Advertisement
E-Paper

সল্টলেকে বসেছে রাসায়নিকমুক্ত খাঁটি জিনিসের হাট

হাট বসেছে রবিবারে, সল্টলেকের সিডি ব্লকের ৩ নম্বরে। তিন তলা বাড়ির এক তলার এক চিলতে বারান্দায় রাখা খান পঁচিশেক বেতের ঝুড়ি। তাতে রাখা হরেক রকম শাকসব্জি ও ফল। বারান্দার অন্য দিকে লোহার র্যাকে সাজানো ঘি, মধু, আচার, চাল, হলুদ, তেল, মশলাপাতি। বিধাননগর মহকুমা হাসপাতালের ঠিক উল্টো দিকে ঢোকার মুখে দু’জায়গায় লেখা ‘আর্থ হাট’। অর্থাৎ প্রাকৃতিক জিনিসের সম্ভার। যেগুলো কোনও কৃত্রিমতা ছাড়াই পাওয়া যাচ্ছে মাটি থেকে। ওই হাটের স্লোগান তাই‘ইট পিওর, লিভ হেলদি। খাঁটি জিনিস খান আর সুস্থ ভাবে বাঁচুন।’

সোমনাথ চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০১৪ ০৭:৫৭
রাসায়নিকমুক্ত সব্জি বিক্রি হচ্ছে সল্টলেকে।—নিজস্ব চিত্র।

রাসায়নিকমুক্ত সব্জি বিক্রি হচ্ছে সল্টলেকে।—নিজস্ব চিত্র।

হাট বসেছে রবিবারে, সল্টলেকের সিডি ব্লকের ৩ নম্বরে।

তিন তলা বাড়ির এক তলার এক চিলতে বারান্দায় রাখা খান পঁচিশেক বেতের ঝুড়ি। তাতে রাখা হরেক রকম শাকসব্জি ও ফল। বারান্দার অন্য দিকে লোহার র্যাকে সাজানো ঘি, মধু, আচার, চাল, হলুদ, তেল, মশলাপাতি। বিধাননগর মহকুমা হাসপাতালের ঠিক উল্টো দিকে ঢোকার মুখে দু’জায়গায় লেখা ‘আর্থ হাট’। অর্থাৎ প্রাকৃতিক জিনিসের সম্ভার। যেগুলো কোনও কৃত্রিমতা ছাড়াই পাওয়া যাচ্ছে মাটি থেকে। ওই হাটের স্লোগান তাই‘ইট পিওর, লিভ হেলদি। খাঁটি জিনিস খান আর সুস্থ ভাবে বাঁচুন।’

পসরা সাজিয়ে বসেছেন যাঁরা, তাঁদের দাবি, ওই সমস্ত সব্জিই রাসায়নিক সার ছাড়া চাষ করা হয়েছে। তেল-হলুদ-আচারে কৃত্রিম বা ভেজাল কিছু ও ‘প্রিজারভেটিভ’ দেওয়া নেই। চাল একেবারে হাতে কোটা কিংবা ঢেকিতে ছাঁটা। টাটকা, রাসায়নিকমুক্ত ও জৈব বস্তু ব্যবহারে ওই যাবতীয় খাদ্যসামগ্রী উৎপন্ন করা হয়েছে বলে জানাচ্ছেন উদ্যোক্তারা।

রোজকার অভিজ্ঞতায় বাজারে আনাজপাতির দাম এক দিকে যখন ক্রমেই চড়া হচ্ছে, তখন তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের নিজস্ব স্বাদ, গন্ধ। বছর কয়েক আগে কলকাতার এক লেখক এক অজগাঁয়ে গিয়ে বিস্মিত হয়েছিলেন। কারণ, সেখানকার এক বাড়িতে খেতে বসে তিনি আবিষ্কার করলেন, ‘ফুলকপি আর বাঁধাকপির স্বাদ ফুলকপি আর বাঁধাকপিরই মতো!’ জিজ্ঞেস করে লেখক জানতে পারলেন, শাকসব্জি চাষে ওই গ্রামে কোনও রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয় না, পোকা তাড়াতে দেওয়া হয় গরুর চোনার মতো প্রাকৃতিক কীটনাশক। তেমনই বাঁকুড়া জেলার রানিবাঁধ এলাকার মিঠা আম নামে একটি গ্রামের প্রবেশপথে বাঁশের তোরণে বড় বড় করে লেখা, ‘এটি জৈব সারের গ্রাম।’ ওই গ্রামে চাষের মাঠে জৈব সার ছাড়া অন্য কিছু ব্যবহারই করা হয় না।

অথচ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। বাজারে গিয়ে চকচকে কালো বেগুন দেখে ক্রেতা আকৃষ্ট হচ্ছেন। অথচ তিনি জানেন না, ওই মনোহর রূপ এসেছে বেগুনকে মারাত্মক এক রাসায়নিকে চোবানোর ফলে। এমনকী, ভেজাল সর্ষের তেলে কৃত্রিম ভাবে ঝাঁঝ আনার পদ্ধতিও আয়ত্ত করে ফেলেছে কয়েকটি সংস্থা। চিকিৎসক-ডায়েটেশিয়ানেরা শাক-সব্জি-ফল খাওয়ার উপর জোর দিতে বললেও সে সব জিনিসে থাকা রাসায়নিকের ফলে পেটের গণ্ডগোল-সহ নানা রকম জটিলতা দেখা দিচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে ‘অর্গানিক ফুড’ বা রাসায়নিক বজির্ত প্রাকৃতিক খাবারের চল বেড়েছে কিছুকাল ধরে। বেশি দাম দিয়ে হলেও ওই ধরনের খাদ্যসামগ্রী কিনছেন এক শ্রেণির সচেতন মানুষ। নামি পোশাক বিপণিতেও নিয়মিত বিক্রি হচ্ছে অর্গানিক জ্যাম-জেলি, চাল-ডাল, আচার।

কিন্তু সল্টলেকের সিডি ব্লকের ওই হাটে রাসায়নিকমুক্ত প্রাকৃতিক সব্জি বিক্রির উদ্যোগ শহরে একমাত্র না হলেও অভিনব। ‘আর্থ হাটে’ বিক্রি হওয়া সব্জি আর পাঁচটা বাজারের সব্জির চেয়ে একটু আলাদা। আকারে ছোট বেগুন, পেঁপে, করলা, সিম, পাতাওয়ালা গাজর, ছোট ছোট ফুলকপি ও বাঁধাকপি, ছোট ঝিঙে, পটল ও ঢেঁড়স রয়েছে এখানে। টম্যাটো দেখতে তরতাজা কিন্তু তার রঙে অস্বাভাবিক লাল ভাবটা অনুপস্থিত। তবে এ সবের দাম সাধারণ বাজারের সব্জির দামের তুলনায় ১৫-২০ শতাংশ বেশি। রবিবার এখানে বেগুন ৪০ টাকা কেজিতে, ফুলকপি প্রতিটি ১৫ টাকা, ঢেঁড়স ২৫০ টাকা, পেয়ারা ১৩০ টাকা, ঝিঙে ৬৫ টাকা কেজিতে বিকিয়েছে। ‘খাঁটি ঘি’ এখানে ২০০ গ্রামের দাম ৩০০ টাকা। ঢেকি ছাঁটা লাল চালের কেজি ১২০ টাকা, ৫০০ গ্রাম সর্ষের তেলের দাম ৯০ টাকা।

‘আর্থ হাট’-এর উদ্যোক্তা ঈপ্সিতা চক্রবর্তীর বক্তব্য, “ভাল জিনিসের জন্য দাম তো একটু বেশি লাগবেই।” তিনি জানান, নদিয়ার তাহেরপুর, বীরভূমের বোলপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুর, সুন্দরবন ও নামখানা, এমনকী উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন কৃষি খামার থেকে সব্জি, তেল, আচার, ঘি, তেল কেনা হয় এই হাটের জন্য। তাঁর কথায়, “টানা তিন বছর ওই সমস্ত জিনিস চাষ হয়েছে, তৈরি করা হয়েছে কোনও রকম রাসায়নিক ছাড়াই। এই ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট খামারকে দেওয়া উপযুক্ত সংস্থার শংসাপত্র দেখেই জিনিসপত্র আমরা কিনছি।”

রবিবার সেখানে বাজার করতে আসা সল্টলেকের এসি ব্লকের সুদীপ্ত বিশ্বাস বলেন, “এখানকার সব্জির স্বাদ খুব ভাল। একেবারে অন্য রকম। তাই, এক বার কেনার পর ফের এসেছি।” পেশায় চিকিৎসক রত্না ভট্টাচার্যের কথায়, “এত ভাল সব্জি তো এখন আর পাওয়াই যায় না।” সিডি ব্লকেরই বাসিন্দা গৌতম চক্রবর্তীর বক্তব্য, “রাসায়নিক সারহীন সব্জি স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল, তাই কিনছি।”

এ দিন বেলা সাড়ে ১১টার মধ্যে প্রায় তিনশো কেজি ফল-সব্জির সমস্তটাই বিক্রি হয়ে গিয়েছে ওই হাট থেকে। দুপুরেই ক্রেতার সংখ্যা ৬০ ছাড়িয়ে গিয়েছে।

ঈপ্সিতা দেবীর এক আত্মীয়ের জায়গা নিখরচায় নিয়ে এই বিপণি চালু হয়েছে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি। আপাতত প্রতি রবিবার সকাল সাতটা থেকে সন্ধে সাতটা পর্যন্ত খোলা থাকছে। ছ’জন তরুণ ও এক জন তরুণীর প্রত্যেকে পাঁচ-ছ’হাজার টাকা দিয়ে প্রাথমিক ভাবে ৩৫-৪০ হাজার টাকার পুঁজি সম্বল করে ওই হাট শুরু করেছেন। উদ্যোক্তাদের এক জন, অজুর্ন গুপ্ত বলেন, “লাভের মুখ দেখলে ব্যবসার কলেবর আরও বাড়ানো হবে।”

কিন্তু রাসায়নিকমুক্ত সব্জি বিক্রির এই ধরনের উদ্যোগে কি রাজ্য সরকার সামিল হতে পারে না?

মুখ্যমন্ত্রীর কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদার বলেন, “রাসায়নিকমুক্ত, প্রাকৃতিক সব্জি চাষে কৃষকদের উৎসাহ দিতে সরকার ইতিমধ্যেই রাজ্যের কয়েকটি জায়গায় বিভিন্ন রকম সুযোগ-সুবিধে দিয়েছে।” তিনি জানান, ‘অর্গানিক’ সব্জি চাষে খুব বড় কৃষক না হলে কারও একার পক্ষে চাষ ও বিভিন্ন বিপণিতে সরবরাহ দেওয়ার কাজটি ব্যয়বহুল। সে জন্য কয়েক জন কৃষককে নিয়ে একটি গোষ্ঠী তৈরি করে তার পর সেই গোষ্ঠীর হাতে জৈব সার-সহ বিভিন্ন সামগ্রী কেনার জন্য টাকা দেওয়া হচ্ছে।”

somnath chakraborty saltlake organic food
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy