পুরোপুরি তুলে না দিয়ে ফ্রি বেডের সংখ্যা অনেকটা বাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে পরবর্তী স্তরে পেয়িং বেড পুরোপুরি তুলে দেওয়া হবে বলেই স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর। স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তার কথায়, “উপার্জনের পরিমাণ তো খুবই কম। কারণ ফ্রি শয্যার সংখ্যাই বেশি। আর ফ্রি শয্যায় ভর্তি হলে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও নিখরচায় হয়ে যায়। তাই উপার্জন বিশেষ কিছু হয় না। এর চেয়ে ফ্রি বেডের সংখ্যা বাড়ালে গরিব মানুষের চিকিৎসায় কেন্দ্রীয় নানা প্রকল্প থেকে টাকা পাবে রাজ্য। তাতে আয়ের পরিমাণ কিছুটা বাড়বে।”
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, বর্তমানে সমস্ত সরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে সরকারের কোষাগারে বছরে জমা হয় প্রায় ২০ কোটি টাকা। কিন্তু পরিকাঠামো নির্মাণ ও অন্যান্য খাতে খরচ হয় বিপুল পরিমাণ অর্থ। আয়-ব্যয়ের এই বৈষম্যই দূর করতে আগ্রহী রাজ্য সরকার। স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “প্রাথমিক ভাবে ঠিক হয়েছে, শুধু কেবিন বাদে সমস্ত শয্যা ফ্রি করে দেওয়া হবে। এমনিতেই হাসপাতালগুলোর যা অবস্থা তাতে ফ্রি আর পেয়িং বেডের দৃশ্যত কোনও তফাত নেই। জন-প্রতিনিধিরা দেদার ফ্রি সার্টিফিকেট বিলোচ্ছেন, আর তাই বেশির ভাগ শয্যাই ফ্রি হয়ে যাচ্ছে। এ ভাবে চালানো মুশকিল।”
এসএসকেএম তথা ইনস্টিটিউট অফ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এর অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র বলেন, “বেশির ভাগ শয্যাই তো ফ্রি। এসএসকেএমের কথাই ধরা যাক। এখানে কাগজে-কলমে অন্য হাসপাতালের তুলনায় ফ্রি বেড কম। কিন্তু জনপ্রতিনিধির চিঠি এনে যথেচ্ছ ‘ফ্রি’ করে নেওয়া হচ্ছে। সবটাই যদি এ ভাবে চললে ফ্রি আর পেয়িং আলাদা রেখে লাভ কী? চিকিৎসাকে সকলের নাগালে এনে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তকে আমরা সকলেই রূপায়ণের চেষ্টা করব।”
কিন্তু এ ক্ষেত্রে একটা প্রশ্নও উঠেছে। গরিব মানুষের নিখরচায় চিকিৎসা অবশ্যই প্রাপ্য। বিপিএল কার্ড থাকলে সেই সুবিধা তাঁরা এখনও পাচ্ছেন। কিন্তু যাঁদের সামর্থ্য রয়েছে, তাঁরা কেন ফ্রি বেড-এ ভর্তি হবেন? এই প্রবণতা কি ‘জনমোহিনী’ রাজনীতিরই একটা চেহারা? স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন, এ ক্ষেত্রে হয়তো নিয়ম কিছুটা বদলাবে। শয্যা ফ্রি হলেও এপিএল-দের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা ‘ফ্রি’ হবে না। অস্ত্রোপচার বা অন্যান্য পরিষেবারও খরচ লাগবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy